অনাথ আজ মোটেও স্থির থাকতে পারছে না। যদিও উপর থেকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না। এটি অবশ্য অনাথের নিজের মনে হচ্ছে। যতই গোপন করুক তবুও সবাই যেন কিভাবে টের পেয়ে যাচ্ছে। এই যেমন টঙের মজনু মামাকে যখন বললো," মামা একটা চা দাও।" কথাটাতো স্বাভাবিকই ছিলো। তাহলে হুট করে মামা জিজ্ঞেস করল কেন যে "মামা, কিছু হইছে ? আইজ বড় অস্হির লাগতাছে যে? "
"কই না তো "অনাথ মিথ্যে বলে। "এই কথা ক্যান জিগান? "
"না মানে, প্রতিদিন তো কন মামা দুধ চিনি বাড়ায়া একটা ঝাক্কাস চা দ্যান আর একটা গোল্ড লিফ, আর আইজকা হুদা চা চাইলেন যে? "
অনাথ বুঝতে পারে সে স্বাভাবিক আচরণ করছে না। তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। কাকপক্ষীকেও টের পেতে দেয়া যাবেনা কিচ্ছুটি। কিন্তু সবাই তো টের পেয়ে যাচ্ছে সব। প্রকৃতিও আজ অস্থির। কোথায় শ্রাবণ মাস, ধুমায়া বৃষ্টি পড়বে তা না, ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে এই রোদ উঠছে এই মেঘ করছে। অনাথ বুঝতে পারে না, তার মনের অস্থিরতা কি প্রকৃতিতে প্রবাহিত হয়েছে? কি জানি হতেও পারে, প্রকৃতির রহস্যময়তা বোঝা কার সাধ্য?
কিন্তু আজ অনাথের অস্থিরতার কারন কি?
সন্ধ্যা নামে। অনাথের অস্থিরতা যায় না। কারণও খুঁজে পায়না। কিন্তু অস্থিরতা বা তার কারণ অনুসন্ধান করা তো তার স্বভাবের সাথে যায়না। অনাথ আবোলতাবোল চিন্তা করতে করতে স্টেশনের সদাগর ভাইয়ের দোকানে যেয়ে চা দিতে বলে। দোকানের টিভিতে খবর চলছে, "আজ রক্তঝরা আগস্টের ১২ তারিখ। আগস্টের এই দিনে ..."
অনাথ চট করে বুঝে ফেলে অস্থিরতার কারণ। আজ তমশার জন্মদিন। সে কোনদিন তাকে জন্মদিনের উইশ করেনি। এই নিয়ে তমশার অভিমানের, অভিযোগের কমতি ছিল না। কেন উইশ করেনি, সবাই কত্ত সারপ্রাইজ গিফট করছে, বন্ধুরা কত্ত হইহুল্লোড় করছে ..ব্লা ..ব্লা ..।বিপরীতে অনাথ শুধু হেসেছে। এরকমই এক জন্মদিনে লাখখানেক অভিযোগের পাহাড় তুলে তমশা চলে যায়। এইরকম নীরস মানুষ নাকি তার দরকার নাই যে জন্মদিনে সামান্য উইশ করতে কিংবা দুটা ফুল আনতে কার্পন্য দেখায়। তমশা চলে যায় ...অনাথ নীরব বসে থাকে ...
এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে অনাথ রেললাইনে গিয়ে বসে, আর প্রতিবারের মত চাঁদের দিকে তাকায় আর চন্দ্রাহত হতে থাকে।প্রতিবছর তমশার জন্মদিনের মত সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যায় আর ফুলে ফুলে তাকে রাবিন্দ্রিক সাজে সাজায়। এই সেই কল্পনার তমশা যাকে শারিরী ভাষায় ভালবাসা প্রকাশ করতে হয়না, যাকে মুখে কিছু বলতে হয়না, যার জন্য চোখের ভাষাই এত গভীর যা মন পর্যন্ত বিনা বাধায় পৌঁছুতে পারে। বাস্তবের ছলাকলায় চাওয়াপাওয়া সর্বস্ব তমশার সাথে সম্পূর্ন ব্যস্তানুপাতিক কল্পনার তমশা। ধীরে ধীরে কল্পনার তমশা অনাথের চোখে মোহনীয় থেকেও মোহনীয় রূপে ধরা দিতে থাকে। এতই বাস্তব লাগে তাকে মনে হয় এই বুঝি হাত বাড়ালেই তাকে স্পর্শ করা যাবে। অনাথ অবাক চোখে তাকে কেবলই দেখতে থাকে ...একসময় সে কম্পিত হাত বাড়িয়ে তার হাতটি ধরে আর কানে কানে বলে, এই কুহকিনী, শুভ জন্মদিন...তমশা ভুবনমাতানো কুহকের হাসি হাসে ...
ট্রেন আসার শব্দে অনাথের কল্পনা যায় টুঁটে ...কিন্তু রেশটুকু রয়ে যায়। তার মনে বাজতে থাকে
"জাগরনে তারে না দেখিতে পাই,
থাকি স্বপনেরও আশে
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়
বাঁধিব স্বপনও পাশে .
এত ভালবাসি এত যারে চাই
মনে হয়নাতো সে যে কাছে নাই
যেন এ বাসনা ব্যকুলও আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি ..."