somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গন্ধ বাবুর্চী

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রামের বাড়ীতে একটা উৎসব হচ্ছে। রান্না করবে গন্ধ বাবুর্চী।নিজের রান্নার লবন পর্যন্ত দেখেন না। শুধু গন্ধ শুঁকে রান্না করেন, তাই এই নাম। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেষ্টিং মনে হলো। তিন পা ওয়ালা ছাগলের বাচ্চা হলে গ্রামের মানুষের উৎসাহের অভাব থাকে না। কিন্তু বাবুর্চীর বিষয়ে কারো কোন আগ্রহ দেখা গেলো না। আগ্রহ বলতে বাবুর্চীর রান্না অসাধারণ। সবসময় পাওয়া যায়না, আজ পাওয়া গেছে, এই যা।

গ্রামের বাড়ী খুব একটা যাওয়া হয়না। বেশীরভাগ মানুষকেই 'দেখলে চিনি, নাম জানিনা' অবস্থা। কিন্তু এত আগ্রহ নিয়ে, আপন ভেবে মানুষজন কথা বলে যে চিনতে পারিনি বলা যায়না। ঝুলন্ত একটা হাসি দিয়ে তা মেকাপ দেওয়ার চেষ্টা করি। তারপরেও কিছু কথাবার্তাতো বলতেই হয়।

- কি ও বালা আছো নি?
এই টাইপ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়।
- চিনছোনি আমারে?
এই প্রশ্ন শুনলেই বুকটা ধক করে ওঠে। আয় হায় এখন কি বলবো। সকালবেলা খুব স্মার্টলি একবার উত্তর দিলাম
- জ্বি ভাই, চিনছি। তো আছেন কেমন?
- আমি তোমার বাই না, চাচা অই সম্পর্কে।
এর পর শুরু হলো বিশাল ফিরিস্তি। এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম গৃহবন্দী থাকবো।

বই মেলায় সহকর্মীদের বই বের হয়েছে। আহসান কবিরের রাজেস্বরীর গৃহপালিত নদী, পলাশ মাহবুবের টো টো কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড। দুইটা বই পাশাপাশি পড়া শুরু করলাম। বন্ধুদের আসরে গল্প করলে যেমন সবার দিকেই আই কন্টাক্ট রাখতে হয়, সবার সাথেই গল্প করতে হয়। ব্যাপারটা এই রকম। পড়ার এই ভিন্নতায় মজা লাগছে। টো টো কোম্পানীর কাকু ঢুকে যাচ্ছে রাজেস্বরীর রানায়। ক্ষতি কি, এক দেশ থেকে মানুষ অন্য দেশে ঘুরতে যায়না? বইয়ের মানুষগুলোওতে কল্পনায় মানুষই। তারাও না হয় এক বই থেকে আরেক বইয়ে ঘুরতে গেলো।
ক্ষতি কি
বলো কী ক্ষতি তাতে।

বই শেষ হতে হতে সন্ধা হয়ে গেলো। হঠাৎ করে বাবুর্চীর কথা মাথায় এলো। এতক্ষনে তো বাবুর্চীর চলে আসার কথা।

বাবুর্চীর একটা কাল্পনিক ছবি মনেমনে দাড় করিয়েছিলাম। পেট মোটা, কোমরে গামছা বাধা, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের একটা চরিত্র। কল্পনার সাথে কিছুই মিললো না। বছর পচিশ, ছাব্বিস হবে। রোগা, পটকা গড়ন। জিন্সের প‌েন্ট আর টি শার্ট পড়া।

রান্নার আয়েজন সব এক সাথে করা হচ্ছে। বাবুর্চী নিজেই চুলার গর্ত করলো। গর্ত করার পদ্ধতি দেখে আমি মুগ্ধ। সাধারণত এমন অনুষ্ঠানে ইটার উপর পাতিল রাখা হয়। এতে ৯০% তাপ অপচয় হয়। কিন্তু মাটি খুঁড়ে বাবুর্চী যেভাবে চুলার ডিজাইন করেছে এতে তাপ অপচয়টা অনেক কম হবে।

একটা চেয়ার নিয়ে রান্না যেখানে হচ্ছে উঠানের এই পাশটাতে বসলাম। বাবুর্চীর সাথে চোখাচোখিও হলো না। সে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। কারো সাথেই তেমন কথা বার্তা বলছেনা।
- বাবুর্চী সাহেবের নাম কি?
- আবুল হোসেন

ব্যাস, আর কথা বার্তা আগালো না। আবার চুপচাপ বসে আছি। ফাগুন মাসেও দেখি গ্রামে ভালো শীত। শীতে ছুঁতোয় জিজ্ঞাসা করলাম
- শীত লাগেনা আবুল হোসেন?

আবুল হোসেন বিনয়ের সাথে একবার তাকালো। কিন্তু কোন জবাব দিলো না। মনেমনে বল্লাম, সামথিং ইজ দেয়ার।

একজন খবর নিয়ে এলো কারা যেন নাচতে চায়, বখশিশ দিতে হবে। গ্রামের মানুষ সম্পর্কে আমার ধারনা দিনকে দিন বদলাচ্ছে। এক কিলোমিটারেরও কম রিক্সায় চড়ে ত্রিশ টাকা ভাড়া দিলাম। রিক্সাওয়ালা অমায়িক হাসি দিয়ে বল্লো, বখশিশ দিবেন না? আমি মনে করেছিলাম ভাড়া দশ টাকা, বখশিশ বিশ টাকা।
- ভাড়া কত?
- ধরেন গিয়া যে যেমুন দেয়। এ্যামনে ন্যায্য ভাড়া তিরিশ টেহা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে দিলাম। গ্রামের বাড়ী এসে রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে ত্রিশটাকা আর ফেরত নিলাম না। অতএব এক কিলোর কম রাস্তার রিক্সা ভাড়া গেলো আশি টাকা।

তাই দেন দরবার আগে করে নিলাম। কতটুকু খুশি তারা করতে পারবে নেচে তা না দেখেই বখশিশের টাকা হাতে দিয়ে বল্লাম, নাচো।

একটা সময় গ্রামে আব্বাস উদ্দীনের, আব্দুল আলীমের গান বাজতো। নদীতে বেদেদের নৌকা বহর যেতো। নৌকার বহর থেকে খালি গলায় গান ভেসে আসতো - মোরা পংখী মারি, পংখী ধরি, মোরা পংখি বেইচা খাই / মোদের সুখের সীমা নাই। এখন সময় বদলেছে, গ্রামের এই মাটির সুর গুলো চলে গেছে শহরের মানুষের কালেকশানে। আর শহরের ডিজে মিউজিক চলে এসেছে গ্রামে। নাচনেওয়ালা চার কিশোরের নাচ শুরু করার আগে দেখা গেলো এরা বেশ গুছানো। পোর্টেবল স্পিকার, মোবাইলে প্ল্যালিষ্ট সবই গুছিয়ে এনেছে। প্রথম নাচ দেখেই মনে হলো, পয়সা ওসুল।

বাবুর্চীর কথা ফাঁকে ফাঁকে মনে হলো। উঁকি মেরে দেখি আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। চুলায় আগুন দেয়া হয়েছে। আর এদিক দিয়ে নাচনেয়ালারা প্রত্যেকটা গানের সাথেই উপস্থিত কোরিওগ্রাফির কাজ করছে অসাধারণ।

একটা গানের শেষে আর একটা গানের শুরুতে একটা সেটাপের ব্যাপার থাকে। এলিমেন্ট সব আশপাশ থেকে সংগ্রহ করে। যেমন, একবার দেখি গাছের পাতা টাতা এনে সামনে রাখা হলো। একটা চাদর উঠানে পেতে এর উপর এদের এক সঙ্গীকে শুয়ানো হলো। এই শীতের রাতের মাটিতে দেখি মারার মত সে শুয়েও আছে! পরে গান শুরু হলো, মাওলা আমার সব নিয়া নে রে মাওলা...। যখন সব নিয়ে নে বারী সিদ্দিকি সাহেব গেয়ে ওঠেন তখন কান্নারত যুবক মাথা ঠেকায় শুয়ে থাকা মরার অভিনয় করা কিশোরে। আর দুই হাত দিয়ে পাতা ছিটিয়ে ছিটিয়ে 'সব নিয়ে নে' বলছে অভিনয়ের ভাষায়। আমি মুগ্ধের উপরে মুগ্ধ।

শেষ গান গাওয়া হবে। এবার কোরিওগ্রাফির জন্য আবার প্রস্তুতি। দর্শকদের ভিতর থেকেই একজন বয়স্কা মহিলাকে উঠানের মাঝে বসানো হলো। তার পায়ের কাছে বসেছে একজন ডান্সার। গান শুরু হলো, মা তুমি আমার আগে যেও নাগো মরে...। ডুকরে ডুকরে সারা শরীর কাঁপিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছে অজপাড়া গাঁএর এক কিশোর। আহারে কি সুন্দর অভিনয়। গানটাও আজ আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠলো এদের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ করেই দেখি বাবুর্চ নাই।

গান এখনো শেষ হয়নি, দর্শক এতক্ষন হৈ হোল্লোড় করে আনন্দ করেছে নাচের সাথে। এখন পিন পতনের শব্দটি পর্যন্ত নেই। কোয়াশায় ঢাকা চাঁদ যেন গানের বেদনাকে আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আস্তে করে ওঠে গেলাম। ওঠানের এক কোনায় অন্ধকারে দাড়িয়ে বন্ধ বাবুর্চী আবুল হোসেন কাঁদছে। একবার ভাবলাম কাঁদতে দেই, নিরবে দূরে চলে যাই। আবার কি ভেবে যেন আস্তে আস্তে কাছে গেলাম। কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করলাম না। টান দিয়ে কাছে আনলাম। সে ও কাছে আসলো। যেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে পেয়েছে বন্ধুর কাঁধ। বেশ কিছুক্ষণ সে কাঁদলো। গান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ, মুখ মুছে আবার চুলার কাছে আসলো। যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি।

আমি বরাবরই সংসারে অকর্মা মানুষ। সংসারের প‌্যাঁচ মাথায় ঢুকেনা, সংসারের দায়িত্বও না। বড় ভাই সব দেখাশুনা করছেন। তবু একবার সব কিছু ঘুরা দিয়ে দেখে এসে আবার বাবার্চীর পাশে বসলাম। আমি কোন কাজে লাগিনা। অতএব কোন কাজে কেউ আমাকে ডাকতেও আসে না। আবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসা করলাম
- আবুল হোসেন বাড়ী কই?
কোন উত্তর নাই। বুঝলাম সে এখনো আবেগ সামলাতে পারেনি অথবা সে বলতে চাচ্ছে না।
- আবুল হোসেন, বাড়ীতে কে কে আছে?
- কেউ না
- বাবা?
- ছুডু থকতে মইরা গেছে।
- মা?
এবার আবুল হোসেন আবার চোখ মুছলো। চুলার আগুনের দিকে মনযোগ দিলো। উত্তর দিলো না।

অনেক্ষন চুপচাপ বসে আছি। মাঝে মাঝে লোকজন এসে এটাওটা দিয়ে যাচ্ছে চুলার কাছে। আবুল হোসেন যে কম কথা বলেন এই ঘটনা মনে হয় সবাই জানে। তাই যা কথা বলছে সবই অনেকটা হ্যা না দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছে।

আবুলকে যে প্রশ্ন অনেক্ষন আগে করেছিলাম তা সে এতক্ষনে জবাব দিলো
- সামনের বিষুদবারে তোরো বছর চাইর মাস অইবো।

তারিখ মনে রাখা সহজ। কিন্তু কত বছর, কত দিন হলো তা বলা সহজ না। দিন দিন করে দিন গুনলেই কেবল তা সম্ভব। কেন জানি মনে হলো, আমি যে মমতা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি এই মমতা সে কঠিন এই সংসারে খুব কমই পেয়েছে।

আবুল হোসেন এখন আমার সামনে অনেকটাই সহজ। সিগারেট ধরিয়ে টানলো। আবার রান্নায় মনযোগ দিলো। অনেক্ষণ কোন কথা নেই। রান্নার গন্ধ আসা শুরু হয়েছে। এই গন্ধ যার নাকে একবার যায় সে লজ্জা শরম ভুলে একটু হলেও চেয়ে নিবে। একবার সত্যি সত্যি এমন এক ঘটনা ঘটলো। মহসিন সাহেব নামের এক ভদ্রলোক আমার অফিসে আসলেন। দুপুর তখন পার হয়ে গেছে। ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম কিছু আনাবো কি না। তিনি বল্লেন খেয়ে এসেছেন। এর কিছুক্ষন পর অসাধারণ একটা তরকারীর গন্ধ নাকে গেলো। মহসিন সাহেব চট করে যেন নাক কান খাড়া করে ফেল্লেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো রাকিব সাহেবের বাসা থেকে আনা খাওয়ার গন্ধ। উনার অনুরুধে আমি কিছুটা খাবার এনে দিয়েছিলাম। অল্প একটুই খাবার। আঙ্গুল চেটেপুটে মহসিন সাহেব তৃপ্তি নিয়ে বলেছিলেন, এমন খাওয়া জীবনে কোন দিন খাই নাই, আর কোন দিন খাবোও না হয়ত। আবুল হোসেনের রান্নাটা মহসিন সাহেবকে খাওয়াতে পারলে ভালো হতো।

আবুল হোসেন আর একটা সিগারেট হয়ত ধরাবে। কিন্তু দেখা গেলো সিগারেট নেই। খালি পেকেটটা নাড়া দিয়ে দেখে ফেলে দিলো। আমি একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম। সি নিলো, সহজ ভাবেই নিলো।

সিগারেটে বড় করে একটা টান দিয়ে সে বলতে শুরু করলো-

ছোট থাকতে তার বাবা মারা গেছে। মা এর পর এই বাড়ী ঐবাড়ী কাজে সাহায্য করতো। মা ছেলের পেট তাতেই চলতো। আবুল হোসেনের যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন মায়ের শ্বাস কষ্টের রোগ বেড়ে গেলো। আর কাজ করতে পারে না। বুক ভর্তী কফ। শ্বাস টানার সময় পুইন পুইন শব্দ হয় বুকের ভিতর। সংসারে খাওয়া দাওয়ার বড়ই অভাব। বারার রেখে যাওয়া এমন কিছুই নাই যে সংসার চলবে। আবুল হোসেন রাজ মিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করলো। নিয়মিত কাজ থাকে না। আশেপাশের দোকানেও বিস্তর বাকী পড়েছে। মায়ের শরীর দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বাজারের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তারতো না ঔষধ দোকানদার। সে বলেছে অবস্থা ভালো না, শহরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু টাকা কই?

একদিন মা অচেতন হয়ে গেলেন। গায়ে জ্বরও অনেক। আবুল হোসেনকে ডাক দিয়ে কাছে নিয়ে খুব কষ্টে বল্লেন, আবুল হোসেন রুই মাছের মাথা খাইতে মন চায়। খালি পেইজ দিয়া রুই মাছের মাথার ভুনার গন্ধ পাই।

আবুল হোসেনের তখন কোন কাজ নাই। পকেটেও টাকাও বেশী নাই। তাও এলাকার বাজারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। বড় রুই পাওয়া গেলো, কিন্তু বাকীতে দিবে এমন জেলের কাছে পাওয়া গেলো না। টাকা আছে পকেটে মোটে দুইশ। চার কেজী রুইয়ের দামই চায় তিন হাজার। আবুল হোসেন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলো। মা অসুস্থ হবার পর কোনদিন খাওয়া খাদ্যের বিষয়ে কিছু বলে নাই। আবুল হোসেন শাক পাতা যা রান্না করেছে তাই খেয়েছে। আবার খাওয়া শেষে শ্বাস টানতে টানতে মুচকি হেসে বলেছে, আমার মানিকটা এই রান্না শিখলো কই?

আজ বাসায় আসার পর মা ঘাড়টা টান দিয়ে আবুলের দিকে ফিরেই হাসি দিয়ে জানতে চাইলো, মাছ পাইলি? আবুল কি উত্তর দিবে এর?

তখন প্রায় সন্ধা হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে আবুলের মাথায় বুদ্ধি আসলো। আচ্ছা আস্ত রুই কিনার দরকার কি? হোটেল থেকে রুই মাছের মাথা কিনে আনলেই তো হয়! এলাকায় কোন খাবার হোটেলও নাই যে সে গিয়ে দেখবে রুই মাছের বড় মাথা আছে কি না। আবুল হোসেন রওয়ানা দিলো শহরের দিকে। প্রায় এক ঘন্টা হেটে গিয়ে বাসে আরো ত্রিশ মিনিট। মায়ের শরীর আরো খারাপ করলো।

আবুল হোসেন যখন বড় রাস্তায় পৌছেছে তখন গ্রামের এই রাস্তায় শেষ বাসটিও চলে গেছে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে অনেক কষ্টে সে শহরে যখন পৌছলো তখন রাত প্রায় এগারোটা। খাবার হোটেলগুলো সব বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে। কোথাও কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। শহরের একেবারে শেষ মাথায় রিক্সা গ্যারেজের সাথে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা হোটেল পাওয়া গেলো। হোটেল বলতে এক পাতিলে ভাত, আর একটা ডিসে তরকারী। সামনে একটা ব্যাঞ্চ পাতা। ডিসের উপর একটা বড় রুই মাছের মাথা। আবুল হোসেন আনন্দে কেঁদে ফেল্লো।

মাছের মাথা নিয়ে পায়ে হেটে সে যখন বাড়ী আসলো তখন গভীর রাত। মনে মনে সে ঠিক করে এসেছে, বাড়ী ঢুকেই ভাত বসাবে। মাছের মাথাটা আরেক চুলায় গরমে বসাবে। আবুল হোসেনের কান্নাকাটি দেখে হোটেল মালিকও অনেক মমতা দেখিয়েছেন। তিনি কোন টাকা রাখেননি। মায়ামমতায় কোন হিসাব চলে না। হিসাব করে প্রতি পদে পদে চলেন বড় লোকেরা। তাই বড়লোকেরা মায়া দেখাতে চাইলেও হিসাবের প‌্যাঁচে তা আটকে যায়। হৃদয়ের ঝর্ণা থেকে স্বতঃস্ফুর্ত যে মায়া নিঃস্বরণ হয় তার প্রকাশ কেবল করতে পারে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তাদের কোন হিসাব নাই। তাই মায়া কোন প‌্যাঁচে আটকে থাকে না। হোটেলের মালিক জহির ভাই বলছেন মা'রে নিয়ে শহরে চলে আসতে। রিক্সার গ্যারেজের এক কোনায় জহির ভাই একা থাকেন। জহির ভাই বলছে - মায়ের মামল, কও কি! ফালাইয়া রাখবা না। একজনের মা অইলো সবার মা। নিজের আমার মা নাই। কাইলকাই নিয়া আসো। তুমি আমি হোটেলে থাকমু দরকার অয়।

বড়ীর খুব কাছে গিয়ে আবুল হোসেন খেয়াল করলো মায়ের শ্বাস টানার পুইন পুইন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বুকটা ধক করে ওঠলো। দৌড় দিয়ে বাড়ীতে গিয়ে দেখলো যার জন্য রুই মাছের মাথা আনা তিনিই আর নাই।

আবুর হোসেন তখনই পন করে বসে সে আর কোন দিন ভালো কিছু খাবে না। বেঁচে থাকার জন্য শাকপাতা খেয়ে বেঁচে থাকবে কিন্তু ভালো কিছু, স্বাদের কিছু আর সে খাবে না। মা'কে রুই মাছের মাথা না খাওয়াতে পারা তার কিশোর মন নিজেকে আরো কঠিন শাস্তি দিতে চায়। সে মনে মনে ঠিক করে সে জহির ভাইয়ের হোটেলে গিয়ে রান্না শিখবে। মা যে খাওয়া খেয়ে যেতে পারেননি সে সেই খাওয়া হাজার হাজার মুখে খাওয়াবে। এতে করে মায়ের আত্মাও শান্তি পাবে। আবার সে যে অপদার্থ ছেলে তারও শাস্তি হবে। রান্নার গন্ধ নাকে লাগবে কিন্তু মুখ দিয়ে তা কোন দিন সে দেখবে না এর স্বাদ।

আল্লাহপাক নিশ্চয়ই মাকে বেহেস্তে রেখেছেন। সেও বেহেস্তে যাবে। সে কথাও বলে কম। অল্প কথায়, অল্প দোষ। দোষ কম করলেতো পাপও কম হবে। সে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে একটা রান্না ঘর চাইবে। আর যখন যেই উপাদান দরকার তা যেন হাতের কাছে পাওয়া যায়। সে বেহেস্তে মায়ের মুখে খাওয়া তুলে দিবে। যখন আবুল হোসেন রান্না জানতো না তখনই মা বলতো, আমার মানিকটা এই রান্না শিখলো কই? আর এখনতো সে রান্না জানে। এখন মা কি বলবে তাহলে?

রান্নাবান্না শেষ। রাত তখন নিশুতি। উঠানের কোনায় পাশাপাশি বসে আছি আমি আর একজন মানুষ, ভালো মানুষ, শুদ্ধতম সাদা মনের মানুষ।

অবশেষেঃ ভোর বেলা গন্ধা বাবুর্চী আবুল হোসেন হাওয়া হয়ে গেলো। ঘটনাটা যেন খুব সহজ, এমন ভাবেই সবাই নিলো। এ নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নাই।

খাবার এত মজা হলো যে, সবাই দুই তিন প্ল্যাট করে খেয়েছে। এর উপর আশেপাশের বাড়ীর লোকজন আবারো প্ল্যাট ভর্তী করে নিয়েছে। পেটে জায়গা না থাকায় প্ল্যাটসহ বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছে। অজুহাত হিসাবে বলেছে, পেলেইটটা দুইয়া দিয়া যাইতাছি। আর যাদের বাড়ী দূরে তারা প‌্যাকেট, পলিথিন ম্যানেজ করে অনুরুধ করে খাওয়া নিয়ে গেছেন। কেউবা বড় মেয়েটার বাবু হবে তার জন্য, কেউ বা অসুস্থ রোগী আছে তার জন্য।

আমি খাবো না সিন্ধান্ত নিলাম। বেহেস্তী খাবারের গন্ধতো সারা রাত নাক দিয়ে নিয়েছি। আবুল হোসেন তো প্রায় নিশ্চিৎ যে সে বেহেস্তে যাবে। বেহেস্তে গিয়ে সে মায়ের সাথে বসেই মজাদার রান্না খাবে। আমার স্বর্গে যাবার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। এর পরেও বলা তো যায়না। উপরওয়ালা সব পারেন। হয়ত দেখা যাবে মৃত্যুর পর হাতে বিশেষ একটি কার্ড পেয়েছি। দাওয়াত কার্ড। আবুল হোসেন রান্না করে মা'কে খাওয়াবে, এই দাওয়াত। সেদিনই না হয় মা বেটার সাথে মেহমান হয়ে গন্ধ বাবুর্চী আবুল হোসেনের অমৃত রান্না খাবো।
১৪-২-২০১৪, কুমিল্লা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×