মাহবুব মোর্শেদের ব্যক্তিগত বসন্তদিনের গল্প বনসাই শিল্প। সেই গল্পেরও শুরু রবিবারে। গল্পের স্থান কোন এক মফস্বল শহর। আর ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ঘটনাবলি সংঘটনের স্থান ঢাকা শহর। কোন এক রবিবারে শুভ, যিনি গল্পের নায়ক চরিত্র, তার মোবাইলে পুরোনো বন্ধু মারুফের ফোন আসে তিনবার। মারুফ থাকে মফস্বলে, শুভ ঢাকায়। মারুফ আর শুভ একই বয়েসি হলেও আলাদা সময়ে বাস করে। ব্যক্তিগত বসন্ত দিন আর ফেস বাই ফেস একই লেখকের কিন্তু পরিষ্কারভাবে আলাদা সময়ের-আঙ্গিকের। ফেস বাই ফেসের পাঠক মারুফের ফোনের সূত্র ধরে ফেসবুকে প্রবেশ করে। আর ফেসবুক নিয়েই বাংলা ভাষার প্রথম কোন উপন্যাস লিখেছেন মাহবুব মোর্শেদ। পুরো উপন্যাসের আদলটাই ফেসবুকের মত। মুখের পর মুখ-একের পর এক চরিত্র, ঘটনা। নতুন কোন চরিত্র আসে আর তার প্রোফাইল বর্ণনা করে যান লেখক। কোন চরিত্রই অবহেলিত নয়, অসম্পূর্ণ নয়। সবাই নাগরিক এমনকি ইউএসএ-তে থাকে যে নজিয়া সেও নাগরিক। নাজিয়ার বন্ধু শেরির আন্তর্জালিক বন্ধু বৃদ্ধা মারিয়াও আসলে আমাদের ঢাকা শহরেরই কোন এক নিঃসঙ্গ নারী। সব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস একটি নাগরিক উপন্যাস।
শুভ তার বন্ধু মারুফের ফোন ধরতে পারে না । কারণ অফিস ধরবার তাড়া-গাড়ি-জ্যাম এইসব। একটা বায়িং হাউজে কাজ করার সুবাদে তাকে সারাদিন অনলাইনেই থাকতে হয়। আর অনলাইন মানেই ফেসবুক। মারুফ তার অন্যান্য বন্ধুদের খবর জানতে চায় শুভর কাছে। তখনই শুভ ফেসবুকের প্রসঙ্গ আনে। আর এই ফেসবুকের চরিত্ররাই বিচরণ করে বেড়ায় উপন্যাসময়। ঠিক অপর জগত নয় বাস্তব জগতেরই প্রতিরূপ, মানবিক সম্পর্কের নতুন প্ল্যাটফর্ম, যোগাযোগের মাধ্যম। ঢাকা শহরের অসহায়ত্বই হয়তো এই ফেসবুক। কিন্তু এরও শেষ আছে। লেখক নিজেই বলেছেন, যন্ত্র মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে আতিক্রম করতে পারে না। এক সময়ে মাইস্পেস, হাই ফাইভের যুগ ছিল। এখন ফেসবুক। এরপর হয়তো ফেসবুকও থাকবে না। মানুষই নতুন করে আবার কোন নাগরিক যোগাযোগের উপায় খুঁজে বের করবে। এবং মাহবুব মোর্শেদের গুণে ফেসবুকও মানবিক হয়ে ওঠে। অসংখ্য চরিত্র আসে সেখানে-শুভর সাথে তাদের আলাপ হয়, দেখা হয়। আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়। ফেস বাই ফেসের অন্যতম সফলতা হচ্ছে উপন্যাসটি জীবন বিচ্ছিন্ন থাকেনি। শুভ মধ্যবিত্ত এবং শুভ পুরুষ। শুভ একইসাথে ভালো এবং প্রতারক। শুভ ভিতু এবং বোকা। আবার কাম কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে সে সাহসী আর লোভী। শুভ প্রেমিক এবং কামুক। তার চারপাশের অসংখ্য নারীদের নানা বৈচিত্রে সে অবাক হয়। অসহায় বোধ করে। তিন্নি তার অনেকদিনের বন্ধু কিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে না। লেখকও পাঠকের সামনে তিন্নিকে ব্যাখ্যা করেন না। শুভকে কেন্দ্র করে পাঠক আবর্তিত হয়, চরিত্র থেকে চরিত্রে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পরিচয় হয় নওরোজ ভাই আর রওনক ভাবীর সাথে। সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সাথে। শাং-রি-লা বিষয়ে রওনক ভাবীর আগ্রহ পাঠকের মনেও ভর করে। রওনক ভাবী খাপখোলা তলোয়ার- সময়ের জং তার গায়ে লাগে না। তার স্বামী নওরোজ এখানে সেখানে অনেক নারীর সাথে ঘুরে বেড়ান। স্বামীকে উৎসাহ দিয়ে যান রওনক। কিন্তু তার ভেতরেও যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, অবদমন ছিল। শুভর সাথে বক পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ঘটনায় তা উন্মোচিত হয়। সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সন্তান নাই-গাছপালা পালেন তিনি। জীবন সাহার অষ্ট্রেলিয়ান বান্ধবী মাধবী, সে পঙ্গু, ভাইয়ের সাথে থাকে অষ্ট্রেলিয়াতে। জীবনের সাথে তার ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। একটা সম্পর্ক কতোটা মানবিক হতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণ। তাদের মিছামিছি বিয়ে হয়। হুইল চেয়ারে বসে থাকা মাধবীর করুণ আকুতি- ''তুমি হাঁটু গেড়ে বসে আছো সামনে। আমাকে ধরে আছো। আমার জন্য কি তোমার ভালোবাসা জাগছে? নাকি খুব করুণা হচ্ছে? আমাকে কি অর্ধেক মানুষ বলে মনে হচ্ছে? তুমি আমার পা। তুমি আমাকে তোমার পা দিয়ে বিশ্ব ঘোরাও''। এই অনন্য সম্পর্কটুকু নির্মাণের জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
এই বক পাহাড় আসলে বানানো। সাভারের রাজাসনে এমন কোন জায়গা নেই। তাহলে কেন লেখক এমন একটা বক পাহাড় পাঠকের সামনে হাজির করেন। এই ঘটনা আরো একবার দেখি আমরা। শুভর খন্ডকালীন প্রেমিকা সুপর্ণার সাথে কল্পনায় উটের কাফেলায় সওয়ার হয়ে পিংক সিটিতে যায় । তাদের অভিসারের বর্ণনাকে মিথ্যা মনে হয় না। এটা লেখকের সফলতা। মরুভূমির বর্ণনা এবং চন্দ্রমুখী সেই অভিযানে বিহ্বলতা আছে, ঘোর আছে। এই ঘোর থেকেই হয়তো বক পাহাড়ের জন্ম হয়। শাং-রি-লা এমন এক জায়গা যেখানে চীরযৌবন পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক খুঁজেও কয়েকটা হোটেল ছাড়া সারা দুনিয়ায় এমন কোন জায়গা খুঁজে যাওয়া যায় না। চীরযৌবন আর মোক্ষ লাভের তাড়নাতেই হয়তো বক পাহাড়ের আবির্ভাব। রওনকও তাই বলে, এটাই তাদের শাং-রি-লা। শুভ নিজেও জানতো না এমন কোন জায়গা রাজাসনে আছে কি না। তার আরেক ফেসবুক ফ্রেন্ড নোমান তাকে জানায় এমন একটা স্থানের কথা। শুভ বিশ্বাস করে। শুভ এমন অনেক কিছুই বিশ্বাস করে। আবার অবিশ্বাসের দোলাচালে দোলে। এটাই মধ্যবিত্তের চরিত্র। ভালোভাবেই মধ্যবিত্তকে পাওয়া যায় ফেস বাই ফেস উপন্যাসে। শাং-রি-লা আসলে মধ্যবিত্তের অপ্রাপ্তি, দিবাস্বপ্ন।
মধ্যবিত্তের জীবন ক্রমশ মুক্তি চায়। কিন্তু তার মুক্তির পথ বিদ্রোহের নয়, আপোষের। সাবিনা মেহনাজ সুপ্তি শুভকে সেই পথই বাতলে দেন, মোক্ষ লাভের কথা বলেন- '' কিন্তু মোক্ষ সম্ভব। ডোন্ট ট্রাই টু গেট আউট, স্টে হিয়ার। এ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবন যাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকে। শত শত মানুষের বাঁচাকে সম্ভব করে তুলেছে এই রুটিনই তো। আপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? সেটা কি সম্ভব? আপনি বরং মোক্ষ খোঁজেন।'' শুভ সেই মোক্ষই খুঁজে বেড়ায়। পারে না। কখনো তিন্নি কখনো সুপর্ণা, নাজিয়া, রূপা, রওনক তাকে আঁকড়ে ধরে। মোক্ষ লাভের আশায় বক পাহাড়ে গিয়ে পুরুষ বের হয়ে আসে শুভর ভেতর থেকে। মোক্ষ লাভের কথা আর মনে হয় না। তার পৌরুষ রওনকের সরলতায় বিভ্রান্ত হয়। রিনা কাওসারিও মধ্যবিত্ত শুভর পৌরুষকে নগ্ন করে দেন। রিনার কাছে তার পিরিয়ডের বর্ণনা শুনেও বিভ্রান্ত হয় শুভ। ফেসবুকের আড়ালে সে নারী না পুরুষ তা বুঝতে পারে না। তার বোধদয় ঘটে- ''পিরিয়ডের সময় ছেলেরা নাকি অদ্ভূত এক নীরবতা আর শত প্রশ্ন নিয়ে সঙ্গীনীকে পর্যবেক্ষণ করে। কিন্তু কখনো জানতে চায় না, মেয়টির কেমন লাগে। কেন তার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যেতে থাকে।''
এমনিভাবে একের পর এক চরিত্র আসে। যারা আসলে এই সমাজেরই নাগরিক মানুষ। যেমন মুন্না, শুভ ভাইকে যে ভালা পায়। জীবন, যে শুভকে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেয়। হস্তবিশারদ ফয়সাল ভাই। নাজিয়ার সূত্র ধরে শেরি, বৃদ্ধা মারিয়া। এমন অনেক চরিত্র ফেসবুকের মতোই উপন্যাসময় ঘোরাফেরা করে। তাদের সাথে পরিচয় ঘটে শুভর। শুভর স্বগতোক্তি- '' একেকটা মানুষ যেন একেকটা জনপদ। কত ঘটনা যে তাকে কেন্দ্র করে ঘটে। এককথায় বোঝার উপায় নেই। পরিচয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ একেকটা ইতিহাস বলতে থাকে।'' শুভ এমন অনেক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়। আর যে ইতিহাসের প্রতি তার প্রধাণ ঝোঁক এবং যে ইতিহাস রহস্যময়ী, যাকে বুঝতে, যার সন্ধাণে সে এর কাছে তার কাছে ধরণা দিয়েছে- সে হল তিন্নি। তাদের মধ্যকার অনেকদিনের বন্ধুত্ব এখন একটা পরিণতি চায়, তা আসলে আরো ঘনিষ্ট এবং স্থায়ী হতে চায়। শুভ প্রেম করতে চায় তিন্নির সাথে। কিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে না। সুপর্ণার সাথে শুভর সাময়িক প্রেমের ইতি ঘটে তিন্নির কারণেই। সুপর্ণার বেদনা, শুভর অসহায়ত্ব সমস্তই মার খায় তিন্নির কাছে। তিন্নিকে শত চেষ্টাতেও উপেক্ষা করতে পারে না শুভ। সুপর্ণার প্রতি সাময়িক প্রেমের সম্পর্কও আসলে তিন্নিকে না পাওয়ার শুণ্যস্থান পূরণের চেষ্টা। সুপ্তির এই ব্যাখ্যাও শুভ বিশ্বাস করে। কিন্তু তিন্নিকে তার পাওয়া হয় না। এড়াতেও পারে না তাকে। এই যে ঝুলে থাকার জীবন মধ্যবিত্তের, তিন্নির ঘটনা শুভকে কেবলই হাস্যকর করে তোলে। সুপর্ণার সাথে মিথ্যা শারীরিক সম্পর্কের কথা বলে শুভকে পরীক্ষা করে তিন্নি। প্রথমে ভয় পায় শুভ। কিন্তু সে উপায়হীন। তিন্নিতে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা যেন। এমন অনেক মিথ্যা বয়ানকে বিশ্বাস করেও সে তিন্নির কাছেই ফিরে যায়। তিন্নিকে সে শরীরেও চায়। তিন্নির শরীর নিয়েও তার কামনা জাগে বারবার। একদিন ঘন ঘোর লাগা জ্বর আসে তার যখন পাশে আসে তিন্নি। মধ্যবিত্ত আসলে তার প্রাপ্তিকেও মেনে নিতে পারে না।
কোন নিম্নবিত্ত চরিত্র নেই এই উপন্যাসে। আরো হয়তো সমালোচনা করা যেত সময় সুযোগ থাকলে। তেমনি সময়ের অভাবে ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ভাষা নিয়ে আলাদা প্রসংশাটুকুও করা যাচ্ছে না। নাগরিক মেজাজ ধরে রাখার কাজটা ভালোই হয়েছে। আরো অনেক বিষয় বলা হল না। সব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস। সফলতা ব্যর্থতা এখনি বা হয়তো কখনোই বিবেচ্য নয়। তবে সুখপাঠ্য আর ঝরঝরে একটা গতিশীল লেখা পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবে। শহুরে মাঘ পেরিয়েও শীত না আসুক, বন্ধু আসে। মোক্ষ লাভের আলাপ আসে, শাং-রি-লার ডাক আসে। এই উপন্যাসে ঘাম আছে, সেন্ডোগেঞ্জি আছে। এমন অনেক কিছু নিয়েই তৈরি ফেস বাই ফেস, মাহবুব মোর্শেদের নতুন ধারার লিখা। তার কবিভাবও জিইয়ে রেখেছনে তিনি। এই উপন্যাসের একটা অন্যরকম স্বাদ আছে- গরম চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খাবার স্বাদটা যেমন হয়। গদ্য এবং কাব্যের মিশেলে ফেস বাই ফেস পাঠকের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৪৮