স্নিগ্ধ সকাল; পাহাড়ের কোলে আধা পাকা চারটা লাগানো রুম, আমাদের চার পরিবারের জন্য। সোহানকে নিয়ে বের হলাম চারদিক একটু ভাল করে দেখব বলে। অনেক গাছপালা, রাতের ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙ্গে পরে আছে রাস্তায়। সব থেকে উঁচু পাহাড়ে কাম্প কমান্ডোরের বাসা। পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে খণ্ড খণ্ড মেঘমালার ভেসে বেড়ানো দৃশ্য সৃষ্টিকর্তার সুনিপনতার কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়।
তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হলো কারন আমরা সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভাসাব। কিছুটা অনিশ্চয়তা কারন ঝির ঝির বৃষ্টি এখনও বন্ধ হয়নি। সঞ্জু, ঝর্ণা ওদের ৮ মাস বয়সী যারিফাকে নিয়ে চিন্তিত, এই বৃষ্টিতে বের হতে পারবে কিনা। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের ২ ঘণ্টা পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে আর্মির গাড়ি আমাদের রুমা বাজারে নামিয়ে দিয়ে গেল। আগে থেকে ঠিক করা দুটা ছইওয়ালা নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার কাছে জায়গাটাকে জলছবির মত মনে হচ্ছিল । চারিদিকে সবুজ পাহাড়, মাঝখানে হাঁটু পানি নদী, নদীর জল কাঁদা পানির মত। আমাদের গন্তব্য ছিল একটা ঝর্ণা, তখনও এর নাম জানি না। জানি না প্রকৃতিদেবী কি রূপ নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। নৌকা ছাড়ল, দুই পরিবার একেকটা নৌকাতে। আমরা মনির ভাই পরিবারের সাথে নৌকায় উঠলাম। অপর নৌকায় সঞ্জু এবং মুস্তাফিজ ভাইয়ের পরিবার। আমাদের সবার একটি করে মেয়ে। নৌকা যাত্রা শুরু করলে ছেলেরা খুব উৎফুল্ল হয়ে বেসুরা গলায় গান গাইতে লাগলো। বৈশাখ মাস বলে সাঙ্গু নদীর পানি অনেক কম, যে কেউ কাপড় একটু উপরে তুলে হেঁটে নদী পার হতে পারবে। উজানের দিকে চলছি বলে নৌকার গতি ছিল খুব মন্থর। আমাদের সবার জন্য এটা অন্যরকম একটা দিন। নদীর দুপাশের সবুজ পাহাড়,মাঝে মাঝে জারুল- কৃষ্ণচূড়া গাছ, দূরে পাহাড়ের পাদদেশের মেঘমেলা আমাদের অভিভূত করে রেখেছিল। মনে হয়, আহ্ এই আমাদের দেশ। ঠিক এইখানে একটা ঘর করে সারাজীবন পার করে দিতে পারব। জানি পারব না, তাও মনে হয়। ৩ ঘণ্টা পর আমরা প্রায় ঝিমিয়ে পড়ছিলাম কারন তখনও ঝর্ণার দেখা নাই। মাঝিওয়ালা ভাই আমাদের দূর থেকে ঝর্ণা দেখালে আমরা আবার নড়াচড়া করে উঠলাম। দূর থেকে এত সুন্দর লাগছিল! নৌকা এত মন্থর গতিতে চলছিল ইচ্ছে হচ্ছিল নৌকা থেকে নেমে পড়ে দৌড় দেই। সৃজনী ভাবী উত্তেজনায় কথা বলেই যাচ্ছিলেন। নৌকা থামার সাথে সাথে যে যেভাবে পারলো ঝর্ণার দিকে দৌড় দিল। মাঝি বার বার বলছিল বর্ষাকালে এই ঝর্ণা আরও অনেক বিশাল পরিসর নিয়ে থাকে। আমরা অবশ্য বৈশাখের রূপ দেখেই মুগ্ধ।এটার উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুটের মত। আমি আর সৃজনী ভাবী সবার আগে পিচ্ছিল প্রস্তর খণ্ড পেরিয়ে ঝর্ণার পানির নিচে দাঁড়ালাম। পানির ফোঁটা বিশাল ভরবেগ নিয়ে মাথায় আঘাত করছিল। তাও মজা লাগছিল। একেকজন একেক রকম আওয়াজ করে মনের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। আমার মেয়েটা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়েছিল। পানির এই দাপাদাপি, ফটোসেশান শেষ আর হচ্ছিল না। কারোই মন চাচ্ছিল না ঝর্ণা ছেড়ে ফেরার পথ ধরি।
ফেরার সময় আড়াল না হওয়া পর্যন্ত রিজুক ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আবার কবে দেখতে পারব। নৌকা এবার খুব দ্রুত চলল, ১ ঘণ্টার মাঝে আমরা রুমা বাজারে চলে আসলাম। পেছনে ফেলে আসলাম সারা জীবন মনে রাখার মত কিছু সময়। মেজর মুজাহিদ ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমাদের নাই, উনার আন্তরিকতার জন্য সব সম্ভব হয়েছে।
সোহান, আমি, আমাদের মেয়ে সেবন্তি অনেক জায়গা ঘুরেছি কিন্তু এই ভ্রমন সবসময় জ্বলজ্বল করবে আমাদের মনে, শুধু মাত্র রিজুক ঝর্ণার জন্য। সবাইকে ঘুরে দেখবার জন্য অনুরোধ রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ রাত ৯:০১