‘মধ্যরাতে বৃষ্টি হলেও তোমার একান্ত পুরুষ তোমাকে পাবে না’
চিত্রা
ভিন দেশী মেহগনির ফাঁক গলে আমার দক্ষিণার জানালা দিয়ে বন্যার পানির মতো হু হু করে ঢুকছে চাঁদের আলো, জল জোছনা। সেই জলেতে ভীষণ ভিজে আমি এককাট্টা হয়ে যাচ্ছি। কেন এমন হয়। এক দুই পার করে টেনে নিয়ে গেছি আটাশটি শীত-গ্রীষ্ম এবং মাত্র চারটি বসন্ত। সেই চারটি বসন্তে আমার আকাশজুড়ে কেবলই খেলা করেছে বর্ণিল মেঘ আর বাতাস ছুঁয়ে গেছে অজানা সব শিহরণে। হায় মানুষ জন্ম এত কম কেন! এ রকম মনে হতো। কি জানি এক সর্বগ্রাসী প্লাবন ছুঁয়ে গেছে। আমার চারপাশের স্বজনরা বলছে শোক এত দীর্ঘ থাকতে নেই। ভুলে যাও সব কিছু। সামনে এগিয়ে যাও। কি দরকার উদ্ভট, কিম্ভূত কিমাকারসদৃশ পেছনে তাকানোর। আধুনিক সমাজের নিয়মটাই নাকি এমন, অকৃত্রিম সব বোধের সম্পর্ক পাল্টে যায়। বিনির্মাণ হয় পুঁজি, পণ্য, মুনাফা ও ভোগের সম্পর্কে । অথচ আমি যতবার সামনের দিকে তাকাই পেছন আমাকে টানে অথবা আমি পেছনেই পড়ে রই। আমার স্বজনরা আমাকে ভর্ৎসনা করে। আমি মেনে নিয়েছি আমি সামনে যেতে পারব না। পরাজিত মানুষের মতো আমি শুধু একলা একা পড়ে রব। আমার সামনে তো কিছু নেই। যা কিছু তা পেছনে পড়ে রয়েছে অথবা ও জীবন ছেড়ে আমি আর কোথাও যেতে পারব না। যে জীবনে তুমি আমি মুখোমুখি হয়ে বেলা অবেলার গল্প করেছি। ঘাস ফড়িংয়ের আবাস নিয়ে বেদনার কথা বলতে বলতে কেঁদেছি।
চিত্রা আমাকে পেছনে ফেলে তুমি এগিয়ে গেছ স্বপ্নের দিকে। আমার ভাবতে কেমন যেন ঘৃণা হয়, অবাক লাগে যে তুমি সেই এগিয়ে যাবার স্বপ্নে যাকে সঙ্গী করেছ তাকে ভালোবেসেই করেছ। এক মানুষ কতবার ভালোবাসার আকুল পাথারে ড্বুাতে পারে বলতে পার আমাকে? হয়ত খুব পুরুষতান্ত্রিক কথা হতে পারে তবু বলতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসার রঙ নিয়ে মানুষ কতবার তার ভুবন রাঙাতে পারে। আমার বন্ধুরা বলে, যাদের হৃদয় আকাশের মতো তারা বার বার ভালোবাসতে পারে, রাঙাতেও পারে। আমি প্রকৃতই ছোট হৃদয়ের মানুষ।
২.
শিশু তোমার খুব পছন্দের। ভালোবাসায় ভাগ বসাবে বলে আমি দূরে রাখার পক্ষপাতি ছিলাম। কি স্বার্থপর দেখো আমি। জগত সংসার সব একাকার করে দিয়ে আমি শুধু আমার নিজের সুখের কথা ভাবছি।
তোমার পছন্দ ছেলে আর আমার মেয়ে। কন্যা হলে আমি নাম রাখব, পুত্র হলে তুমি।
আর অল্পদিন গত হলেই তুমি মা হবে। আমি কায়মনে অপেক্ষা করছি তোমার যেনো একটি পুত্র সন্তান হোক। ধর্ম বিশ্বাসে আমার তেমন জোর নেই। তবু প্রার্থনা করি জীবন, জগত এবং প্রকৃতির কাছে তোমার যেন পুত্র সন্তানই হয়। আজ থেকে আরও ২৬ বছর পরে কোনো এক চিত্রা কিংবা ওই রকম স্বচ্ছ নদীর জলপ্রবাহের মতো অন্য কোনো এক নারীর কাছ থেকে তোমার পুত্র প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসবে, ঘুরবে একা, ভীষণ একা। তখন মা হিসেবে কেমন লাগবে এটা দেখতে চাই। তখন কোনো এক ঘোর লাগা সন্ধায় যদি দেখা হয় সেন্ট্রাল লাইব্রেরী কিম্বা আজিজ শাহবাগে আমরা না হয় মুখোমুখি অল্প একটু অবসর নিবো।
৩.
তোমার প্রতি আমার অভিমান দিন দিন বাড়ছে। আর বিপরীতে নিশ্চয়ই তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার ভাব-ভালোবাসা আরও গভীর হচ্ছে। তুমি কি এখনো মধ্যরাতে বৃষ্টি হলে তোমার স্বামীকে ডেকে বলো, ‘দেখো কেমন অদ্ভুত বৃষ্টি হচ্ছে? চলো বৃষ্টিতে ভিজি।’ বৃষ্টির প্রতি যে তোমার অন্ধ মোহ আছে তোমার স্বামী সেটা জানে? আমি জানি, ‘মধ্যরাতে বৃষ্টি হলেও তোমার একান্ত পুরুষ তোমাকে পাবে না।’ এ আমার অভিশাপ নয়। তুমি নিশ্চিত করেই জানো শাপ-শাপান্তে আমি বিশ্বাস করি না। মধ্যরাতে বৃষ্টি হলে হৃদয়ের কোথায় সুর বেজে ওঠে, আস্তে আস্তে জ্বলে ওঠে মায়াবি মোমের নরম আলো তা তো তোমার স্বামী জানে না। হিসাব কষা মানুষ জীবন অর্থনৈতিক নিরাপদে রাখে সত্য, তবে এও সত্য যে জীবন আর জীবনের মধ্যে থাকে না। নৈতিক অনেক কিছু্ আর অর্থের মধ্যে থাকে না।
৪.
দীপান্বিতার সঙ্গে আমার দেখা হয় কদাচিৎ। আমরা দুজনে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দিয়ে যখন যাই আমাদের দু’জনকেই স্মৃতি পেয়ে বসে। স্মৃতি কাতরতায় ভুগি। আমাদের তখন কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। তখন কেবল ইচ্ছে করে পালাতে। আমরা পালাতে পারি না। মানুষ পালিয়ে কোথায় যাবে; আরেক মানুষের সমাজে? সেখানেও তো তোমার মতো প্রতারক মানুষ বিষধর সাপের মতো ফেলিছে নিশ্বাস অথচ বাইরে কি আশ্চর্য সব মায়া। এমন মায়া যেন কষ্ট হয় আমার মতো ভবঘুরেদের।
দীপান্বিতাকেও তুমি ঠকিয়েছ। ও রকম বন্ধু হয়। দীপা বিছানা ঠিক না করে দিলে যার ঘুম আসে না, দীপা রান্না না করলে যে খেতে পারে না; সে কী করে সেই বন্ধুকে ভুলে থাকে? আমি না হয় তোমার আপন হতে পারিনি। কিন্তু দীপা?
তুমি আসলেই স্বার্থপর? নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই কখনোই দেখনি। দীপা এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, দীপা যখন আমাকে ফ্রাঞ্জ ফানোর কথা বলে। উত্তর ঔপনিবেশিক আধিপত্যের কথা বলে। আমি জানি আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের কৃষি প্রধান একটি দেশ কথিত উন্নত বিশ্বের গোলামির জালে বন্দি। তখন আর মন খারাপ করে না। কিন্তু দীপার তো এসব নিয়ে ভাববার কথা ছিল না। এসব নিয়ে বাবার কথা ছিল তোমার। এখন তুমি অন্য জগতের মানুষ। অথচ কি আশ্চর্য ও ভাবছে। আর তুমি যে স্বপ্ন দেখতে একটি বৈষম্যহীন সমাজের সে এখন কোথায়?
তুমিও তো গোলাম; স্বামীর, পুরুষের অথবা ব্যবস্থার। পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজ ভেঙে যে সমাজ আনতে চাচ্ছ সে সমাজও তো আরও গোঁড়া পুরুষতান্ত্রিক। তালেবানি ওই ব্যবস্থায় তুমি কীভাবে জড়িয়ে গেলে? তুমি যেদিন সুফি ইসলাম, মরমি ইসলাম বাদ দিয়ে ওহাবি ইসলামকে জীবনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছ সেদিন থেকেই তুমি আসলে চলে গেছ আমার থেকে অনেক দূরে।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষ জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অন্য কোনো জগতের দিকে, সে কীভাবে গোঁড়া ওহাবি ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়?
আমি জানি তুমি তোমার জীবন নিয়ে ভীষণ সুখী। সুখে যেন তোমার পা মাটিতে পড়ে না। আর আমি? থাক আমার কথা না হয় বললাম না। আমি না হয় হৃদয়হীন ইট সিমেন্টের জঙ্গলে একা হাঁটি, একা, একা...।
যেখানে থেক, একটু হলেও যেন কষ্টে থেক। যখন আকাশ রাঙিয়ে ওঠে পূর্ণবর্তী পূর্ণিমার চাঁদ অথবা এই শহর গিলে নেয় যখন অঝোর ধারার বৃষ্টির শরীর তখন হলেও আমার কথা স্মরণ কর।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১০ দুপুর ১২:৫৮