(শুধুমাত্র ঘোর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জন্য লেখা।)
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের সময় আমি ১ম শ্রেণীর ছাত্র।
খেলা কখন হত জানি না, তবে বাবাকে দেখতাম বিকেলে বিটিভিতে ফুটবল খেলা দেখছেন। সম্ভবত তিনি খেলার পুণঃপ্রচার দেখতেন।
ফুটবল এমনই একটা খেলা যেটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শিশু-তরুণ-বৃদ্ধ যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে। তাই বাবার সাথে বসে কয়েকটি খেলা দেখেছিলাম। আবছা মনে আছে যে কালো জার্সি পরা (বুঝতে হবে যে টিভি ছিল সাদাকালো
ধীরে ধীরে যত বড় হলাম ফুটবল খেলার প্রতি ততই আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলাম। আমার বাসা তখন ছিল মীরপুর ১ এ। যেদিন করে মীরপুর ২ এর জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলা হত, সেদিন করে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটের আলো আমাদের এলাকার উচুঁ বাড়িগুলোতে এসে পড়ত। বুঝতাম আজকে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। কি ভাবে জানি আমি মোহামেডান দলের সমর্থকে পরিণত হলাম। যেদিন করে মোহামেডানের খেলা থাকত সেদিন করে খাতার একটা পৃষ্ঠায় তিনটি কালো দাগ কোনাকুনি এঁকে একটি কাঠিতে ঐ কাগজটি আঠা দিয়ে লাগিয়ে ছাদে চলে যেতাম এবং পিলারের লোহার সাথে বেঁধে দিতাম।
তখন ফুটবলই ছিল এদেশে সবার প্রিয় খেলা। আমরা ছোটরা মীরপুর ১ এ বেঙ্গলী মিডিয়াম স্কুলের বিশাল মাঠের এক কোণে প্রায় প্রতিদিনই ফুটবল খেলতাম। তখন ঐ এলাকায় এত বেশি ঘনবসতি ছিল না। এখন সেই বেঙ্গলী মিডিয়াম স্কুলের মাঠ দখল করে কয়েকটি মার্কেট গড়ে উঠেছে। হায়রে বাংলাদেশ!
যাহোক, এরপর ১৯৯০ তে মনিপুর স্কুলে ভর্তি হলাম। আমরা চলে এলাম মনিপুর স্কুলের পাশে। তখন এই এলাকাটিতে বাড়িঘর খুবই কম ছিল। ছিল খোলা জায়গা এবং অসংখ্য ডোবা। এই বছরই অনুষ্ঠিত হল ইটালী বিশ্বকাপ।
মনে পড়ে, আমাদের সে কি উত্তেজনা! রাত জেগে খেলা দেখা আর সকালে সমবয়েসীদের সাথে সেই খেলা নিয়ে তুমুল গলাবাজি।
প্রথম খেলাতেই আর্জেন্টিনা ক্যামেরুন নামে এক অখ্যাত দলের সাথে হেরে গেল।
কি কারণে জানি আর্জেন্টিনার প্রতি একটি সহানুভূতি এসে গেল। জানতে পারলাম এই দলেই আছে আগের বিশ্বকাপের বিশ্বকাপানো খেলোয়াড় ম্যারাডোনা। আরও আছে ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা, বুরুচ্যাগা, সেনসিনি এবং গোলকিপার গয়কোচিয়া।
আমি আর্জেন্টিনা নামক ঐ ল্যাটিন আমেরিকার দলটির ভক্ত হয়ে গেলাম। আর্জেন্টিনার প্রতিটি খেলা মানেই সে কি শিহরণ!
(প্রিয় ব্লগার মিল্টন ভাইয়ের কথায় মনে পড়ল, ঐ বিশ্বকাপ চলাকালে খেলার বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি সম্বলিত ভিউকার্ড জমানো নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমরা দুই ভাই মিলে প্রায় ১২০টি ভিউকার্ড জমিয়েছিলাম। কোনটি ৫০ পয়সা, কোনটি ১ টাকা, আবার কোনটি ২ টাকা। প্রতিটি ভিউকার্ডের পিছনে নম্বর দিয়েছিলাম যাতে কোনোটা হারিয়ে গেলে খুঁজে পাই। ভিউকার্ডগুলো অনেক বছর ছিল, তারপর কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না
আর্জেন্টিনা আমাদেরকে নিরাশ করে নি। শেষ পর্যন্ত এই দলটি ফাইনালে পৌঁছে গেল। আমরা পুরো পরিবার টিভি সেটের সামনে বসে খেলা দেখছি।
কিন্তু শক্তিশালী জামার্নীর বিপক্ষে ফাইনালে আর্জেন্টিনা তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। তবে মনে মনে একটা আশা ছিল যে, আর্জেন্টিনার গোলকিপার গয়কোচিয়া খুবই দক্ষ। খেলা যদি টাইব্রেকার পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে আর্জেন্টিনাই জিতবে।
কিন্তু অঘটন ঘটল তার আগেই! সামান্য একটি ফাউলের অজুহাতে রেফারি কোডেসাল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পেনাল্টি কিকের আদেশ
দিলেন!!!
আমরা রুদ্ধশ্বাস, হতবাক হয়ে গেলাম!!!
পুরো স্টেডিয়ামের উত্তেজনা তখন আমাদের বাসায়!!!!
তারপরও আশা ছিল গোলকিপার ঠিকই পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিবে।
কিন্তু পারল না, ব্রেইমা নামের জার্মানীর খেলোয়াড়টি পিলার গা ঘেষে যেভাবে বলটি জালে পাঠালো, সেটা ঠেকানো বিশ্বের সেরা গোলকিপারের পক্ষেও সম্ভব নয়!!!
কাঁদছেন ম্যারাডোনা!
আমারও চোখ টলটল করে উঠল!!!
শেষ কয়েক মিনিট অনেক চেষ্টা করল আর্জেন্টিনা- কিন্তু গোল শোধ করতে পারল না।
হেরে গেল আর্জেন্টিনা!!!
আমি হতবিহ্বল! নির্বাক!!! আমার প্রিয় দলটি এভাবে তীরে এসে তরী ডোবালো!!!
বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেল- কিন্তু সেই শোকের রেশ কাটতে কয়েকদিন লাগল আমার!!!
ম্যারাডোনা হয়ে গেলেন আমার প্রিয় এক ট্রাজেডির নায়ক!!!
এরপর প্রতিটি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার খেলা মানেই অন্য রকম এক উত্তেজনা, আশায় বুক বাঁধা।
বিস্কিট, চানাচুর, চিপস নিয়ে টিভির সামনে অপলক বসে থাকা।
আর্জেন্টিনা জিতলে চিৎকার করে ওঠা।
আবার হেরে গেলে হতবিহ্বল হয়ে থাকা।
সবচেয়ে খারাপ লাগত যেদিন আর্জেন্টিনা হেরে গিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিত। সেদিন এবং তারপর কয়েকটা দিন গলা দিয়ে খাবার নামত না। সারাক্ষণ খালি ভাবতাম- এরকম কেন হল? ঐ খেলোয়াড়টা ঐরকম না করলে কি হত? রেফারির ঐ সিদ্ধান্তটা কি ঠিক ছিল?
কৈশোরের সেই আবেগ এখন অনেকটাই কমে এসেছে! জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত আমরা রাত জেগে খেলা দেখে পরদিন কিভাবে অফিস করব সেই চিন্তাও করতে হয়। আমার ছেলের বয়স ৩ মাস। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে সেও হয়ত তার বাবার মত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখবে। কিন্তু বাবার সেই আবেগ তাকে স্পর্শ করবে কি? তার জন্য খেলার কোন মাঠই তো এই শহরে নেই। খোলা মাঠে ফুটবল নিয়ে প্রাণপণে দৌড়ানোর উত্তেজনা সে কি কোনদিন বুঝতে পারবে?
বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। বাংলাদেশ কোনদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে সে আশা করা কঠিন। কিন্তু বিশ্ব ফুটবল তো থেমে নেই। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে পৃথিবীজুড়ে যে আলোড়ন তৈরা হয় তার সমকক্ষ আর কোনকিছু নেই- গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। আমরা বাংলাদেশীরা বিশ্ব ফুটবলে অংশ নিতে না পারি, একটি দলকে সমর্থন দিয়ে সেই খেলার একটুখানি উত্তেজনার ভাগিদার হতে সমস্যা কোথায়?
আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক। আমৃত্যু তাই থাকতে চাই।
আসুন সবাই বিশ্বকাপের সেরা দল আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দেই!!!
আজ থেকে প্রোফাইলে আর্জেন্টিনার পতাকা!!!
আর্জেন্টিনা এবার চ্যাম্পিয়ন হবেই!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৩:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



