somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলচ্চিত্র বিশ্লেষণঃ Hindi Medium

২৭ শে জুন, ২০১৭ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজকাল মানুষজন সিরিয়াস কথাবার্তা খুব একটা পছন্দ করেনা। কেউ সিরিয়াস কিছু বললে আমরা অধিকাংশ মানুষই বিরক্ত হই। অথচ, সে কথাটাই কেউ রসিকতার মোড়কে বললে আমরা খুব আগ্রহ নিয়েই সেটা শুনি। এ সিনেমার পরিচালক এখানে তাই একটা ভালো চাল খাটিয়েছেন। খুব সুন্দর করে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হালকা চালে সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন। এ সিনেমা দেখে আপনি হাসবেন, মজা পাবেন, কিন্তু শেষে এসে মনে হবে, এ বিষয়টা এরকম হলো কেন? কিছু বিষয় আপনাকে ভাবাবে। কঠিন বিষয়ের এরকম তরল উপস্থাপনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সিনেমার সার্থকতা। সিনেমা শেষে সিটি বাজিয়ে হল থেকে বেরোচ্ছেন আপনি, আপনার সিনেমা ভালো লেগেছে। কিন্তু, এরমধ্যেই আপনার অজ্ঞাতসারে কিছু প্রশ্ন ভেতরে ভেতরে তৈরী হয়ে গেছে। যে প্রশ্নগুলো পরে আপনাকে ভাবাবে। এরকমই হবে “হিন্দী মিডিয়াম” দেখলে।

সিনেমার শুরুতেই পরিচয় হবে এক পরিবারের সাথে। পরিবারের সদস্য তিনজন। রাজ বাটরা(ইরফান খান), মিঠু বাটরা (সাবা কুমার) এবং তাদের একমাত্র মেয়ে পিয়া বাটরা (দিশিতা সেহগাল)। রাজ, চাদনী চকের এক ফ্যাশন হাউজের মালিক। বেশ বড়লোকই বলা চলে। রাজ এবং মিঠুর একমাত্র মেয়ে পিয়া। মিঠু চায় তাকে দিল্লীর সেরা ৫টি স্কুলের মধ্যে যেকোনো একটিতে ভর্তি করাতে। রাজের এসব নিয়ে হেলদোল না থাকলেও স্ত্রী'র জোরজবরদস্তি তে সেও শামিল হয় তার সাথে। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার জন্যে তারা শুরু করে বিভিন্ন বিচিত্র কার্যকলাপ। মেয়েকে মডার্ন করার জন্যে নিজেদের লাইফ-স্টাইল চেঞ্জ করতে শহরের এক অভিজাত অংশে ফ্ল্যাট নেয়। মেয়েকে হিন্দী বলতে নিষেধ করে, ইংরেজী বলার অভ্যাস করায়। মেয়েকে ভালো একটি স্কুলে ভর্তি হতেই হবে, এজন্যে দুজনেই উঠেপড়ে লাগে, “আদাজল খেয়ে লাগা” যাকে বলে সেরকম প্রচেষ্টা শুরু হয়। টাকাপয়সা ঘুষ দেয়া, রাজনৈতিক নেতার সাহায্য নেয়া, তৃতীয়পক্ষের কোনো জালিয়াতের সাহায্য নেয়া, জালিয়াতি, ধোঁকাবাজি... সবকিছুই তারা করে। যেভাবেই হোক, মেয়েকে দিল্লীর সেরা স্কুলে ভর্তি হতেই হবে। নাহলে, প্রেস্টিজ আর থাকেনা।

এভাবেই কাহিনী এগোয়। সিনেমায় বিভিন্ন, বিচিত্র মোড় আসে, শ্যামপ্রকাশের মত কিছু চরিত্র আসে আকস্মিকভাবে। কিছু সাসপেন্স আসে, আসে কিছু সংকট। সিনেমা অন্তিম পরিণতির দিকে যায় ধীরে ধীরে। কিছু গভীর উপলব্ধিও ক্রমশ উন্মোচিত হয়।

প্রথমেই কথা বলা যাক সিনেমার কাহিনী নিয়ে। কাহিনী যে খুব অসাধারণ না, তা বলাই বাহুল্য। খুব একটা আহামরি কিছু না হলেও কাহিনীর উপস্থাপন দারুণ ছিলো, ছিমছাম ছিলো। হিউমার-সারকাজম-সিরিয়াসনেস পুরোমাত্রাতেই, স্তরে স্তরে ছিলো সিনেমায়। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই হাস্যরসগুলোকে সস্তা মনে হয়নি, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর মত মনে হয়নি। সিনেমার মূল গল্পের সাথে প্রাসঙ্গিকই ছিলো সবকিছু। তবে, হিন্দী সিনেমা তো, একেবারে নির্ভুল হয়নি সব। কয়েকটা প্লটহোল অবশ্য ছিলো। সেগুলো সিনেমা দেখলেই বোঝা যাবে। তাই, বলছিনা।

এবার ইরফান খানের প্রসঙ্গে আসা যাক। বলিউডে তিন খানের সঙ্গে এ খানের নাম কোনোদিন উচ্চারিত হয়নি, হবেও না। তাঁর সিনেমা কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেনা, তাঁর সিক্স প্যাক অ্যাব নেই, পেশিবহুল দেহ নেই, চেহারাও অতটা চকচকে না... কিন্তু অভিনয়ে বাকি তিন খানের চেয়ে কোনো অংশেই সে কম না। বলিউড তাকে কতটা মূল্যায়ন করে, কীভাবে মূল্যায়ন করে, সেটা জানা নেই অবশ্য। কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে তিনি একজন।“দ্য লাঞ্চবক্স” এ খিটখিটে সরকারী কর্মচারী বা “মাদারী”তে ছেলেহারা আধপাগল বাবা অথবা “হিন্দী মিডিয়াম” এ ভুলভাল ইংরেজি বলা ব্যবসায়ী...ইরফান খান বরাবর নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দী। বলিউডের অন্যতম “পারিশ্রমিক প্রাপ্ত” অভিনেতা না হলেও বলিউডের অন্যতম “পরিশ্রমী” অভিনেতাদের মধ্যে তাঁর স্থান প্রথম সারিতেই।

আজকাল তো হলিউডেও নিয়মিত দেখা যায় তাকে। লাইফ অব পাই, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড অথবা হালের “ইনফার্নো” সবখানেই ইরফান খানের সরব উপস্থিতি। কিছুদিন পরে বাংলাদেশের “ডুব” সিনেমায়ও দেখা যাবে তাকে। ইরফান খান’কে নিয়ে বড় করে পরবর্তীতে কিছু লেখা যাবে, আজকের মত তাঁর প্রশংসা মুলতবি রইলো এখানেই।

এ সিনেমায় ইরফান খান বরাবরের মতই অসাধারণ ছিলেন। এই এক অভিনেতা, যাকে সব চরিত্রেই মানায়। সব তরকারিতে যেমন আলু দেয়া যায়, ইরফান খানও তেমন। নিজের অনবদ্য ক্ষমতাতেই সব চরিত্রে সাবলীল খাপ খাওয়াতে পারেন তিনি। তিনি ছাড়া বাকিদের অভিনয়ও ভালো ছিলো। পাকিস্তানি মেয়ে সাবা কুমার ভালো করেছেন। প্রাচী দেশাইয়ের চেহারার সাথে কিছুটা মিল আছে তার , গুলিয়ে ফেলেছিলাম প্রথমে। বাকিদের অভিনয়ও ভালো। “শ্যামপ্রকাশ” চরিত্রে অভিনয় করা দীপক দোব্রিয়ালের অভিনয়ও ভালো লেগেছে।

সিনেমার শেষদিকে ইরফান খানের মুখে “Today, I speak English. English, English & Kewal (কেবল) English. Because, India Is English, English Is India” ডায়লগটা ভালো লেগেছে।

আজকাল, লেখাপড়া শুধু লেখাপড়াতেই আটকে নেই। লেখাপড়ার সাথে আজকাল সামাজিক মর্যাদা, ব্যবসা, আত্মসম্মান এগুলো জড়িয়ে গেছে গাছের শেকড়ের মতন, আষ্টেপৃষ্ঠে-ওতপ্রোতভাবে। যে বাচ্চাটা “জীবন” কী সেটা বুঝতেই শিখলোনা ভালোভাবে, তাকে বাবা-মা খুব অল্পবয়সেই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত কিছু জটিল সমীকরণের সামনে, কিছু বুঝতে শেখার আগেই তাকে রূঢ় প্রতিযোগিতার অংশ করে দিচ্ছে অভিভাবকেরা। আজকাল এগুলোই ট্রেন্ড, ফ্যাশন, স্ট্যাটাস!

বাংলাদেশেও এগুলো বেড়েছে খুব দ্রুত। লাগাম ছিঁড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে হু হু করে। সমাজের হাইক্লাসের লোকজন তাদের ছেলেমেয়েকে আজকাল সরকারী স্কুলে পড়ায় না, বাংলা মিডিয়ামে পড়ায় না। ওগুলোতে ঠিক জাত বাঁচেনা। একজন ফ্রেঞ্চ বা একজন জার্মান যদি ভুল ইংরেজী বলে, আমাদের সমস্যা হয় না। কিন্তু, একজন বাঙ্গালী বা ভারতীয় যদি ভুল ইংরেজী বলে, তাহলেও তার মুণ্ডুপাত শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গে। আগে জানতাম, মানুষের জন্যে ভাষা, এখন চারপাশে দেখি, ভাষার জন্যেই মানুষ। অতুলপ্রসাদের “আমরি বাংলা ভাষা” আজকাল আর ধোপে টেকে না, বড় বেশি ব্যাকডেটেড।

এ প্রসঙ্গে একটা কবিতা পড়েছিলাম। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের "ককটেল" নামক সে কবিতার কিছু অংশ এখানে দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছিঃ

ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।

‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানে দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।

বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনও ‘চার্ম’ বেঙ্গলিতে
সহজ-সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে?
ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক
হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক
বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওর ‘প্লেস’ এদের পাশে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না...

অনেক জ্ঞান বিতরণ হলো। এবার ইস্তফা দিই।
এ সিনেমা দেখলে দেখতে পারেন, না দেখলে নাই। এ সিনেমায় সিস্টেমের চেঞ্জ হবেনা মোটেও। যারা "ইংরেজি মিডিয়ামে বাচ্চা না পড়লে আমাদের জাত চলে যাবে" ভাবে, তাদের ১৩০ মিনিটের একটি সিনেমার মাধ্যমে সংশোধন করা যাবেনা, সম্ভবও না। তবুও একজন পরিচালক যে বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, এবং সুন্দর একটি সিনেমা বানিয়েছেন, সেজন্যে তাকে ধন্যবাদ দেয়া অবশ্যকর্তব্য। “সিনেমা” শুধু যে নায়ক-নায়িকার প্রেম আর ভিলেনের বাগড়া না, “সিনেমা”র ক্ষেত্র যে আরো বড়, “হিন্দী মিডিয়াম” দেখলে সে আদি সত্যটা হয়তো আরো কয়েকজন নতুনভাবে উপলব্ধি করবেন।

আপাতত, এটুকুই সান্ত্বনা।

সাধারণ জ্ঞানঃ
------------------------

Movie: Hindi Medium
Director: Saket Chaudhary
Cast: Irrfan Khan, Saba Qamar, Neha Dhupia...
Release: May 19, 2017
Genre: Comedy, Drama
IMDB: 8.1/10

#Happy_Freaking

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৭ রাত ১২:০৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×