এই একটা ঘরের দিকে তাকিয়ে অভিশাপ দিয়ে গ্রামের বুড়োরা বেদম তৃপ্তিবোধ করেন। ভাবেন, ইশ্বর স্বয়ং তাদের নির্দেশ দিলেন এভাবে অভিশাপ দিতে। অবশ্য ওঘর পর্যন্ত যাওয়ার মতো হাঁটুর জোর তাদের নেই; মনের জোরতো নয়ই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দাজ করে করে পাশের মানুষকে দেখাতে থাকেন- ওইটা বোধ হয় সওদাগরের ছেলে, আরেকটা জহর সাহার, মেম্বারের পোলারেও দেখা যায়।
রাস্তায় দাড়িয়ে যে পথে তাসঘর দেখা যায়, সে পথ দিয়ে ওইঘরে যাওয়া যায় না। একটা খাল, বিএসসিদের পুকুর পাড়, ভুঁইয়া বাড়ির পুরোনো দেয়ালের পর বড় একটা চালতাবাগান পেরিয়ে ফুলচন্দনের দেশে পাড়ি দিতে হয়। তবুও যতো স্বাচ্ছন্দ্যে সারেং বাড়ির চালতাবাগান পেরিয়ে আমাদের তাসঘরের দরোজায় পা রাখা যেতো, এখন ততো স্বাচ্ছন্দ্যে বর্ষা আসে না। তার আগে প্রচুর খোলারোদ দু'চোখে ধারণ করতে হয়; অনেক মেঘ মাথায় তুলতে হয়। এসবের আগে প্রত্যাশিত বৃষ্টি অতোটা সুন্দর নয়, সর্বশেষ প্রবাল স্পর্শের আগে প্রেয়সীর চুম্বন অত সুখকর নয়।
সাধুপুকুরের পাড়ে বসে ঘাঁটে জমা রূপ চুরি করা একেকটি দুপুর সারেংবাড়ির বৌ'দের সৌন্দর্যে একটুও ভাটা ফেলেনি। বরঙ সে রূপ গিয়ে হামলে পড়তো যতীনের কবিতার খাতায়, সুবোধের তুলির আগায়। যতোক্ষণ এ দুজনের চোখে ওই বাড়ির মেজো বৌ জড়িয়ে থাকতো ততক্ষন স্বামীর অত্যাচার স্পর্শ করতে পারতো না। এক অমবশ্যায় গাঁজা নেয়ার পর সুবোধকে ফেরানো খুব কঠিন হলো। মেজো বৌয়ের জানালা পর্যন্ত শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেলো! ও ব্যাটার ঘর আর করতে দিবে না। তবুও চাইলেইতো আর একটি নিশ্চিত সূর্যাস্ত থামিয়ে দেয়া যায় না।
অনেক পরে এসব দঙ্গল জঙ্গল কেটে পথ নির্মাণ করা হয়। পথের যে পাশে আমাদের তাসঘর, প্রচুর ঘাস আর ছোট গাছের জঙ্গল বানিয়ে পথচারীদের দৃষ্টির আড়ালে রাখি। যেসব মানুষ এ পথে বাণিজ্যে যেতো আমাদের কবিতায় যাত্রা বিরতি নিতো না, কখনোই বিশ্রামে যেতে দেখিনি। ছোট ছোট ক'টা দোকানকে আমরা হাট বলতে ভালোবাসতাম। ওটা সারেংবাড়ির সৌজন্যে। অনেক বড় বাড়ি। এখনো বর্ষায় এসব হাঁটে রমরমা বিড়ির ব্যবসা । আর একটা উড়োজাহাজের রানওয়ে করে নিলে এ অল্প একটু জায়গায় গমনাগমনের সব পথের সহাবস্থান থাকতো। এটা বিরক্তিকর। আগে যে খাল ছিলো তাই যথার্থ ছিলো। বিড়ির সাথে জল, নৌকা আর গানের সম্পর্কটা জোশ। তখন আমরা নৌকায় করে স্বর্গে যেতাম। পথে নৌকা থামিয়ে বিড়ি কিনে আবার নৌকা ছুটাতাম। কালো পানির সমান দুভাগে ভাগ হওয়ার স্বাক্ষী এসব বিড়ি ক্রেতারা। যতীন আর সুবোধের চোখে তাসঘরের এগিয়ে আসা লিপিবদ্ধ হতো। এক নৌকা যতোটা গতি ধরতে পারে তার চাইতেও সুন্দর তাসঘরের এগিয়ে আসা।
সেখানে বেশ্যা নিয়ে কথা হতো, স্থুল দেহ আর বিধ্বস্ত স্বপ্ন নিয়ে আপসোস হতো। প্রেয়সী সংক্রান্ত আলাপচারিতায় সাঙ্গরা মনোযোগী হতো না। এখন প্রেয়সী বুকের কেশ নিয়ে তুলনা করতে শিখেছে। পলিথিনে মোড়া বিড়ির ধোঁয়ায় এসব বাজে আলাপ হার মানতো। ব্যতিক্রম কেবল যতীন। ইশ্বরকে একবার নামিয়ে না আনলে তার যাওয়া হবে না। প্রতি রাতেই স্বর্গ ত্যাগের আগে একবার ইশ্বরের সাথে কথা বলে তবেই যতীন হাঁটবে। আমরা তাকে পাগল বলতাম; তার ঘনিষ্ঠ সুবোধও।
যতীন কবিতা লিখতো নিজের জন্য। প্রেয়সী বলতে সারেং বাড়ির মেজো বৌ। যদিও তা সুবোধ এবং মেজো বৌ জানে না। কেবল তখন, যখন বিরহে ভুগতো- কবিতাকে গানের মতো করে গাইতে পারতো যতীন। যেবার কবিতাকে গান বানিয়ে এক পথিক পানি খুঁজেছিলো- তার পায়ের ধুলো দেয়ালে টাঙানো... এখনো।
সেবারের গলাপানির বন্যার পর ভেসে গেলো তাস, ঘরের চাল আর মাত্র ৬টা খুঁটি। ভিটের বুকে থোক থোক গর্ত দেখে সুবোধ বুক চাপড়েছিলো বন্যার পর। এ বিপর্যয় নিয়ে যতীন কোন কবিতা লিখতে রাজি হয়নি। বাজারের সবচে' ছোট চা'দোকানে মন খারাপের প্রতিযোগিতা দিতাম। একটা মদের দোকান দেয়ার কথা আলোচনায় এলেও গ্রামে আরো একবার ছাগলের মড়ক লাগলে তা আর হয়নি। নাছোড়বান্দা যতীন সুবোধকে নিয়ে আবারো ঘর উঠালো করিম সারেঙের বিরানভূমিতে। আমি আর সুফল তখন গ্রামের সবচে' লম্বা তালগাছের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে এগুতাম। এবং উভয়েই রান্নায় সময় মায়ের পাশে বসে গল্প করতাম। আমাদের এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখে গ্রামের বেশকিছু বুড়ো তাদের প্রার্থনার জয় হয়েছে বলে ঈশ্বরের সামনে নত হতো।
তারপর আমরা কিছু নারীকে কপালে ঠেলে সরাতে পারিনি। তাদেরকে নিয়ে নদীর ধারে শরৎ উপভোগ এবং রাত দুপুরে জ্যোৎস্না বিহারে যেতাম। আমরা কবিতা লিখতে চেষ্টা করে সফল হলে বিকেলে ওইসব নারীদের নিয়ে বানানো গানে সুর বসাতাম। ক্লান্তবোধ করলে মাঝরাতের আগেই তাদের বুকের পাশে ঘুম দিতাম এবং একসাথে সূর্যোদয় দেখতাম। যতীন আর সুবোধ আমাদের প্রতি কোন রাগ না দেখালেও কাজের ছু'তায় বড়শি নিয়ে চলে যেতো। তাদের ফিরে আসা কখনোই দেখিনি। খালি যেত থাকাই দেখতাম। তখন সবাই কেবল যেতে থাকতো। কেউই আসতো না। পরবর্তীতে রমনীদের প্রেমে তাসের ঘর ভাঙার দিনে সে সরল ঝড়ের বিষয়ে কেউ কাউকে দেষারোপ করিনি। সেসব রমনীরা মাতৃস্তন মেরামতে ব্যস্ত। তাদের জীবন অকাতরে ফাঁকি দিচ্ছে। এরকম বিপর্যয়ে আমরা ভেঙ্গে পড়তে অপারগ।
তাসঘর ছেড়ে আসার পর সেখানে ঈশ্বর পূর্ণ দখল নিয়েছেন। তিনি এখন সৌন্দর্য এবং সৌকুমার্য নিজ হাতে নিয়ন্ত্রন করেন। অনুমতিহীন দৃষ্টিতে আকাশ অথবা বাতাসের সুখ দেখা যায় না। প্রতিদিন একটা করে পৃথিবীর ব্যস্ততার আয়োজন করার পর ক্লান্ত হলে আমাদেরকে পরিবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য গ্রহণের পর নিজেকে একবার করে হত্যা করি। আমরা আমাদের স্বপ্ন বিনির্মাণের কথা নিয়মিত ভুলে থাকি।
দ্রষ্টব্য
ক'দিন আগে লেখা "তাসঘরে রেখে আসা একজোড়া চোখ" শিরোনামের লেখাটিকে অনেকেই একটা বড় আকারে দেখতে চেয়েছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণায় এ গল্পটি লিখলাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




