মা কথাগুলো পুটলিতে বেঁধে রাখতেন। কড়াইয়ের গরম তেলে কচিকচি বোধ বিধ্বস্ত হতে দেখে "বেহেশত মেজো ফুফুর বাড়ির চাইতে অনেক দূর" - বলেই বেঁচে যেতেন। ডাংগুলির বরইদানা খালি লক্ষচ্যুত হতো এবং আমাদের পুকুরে শাপলায় আমার ঢিলগুলো পড়তো না। পানির ভেতর পাড়ের গাছের ছায়া অজগর হয়ে যেতো। পানি দ্রুত নাড়ালে গোখরা হতো। গায়ের হোসিয়ারি বস্তুটির কাঁধ বন্ধনী ছিঁড়ে ফেললেও আমার প্রশ্নে কারো মন বসতো না। বাবার আয়না দেখার মাঝে টুপির সঠিক বসা না বসা আর কপালের কালোদাগে হাতবোলানো ছাড়া অন্য কিছু ছিলো না, এমনকি আমার মায়ের প্রেমও না। প্রশ্নে সাহস হতো না। বাবাকে তাই বোকা বোকা মনে হতো। তাঁর চেহারাটাও একটু সরল সিদা ধরনের। একেবারে আমাদের অলস বিড়ালটির মতো।
আমার লম্বা চুলের ভেতর বেত ঢুকিয়ে অমৃত স্যার যখন ঘুরাতেন তখন আমি ক্রমশ: স্যারের বুকের দিকে চলে যেতাম। আমাকে বলতেন "সুমন মিয়া"। আমিও জানতাম "মিয়া" খুব সম্ভ্রান্ত বিষয়। যদিও এখন কেমন জানি গোবেচারা ধরনের মনে হয়। পেটের চামড়া ধরে খুব টানা হেঁচড়া করতেন। স্যারের ধরার সুবিধার্থেই বোধহয় প্রচুর ফ্যাটফুড খেয়েও চামড়া মোটা হয়নি। এক স্কুলের দু'আড়াই'শ ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে প্রতিদিনই কোন না কোন ভাবে মনে রাখার মতো কিছু একটা করতেন অমৃত লাল ঘোষ। মায়ের ভাত মাখানো হাত চেটে খাওয়ার বিষয়টি আমার প্রিয় হওয়ার পরেই স্যারও আমার খুব প্রিয় ছিলেন। প্রিয় বলতে তেমন কিছু বুঝতামই না তখন। শুধু স্যার কখনো স্কুলে না এলে দল বেঁধে স্যারের বাড়ি চলে যেতাম।
শীতকালটা খুব ভালো যেতো। স্যারের বাড়ি আমাদের বাড়ির পেছনে বলে প্রতিদিন বিকালে একসাথে রোদ পোহাতাম। তখনো আমাকে একদিন নামতা মুখস্ত করার সহজ পদ্দতি শিখিয়েছিলেন। আবার সুন্দর করে ডালের নামতা বলতেন, ডাল ১-এ ডাল, ডাল ২গুনে খেসারী, ৩ ডালে মসুরী...... এমন সুন্দর করে...।
সন্ধ্যায় হাত পা ধুয়ে এসে ঝিকির করা ছিলো বাধ্যতামূলক। নইলে দোযখে যাওয়ার ভয় দেখাতো মা। আর ঝিকির করলে বেহেশ্তে যাওয়ার লোভ। আমি সুযোগ পেলেই মায়ের সাথে স্যারের কথা বলতাম। মাকে একদিন বললাম " আমি বেহেশতে গেলে শীতকালের বিকেলটা স্যারের সাথে রোদ পোহাতে চলে যাবো"। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন "কিন্তু বাবা, ওনিতো কখনোই বেহেশ্তে যাবেন না, হিন্দুরা কখনোই বেহেশ্তে যান না"। আমার আর ঝিকির করা হয় না। মনের ভেতর খালি প্রশ্ন-"স্যার কেন বেহেশ্তে যাবেন না?"। মা আরো বললেন, "মুসলমানরা একদিন না একদিন বেহেশ্তে যাবেনই"। ভাবনা এবার খুব জটিল মনে হলো- সিনেমার ভিলেন রাজীব, ফরিদী, এটিএম শামছুজ্জামানরা এতো খারাপ হয়েও বেহেশ্তে যাবে, গ্রামের ছাদু মেম্বার, বাচ্চু মেম্বাররা বাজারে মানুষের মাথা ফাটিয়েও বেহেশ্তে যাবে অথচ অমৃত স্যার বেহেশ্তে যাবেন না!!
আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। মাকে বললাম " আমাকে বলো বেহেশ্তটা কোথায়? আমি গিয়ে দেখে আসবো কোন হিন্দু বেহেশতে আছেন কিনা।" বেহেশ্ত অনেক দূরে বলে বলে মা আমাকে নিভৃত করে রাখতে চাইতেন। কতদূর? জিজ্ঞেস করতেই বলতেন "বেহেশ্ত তোর মেজো ফুফুর বাড়ির চাইতেও অনেক দূর।" ফুফুর বাড়ি অনেকদূর বলে জীবনে প্রথমবার যাবার পর আমাকে আমাকে আর সে বাড়িতে নিতে পারেনি। ওই বাড়ির চাইতেও বেহেশ্ত অনেক দূরে বলে আমি চুপসে গেছিলাম।
আসলে বেহেশ্ত কতদূর??
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১২ রাত ২:০২