নীল তোমার চিঠি; মা পাঠিয়েছে;
আমার মনের ঘরের ছাদ আজ নিস্তব্ধ; আর আমি স্তব্ধ; কফি হাউজটা আজ বিষঘর ঠেকছে পারছিনা আর দাড়াতে; পা টলছে চারপাশের পৃথিবীটা ঘুড়পাক খাচ্ছে; কি ঘূর্ণন সে গতির!! আমি ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছি হতাশার বেড়াজালে আজ কি পাবোনা; না আমাকে পেতেই হবে আমি বিশ্বসংসার কে টলতে দেখবো আবার; ঘুড়বো এই ঘুর্ণনের সাথে সাথে; আমাকে পেতেই হবে।
ফিশ মার্কেটের খুপরি ঘরের সামনে দাড়িয়ে আমার অপেক্ষার প্রহর বাধ হারাচ্ছে আমি চাই আবার, বার বার আমি রাঙ্গাতে চাই নিজের এই নষ্ট জগৎটাকে নেশার জোয়ার ভাটায়। কালকের নেশাটা আমাকে টানছে আবার আমি হারাবো.....ঢুকে গেলাম খুপরি ঘরটায়;
বিশু দা; দাও জিনিসটা !! ভীড় ঠেলে মুখ খিচিয়ে বিশুদা’ বললো টাকা আনছস্
- এই নাও
প্যাকেট হাতে নিয়ে বললাম এই রে সাদাসোডা; আমার সাদাসোনা; কলজে পোড়ে করবো ছাই; আমি একছুটে কলেজ গেট পাড় হচ্ছি হাত ধরে আজ আবার নিঝু বললো, নীল আমায় একটু দিবি?
- সরে দাড়া তুই ভালো ছেলে এসব খাসনে বখে যাবি; নষ্ট হয়ে যাবি।
- আমি খাবো; তুই তো খাস
- আমি নষ্ট হয়ে গেছি রে, আমার কিছু নেই কেউ নেই
- কেন ; তোর মা !!
মা কথাটা কানে বাজতেই বুকের ভেতরটা আমার থমকে যায় আজ আবার তার সাথে হৃদপিন্ডটার লাফালাফি বেড়ে গেলো। “মা” শব্দটা নিতে গিয়ে মুখটা ভরে উঠে পুরো মুখ জুড়ে আসে শব্দটা “মা”।
খুজে ফিরে চেনা কথার ফাকে ভাসে, আমি কোন এক মায়ের এক হতভাগ্য সন্তান; আমার মায়ের বাবুন সোনা
মায়ের সেই নরম হাতের ছোয়া সকালের স্কুল ধরতে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া ভাতের দলা; পানি না খেয়ে এক ছুটে গেট পেরুনো; নীল পানি খাসনি এই নে, মায়ের হাতটি ধরে আমার পানি খাওয়া।
- স্কুল ছুটিতে কোথাও দাড়াবি না;
- না মা দাড়াবো না; মা তোমার লাল শাড়িটা কোথায়?
- বেচে দিয়েছি রে , তোর স্কুল ব্যাগ কিনতে হয়েছে যে,
- মা তোমার লালশাড়ি বেচে দিয়েছো কেন; আমি ব্যাগ চাইনা,তোমার শাড়ি চাই
- আমার নীল একদিন বড় হবে ; আমাকে সুন্দর সুন্দর নতুন শাড়ি এনে দেবে; পুরোনো শাড়ি দিয়ে কি করবো তাই বেচে দিয়েছি।
- মা আমি এনে দেবো তুমি আমাকে আর্শিবাদ করো।
- আমি বলে দিয়েছি ঠাকুর যেন তোকে তার চরণে রাখে সবসময়।
আমার মায়ের সেই শাড়ীর আচলের গন্ধ আমি ভুলতে পারিনা সেই আচলে মশলা মেশোনো মায়ের আদরের গন্ধটা আজো আমায় নাড়া দেয়।
সেই শেওলা ঢাকা পুকুরটায় আমি সাতার কাটছি এ যেন জন্মের সাতার আর ফুরুতেই চায়না; এক দঙ্গল ছেলেপেলে সবাই খেলছি জলকেলি; মায়ের শাসন আসছে ধেয়ে; নীল পানি থেকে উঠ বলছি চোখ দুটো কি লাল হয়েছে রে জ্বর আসবে গায়ে; মা আমি উঠছি তো। রাত দুপুরে আমি হাসছি মা দেখো তো গা’ কি রকম গরম লাগচে;
- নিশ্চই জ্বর বাধিয়েছিস;
- আচ্ছ মা তুমি আমায় নিয়ে খুব ভাব তাইনা , আমার জ্বর হলে তুমি কি রকম ব্যাস্ত হয়ে যাও;
- নীল কথা বলবি না চুপ করে শুয়ে থাক আমি জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি
- মা তুমি আমায় ছেড়ে কখনো যাবেনা তো?
- সে, কি রে তোর হঠাৎ এ কথা মনে হলো কি করে;
- মা আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার ভয় হয় তুমি ছাড়বেনা তো আমায়!!
- না, রে বাবুন সোনা তুই আমার চোখের তারার নীল তোকে ছাড়লে আমি যে অ›ধ হয়ে যাবো। আমি সব ছাড়তে গিয়েই তো আজ তোকে নিয়েই আছি বেচে। আমি তোকে ছাড়বো না; তোকে ছাড়লে আমি বাচবো না।
- আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
- নীল সোনা আমার ঘুমাও এবার।
আমার ঘুম ,খাওয়া, পড়া সব কিছুতেই মা । এ জীবনে মাকেই প্রথম ভালোবাসতে শিখেছি। আমার মা পৃথিবীর সব ভালবাসা আর আদর নিয়ে বসে আছে সারাটাক্ষণ আমার জন্য আমি যে তার বাবুন সোনা; তার চোখের নীল।
স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান;
জানো মা স্কুল ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে ভীষন; নীল তোকে তো একদিন আমাকেও ছাড়তে হবে যেতে হবে বহুদুর; সেদিন কি করবি; আমি ছাড়বোনা তোমাকে; আমার প্রিয় পায়েস নিয়ে মা হাজির; এই নে নীল তোর প্রিয় পায়েস। আমি আচ্ছন্ন হয়ে যাই ভালো লাগায় এই আমার মা যে, কিনা তার ছেলেকে ভালবাসতে কার্পন্য বোধ করেনা কখনো। মা তোমার হাতে আমাকে খাইয়ে দাও সেই যে ছোটবেলায় খাইয়ে দিতে;
- এই নে হা কর,
- আচ্ছা মা আমি এতো পায়েস পছন্দ করি কেন?
- তুই যখন আমার পেটে আমি তখন খুব পায়েস খেতাম, তাই বোধহয় তুই পায়েস পছন্দ করিস।
আজ মুখ মুছতে গিয়ে দেখি মায়ে’র আচলটা ছেড়া; মা তোমার আচল ছেড়া কেন? শাড়িটার বয়স হয়েছে অনেক তাইনা!! তোমার তো ভালো শাড়ি নেই !! মা হেসে বলে এ কিছু না তুই যখন রোজগার করবি আমাকে শাড়ি কিনে দিবি। মা’র হাতটি ধরে বলি মা আমরা এতো গরিব কেনো? আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে কে বলেছে আমরা গরিব; আমরা অনেক বড়লোক; আমাদের হাত আছে,পা আছে আর সুন্দর একটা মন আছে ; আমাদের চেয়ে কেউ কি আছে বড়লোক এ ধরায়।
হেরোইনের পুড়িয়াটা হাতে নিয়ে আজ যথার্থ প্রয়োগটা ঠিকমতো করতে পারছিনা পিছন থেকে রাজ্যের যতো স্মৃতি’রা টানছে।
কাধে ধাক্কা লাগতেই চিন্তার জাল ছিন্ন হলো; ঘুড়ে দাড়াতেই একদল মানুষের দৌড়ঝাপ; এই নীল, পালা পুলিশ আসছে;
দৌড়ে এসে সেই পরিচিত ঢেরায়; নিখিলেশ বাবু নীলকে দেখে রাখবেন ওর পড়ায় যতো টাকা লাগবে আমি মাসে মাসে পাঠিয়ে দেবো আমার তো একটাই ছেলে। না সেই নীল আর নীল নেই মা’র স্বপ্ন পূরণে ব্যার্থ। কোন এক নারীর ভালোবাসা তাকে নষ্ট করে দিয়েছে তার আকাশে আজ শুধুই ব্যার্থতা।
মা’র ছোট্ট চিঠি:
নীল তোর পরীক্ষা তো শেষ এবার চলে আয় তোকে কতদিন দেখিনা; আমি বড় রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে থাকবো আর তৈরি করে রাখবো তোর প্রিয় পায়েস।
চিঠিটা বুকে চেপে কোন ভাবেই চোখের জল ধরে রাখতে পারছিনা । এই চোখ কেন কাদছিস; থাম্ না আমি কাদবোনা; কাদতে চাইনা। চোখ তার বাধা মানেনা কান্নাটা গলার কাছে এসে দলাপাকায়; তখন নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমার বলতে ইচ্ছে করে.............
এই মা; তোর নীল; তোর বাবুন সোনা আজ নষ্ট হয়ে গেছে
যে হাতে তুই একদিন কলম তুলে দিয়েছিলি সে হাতে আজ সে সিগারেট টানে ঘন্টার পর ঘন্টা; সে হাতে আজ নেশার বোতল ঘুড়ে বেড়ায় ক্ষনে ক্ষনে; তোর সে নীল নিশ্বাসে নিশ্বাসে তোর আচলের গন্ধ শুকেনা সে গন্ধ শুকে বেড়ায় গাজার আড্ডায় । আজ সে ধোয়া উড়ায় পথে পথে; তোর সে প্রিয় পায়েস মুখে তোলে না বোতলের পর বোতল ঢালে হুইস্কি,ভদকা আর সোডা। কতদিন তোর হাতের সেই ভাত খাওয়া হয়নি তার বদলে তেলাপোকা মেশানো ডাল চলে রাতদুপুর।
মা তোর নীল মিথ্যে ভালোবাসায় যন্ত্রনার আগুনে পুড়ে হয়ে গেছে নীল ঘুড়ি; উড়ছে আকাশ জুড়ে; তোর সেই স্বপ্নকে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলেছে রাস্তার ডাষ্টবিনে। তোর জন্য কেনা সেই লালশাড়ি এখনো পড়ে আছে বিছানার চাদরের নীচে তোর সামনে দাড়াবার সাহস হারিয়ে সে প্রতিদিন খুজে ফেরে একটু সুখ একটু ভালোবাসা।
নেশায় আসক্ত এই আমি
বাসে চেপেছি আজ সকালে; বাড়ি যাবো কিন্তু আজ যে আমি দাড়িয়ে থাকতে পারছিনা নেশা আমাকে টানছে; নেশা আমাকে হাতছানি দিয়ে বলে আয়, তোকে ভাসাবো মৃত্যুর জোয়ারে। আমি যে কিছুতেই ফেরাতে পারছিনা নেশা আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে; মা আমি আসছি তোমার কাছে; পৃথিবী ঘুড়ছে বনবন করে একহাতে ডাকছে নেশা আর একহাতে মা। মা, যে দাড়িয়ে আছে বড় রাস্তার মোড়ে নীল আসবে..................
হঠাৎ ব্রেক কষতেই আমি ছিটকে পড়লাম কারো গায়ে পৃথিবীটা ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে আসছে।
- ঃ সমাপ্ত ঃ-
--------------------------------------------------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৫৯