তারিখ মনে নেই, বারটা স্পষ্ট মনে আছে। দুপুরে একশ্রেণীর ধার্মিকরা অদ্ভুত পোশাকে ছড়িয়েছিলো গ্রামের বাজারময়। তারা বাড়ি ফিরছিলো। দুপুরে খাবে, অত:পর কেউ ঘুমোবে কেউ টেলিভিশনে সিনেমা দেখার প্রস্তুতি নিবে। আমার কোন প্রস্তুতি নেই। মা’র কাছে শুনলাম যে, আমার ভীষণ মন খারাপ। ছোটবোনকে কিসের ছলে যেন বলেছিলেন। তারপর বেরুলাম। বেরুনোর আর কোন অবজেক্টিভ ছিলো না। এটাই নির্ধারণ হয়েছিলো। আমারও অমত ছিলো না। অন্য কোন কাজও জরুরী ছিলো না সে সময়। গায়ে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জামা এবং খাদ্য কেনার মতো প্রচুর পয়সা ছিলো। অভাবও ছিলো বটে। মোছনেই বের হওয়া। একটি চেহারা খুঁজতে। আমার প্রিয়। এর উপরে কোন তুলনা নেই। শরীরটাকে তুলনা করতে পারি। জ্যোৎস্নার রঙতো রূপালী, তাই না? হ্যাঁ, একটি রূপালী সাপের শরীর। সাপ আমার খুব প্রিয়। আগে ছিলো না। সখী, আমার ফোলা গাল আর চিকনা ঘাঁড়ের সখী বলেছে, সাপ তার খুব প্রিয়। এখন আমারও। কিন্তু আমি যে চেহার কথা বলি, তা? তা কেমন? আরেকটা প্রিয় আছে। সখীর ঠোঁট। কিন্তু সখীতো প্রেয়সী নয়; ও ঠোঁট সখীর, আমার নয়। ওই মুহূর্তে আমি কেবল একলা রাস্তার। রাস্তা আমাকে কিনে নিয়েছিলো। আমাদের মুদী দোকানের কাস্টমারদের মতো। টাকা দিয়ে হাকীমপুরী জর্দা আর বিড়ি কেনার মতো। এ দু’টা আমার ভালো লাগে। মানুষ নেশা করে খায়।
অনেকদূর আসলাম। একটু পরেই নানার বাড়ি পেরুবো। এ বাড়ি পেরুনো একধরনের কষ্টের। চিনচিনে চিকনা কষ্ট। আমি দুপুরকে খুব অনুভব করি। অনেকটা গর্ভবতী মা’র মতো। গর্ভকালীণ সময়েই কেবল নারীকে বিনাশর্তে শ্রদ্ধা করা যায়। আমি করি, দুপুরকেও। মামাতো ভাইয়ের বৌ প্রথম দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজ হাতে ভাত খাইয়েছিলো। অনেক বড়ো, প্রায় আট বছরের। বেজায় সুন্দর। আরামদায়ক নজরবান্ধব সুন্দর। আর শেষ দুপুরে শাশুড়ীর গালমন্দ আর চুলটানা খেয়েছিলো। মাঝের দুপুরগুলোয় আমাকে চুমু খেতো। সে সময় পুকুরে ভাসমান বাদামগাছের গুঁড়ি আর মামাতো ভাইয়ের বৌ, এ দু’ই আমাকে সুখ দিতো। এ সময়ের মধ্যে কোন বর্ষা ছিলো না। কেবল রোদ আর কুয়াশা ছিলো। সে কুয়াশা কাটানোর মতো ফর্সা ছিলো। রোদের বান্ধবী, রোদ তাকে রাঙাতো। ছোট ছিলাম বলেই বোধ হয় রাঙা ভাবী বলে ডাকতাম। অনেকদিন পর সে বাড়ির আশপাশ মাড়াবো। যাবো না মোটেই। মন খারাপ হবে।
তারপরের তালগাছগুলোয় জিরান দিতাম। আগের কথা বলছি। এখনো সুবিধা পাবো। ঘনপাতার জ্যামে তাকালে দৃষ্টি বিভ্রম ঘটবে। হয়তো হারানো চেহারা দেখতো পাবো। হোক সে মিথ্যা। তবুও। হ্যাঁ, আমার ডায়েরীতে এমনই লেখা আছে। প্রচুর সাপ তাদের অন্ন খোঁজার কাজে আমার সাহায্য চাইলে পাশের গ্রামের মন্দিরের উৎসবের ঠিকানা দিই। সাপগুলো সাপের বর্ণের। রূপালী না। এরা বিপদজনক। আমাকে নিয়ে যেতে পারে। চিরতরে। মা বকবেন। যাওয়া যাবে না। একেবারেই না। কাজ পড়ে আছে। সময়ও আছে। আজ অনেক দেরিতে বিকেল হবে। সূর্যের সাথে দারুণ সম্পর্ক। ভালোবাসে খুব। ইদানিং আমাকে কেন্দ্র করেই তাপ দেয়। চেহারা উঁচু করে দিই। করুন এক গন্ধ নাকে আসে। গন্ধ নিতে মজা লাগে। যেমন কেরোসিন তেলের গন্ধ। একটা ডুব দিতে পারতাম যদি। কেরোসিন আবার পানীয় হিসেবে মোটেও সুস্বাদু নয়। বাজে বাজে সব ঢেকুর উঠে। একবার ঢেকুর দিতে গিয়ে বমি করেছিলাম।
জানি অনেকদূর আসা হলো। বাঁক গুনেছি। সর্বমোট ২৪ টা। ২৪ সংখ্যাটি মনে রাখা খুবই সহজ। এপ্রিলের ২৪। দারুন দিন। খুব সুন্দর এক মেয়ের জন্মদিন। সে আমাকে ভালোবাসতো। না বাসলে কি আমার জন্য কান্না করতো! একবার তাকে বললাম- তুই আমাকে ভালোবাসিস না। তারপর সে আমাকে কুত্তা বলেছে। মাগির পোলা, বা মাগি বেপারীও বলতে পারতো। ওই গালিগুলো তখনো তার বাবা মা ব্যবহার করতো না। সে শিখেনি। একা থাকি বলে আরেকবার পেঁচা বলে খোঁচা দিয়েছিলো। দলবদ্ধ থাকলে কি শুয়োর বলতো? শুয়োররাতো দলবদ্ধ থাকে। আসলেই আমার কোন বন্ধু ছিলো না। মানুষ আকৃতিগুলোর কথা বলছি। সে সময়ের আরো আগে ছিলো। আমার কবিতা লেখার বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম। আমাকে তেমন একটা ভালো জানতো না। তারা মজার ছিলো। দু:খ ছিলো না। আবার সুখও ছিলো না। তবে আমি কবি, এটা জানলে হয়তো আমার প্রতি যত্নবান হতো। কাকতালীয়ভাবে সবাই রবীন্দ্রনাথের তুমুল ভক্ত। নিশ্চয় আমাকেও ভক্তি করতো! কবি বলে কথা।
জানতাম বিকেল অনেক দেরি করবে। এভাবে আমি নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। হয়তো আগামি শতাব্দী আসতেও অনেক দেরি করবে। ভালোই। ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরো বাড়বে। নাটকের পর্ব আরো বাড়বে। আরো বাণিজ্য হবে। বিকেলের আগের বাণিজ্য নিশ্চিত তরল আর ব্যয়বীয় হয়। আমার সামনে তখন একটি দিঘী। পাড় জুড়ে বিচ্ছিন্ন সব ইতিহাস। আমি ছন্দ খুঁজে পাইনি। আরো অনেক দূর যেতে হবে। সবই তরল। খালি কিছু মাছভোজী পাখিজাতির ডানার ব্যয়বীয় শব্দ ছিলো। তাতে সুর ছিলো না। ভয় ছিলো। আমার মতো। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর পাশের রুমে যেতেও ভয় পেতাম। এটাকে কবর ভয় বলা যায়। তবে কবর দেখতে খুব সুন্দর। বুকটা কি সুন্দর উঁচা। অবশ্য নতুন কবর দেখলেই কেবল তাকাই। পুরাতন কবরে নাকি শেয়াল নামে। শেয়ালের গান খুব সুরেলা হলেও লেজটা ভালো লাগে না। কেমন কুটনীতিক কুটনীতিক ভাব। চরিত্র অত সুবিধার মনে হয় না।
এখনও আমার দায়িত্বের কথা ভুলিনি। এ কাজ একেবারেই জীবন ঘেঁষা। আগামিকালের সূর্য দেখার জন্য আমাকে আরো হাঁটতে হবে। অনেক দূর। প্রথম দেখা মানবস্তনের মতো দূর। মামাতো ভাইয়ের বৌ। সুখ দেখানোর কথা বলে তার ঘরের নয়টি রুমের সবগুলো ঘুরিয়ে আবার শোবার রুমে। কি জানি, হয়তো প্রথম দেখা স্তনের বাঁধাই খুব উন্নত ছিলো বলেই আমি উর্দ্ধগামী। তারও চারবছর পর দেখা প্রথম নাভী অতোটা গভীর ছিলো না বলেই হয়তো আমার ভালো নেশা হয় না। গতরাতের বোতলগুলো হালকা সবুজ রঙের ছিলো। মালও অরজিনাল। সবুজ, বোতল আর রঙীন পানি। এই তিন আমাকে অতো ভালো জানে না। নেশা হলো না। অনেক কবিতা হলো। কচি ডাবের মতো কবিতা। চামড়াসহ খেতে ভালো লাগে। রঙজল খাবার পর এই প্রথম নেশা কাটার পরও সকালে কবিতাগুলোকে চোশ্ত বলিছি। একটি অনির্ধারিত সকাল। সূর্য প্রেমের কারনেই। কতো তাড়াতাড়ি! আমার কবিতা লেখা শেষ।
এদিকে কোন শহর থাকার কথা নয়। আরো গভীর গ্রামে বিকেল যাপন করার ইচ্ছা ছিলো। প্রেমিকার চোখের নীলাভ সমুদ্র শেষবার সবুজাভ দেখেছি। সে চেহারা গ্রামেই আসবে। নিশ্চিত। তাহলে ভুল হলো কোথায়? বোধ হয় চৌরাস্তায় এসে খেই হারিয়েছি। আমার এমনই হয়। অনেক পথ বা কয়েক নারী দেখলেই আর আসল চেনা হয় না। ভাগ্য ভালো যে নিজেকে ভাগ বা কয়েক নিজ বানানো যায় না। নইলে ভালো চেনা আমিও অচেনা হয়ে যেতাম। অনেক ভুল হয়। প্রেমিকার দেখা পেলেও এখন ভুলই ভাববো। এমন হতেই পারে। ঘনতালপাতায় তার দেখা পেলে ঘনপাথরমেলায়ও পাওয়া যেতে পারে। নেবো না। সে কোমল, সে গ্রাম, সে সবুজ। আমি ক্লান্ত, ধীর, স্থির। শহর গতি, শহর ব্যস্ত, শহর কঠিন। মূল সড়কে নয়, বরঙ অলি গলি মাড়িয়ে শহরের শেষ প্রান্তে উঠবো। হবে না। অলি গলি মাড়ানো আর হবে না। এ শহর সুশীল। শহরে এক মত, এক পথ। কোন অলি নেই, গলি নেই।
এখানে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামে। এ আমার কষ্ট। কেউ আপন নয়। চেনা নয়, অচেনাও নয়। কারো কাছেই সুখ নেই। অনেক ঘাম আর হতাশার মাঝে নাকডুব সন্ধ্যা আমার। বাড়ি ফেরা মানুষ, গাড়ি, সরকারি অফিসের চাকর, যে কুকুর প্রথম শহরে এসেছে কেউই আমার উপস্থিতি সহ্য করছে না। তারাও সুখী নয়। প্রেমিকাকে নিয়ে পুচকা খাওয়া প্রেমিকের আগামিকাল আবার একত্র হওয়ার ইচ্ছা নেই। ডাস্টবিন ত্যাগী কুকুরের মুখে আইষ্টার অবিশ্বাস্য ওজন। সে ক্লান্ত। সে ভুলবে। এ পথে আর আসবে না প্রতিযোগী গণিকা। এ পথ, সেও চলে যাবে। আমিও তাদের মিছিলে। পুরো শরীর দিয়ে পা আলগাই। বুকের ভেতর খোলা বাতাসের মুখ। বিরতিহীন ঝড়। এ রাত, সে চেহারা, তুমুল দরকষাকষির দৃশ্যে আমি পণ্য হই, ক্রেতার ধমক হই আর বিক্রেতার মিথ্যা হই। শহরের হালচাল আর আমার অক্ষমতা, দুইয়ের মাঝে বিকশিত অংকে সুদ নেই, আসল নেই। প্রাপ্তি আর আশা আছে। দিগন্তে কতগুলো কবিতা আছে। অন্ধকার সব শব্দ, পঙতি আর তাদের অক্ষমতা; যারা কয়েকবার আকাশে উড়িয়েছিলো, ক্যাকটাস শরীরের ঘুম পাড়িয়ে চিনিয়েছে আমার পূর্বজন্ম। সে সময় আমি বৃক্ষ ছিলাম। এখনকার জীবাশ্ম। ধ্বংসের অবশেষ। কি করণীয়, সিদ্ধান্ত কি হবে? এসময় কি করতে হয়, জানি না। আমি কি শহর শেষ হবার আগেই শুয়ে পড়বো, নাকি কাতরে কাতরে উঠে যাবো সভ্যতার অপর পৃষ্ঠে? কোথায় আমি পরিচ্ছন্ন জামা পরে আরেকবার নষ্ট হতে পারবো, হাসবো আর হাসাবো?
ক্রমশ :
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




