[যারা অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেমন সাইজের কেনা উচিত চিন্তা করছেন তাদের জন্য ধান ভানতে শীবের গীত টাইপ নন-টেকি পোস্ট।]
১৯৯৯ সালে বাবা যখন একটা কম্পিউটার কিনে দেন, সেটা দেখতে আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীরা আসতেন। পিতৃস্থানীয় মুরুব্বীদের একটা কমন প্রশ্ন ছিল- বাবা, তোমার কম্পিউটার কত ইঞ্চি? অর্থাৎ কম্পিউটার যেহেতু দেখতে টিভির মতই- তাই সেটার 'সাইজ' ইঞ্চিতেই হওয়া উচিত এমন ধারণা তাদের ছিল। বাধ্য হয়েই তখন কম্পিউটারের ক্ষমতার সূচক যেমন প্রসেসর, র্যাম, গ্রাফিকস্, এইচডিডি ইত্যাদি বোঝাতে হত। কেউ কেউ সামান্য বুঝতেন- কারো হয়ত মাথাতেই ঢুকত না। সম্পূরক প্রশ্ন করতেন- বাবা, স্পিকারগুলা এত ছোট কেন? এগুলো কি রেডিওর স্পিকার? সত্যি কথা বলতে কি, এত ছোট স্পিকার থেকে যে এত বিকট শব্দ বের হতে পারে তা কম্পিউটার আসার আগে আমি নিজেও জানতাম না। (ক্রিয়েটিভের সাবওফারের স্পিকারগুলো ছিল খুব ছোট ছোট)।
পরের বছর একটা বহু কষ্টে একটা মোবাইল কিনি। গ্রামীন ব্যাঙ্কের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রামীনফোনের নতুন আসা প্রিপেইড প্যাকেজ থেকে সিমেন্স সি-২৫ সেটটি সংযোগসহ ৮৫০০/- টাকা দিয়ে কিনি।
টার্গেট ছিল সিমেন্স সি-৩৫ কিন্তু ঐটা সবার টার্গেট হওয়ায় আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সিমেন্স সেট পছন্দ করার কারণ হল ঐ সময় সিমেন্স, নকিয়া ও এরিকসনের কয়েকটি সেট ছাড়া অন্য সব সেট ছিল ঢাউস আকৃতির- যেমন ফিলিপস ডিগা, বোস, অ্যালকাটেল ইত্যাদি। নকিয়া ও এরিকসনের দাম ছিল অনেক বেশি, তাই ঐদিকে নজর দেয়ার উপায় ছিল না। সিমেন্স সি-২৫ সেটটি দেখতে সুন্দর হলেও চার্জ খুব কম থাকত। চার্জার সাথে রাখা লাগত সবসময়।
প্রথমদিকে মোবাইল ফোনের যে বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করা হত সেগুলো হল- মোবাইল ফোনের আকার-আকৃতি, কতক্ষণ চার্জ থাকে, কতগুলো নম্বর সেভ করা যায়, রিংটোনের সংখ্যা ও ধরণ, ইনফ্রারেড আছে কি না ইত্যাদি।
মোবাইল ফোনে গান শোনা বা ছবি দেখার কথা তখন কল্পনাতে ছিল না। পরে ধীরে ধীরে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যোগ হতে থাকে- যেমন, মেসেজিং, ব্লুটুথ দিয়ে কিছু শেয়ার করা, পলিফোনিক ও কাস্টমাইজড রিংটোন, এফএম রেডিও, রঙিন ডিসপ্লে, মিউজিক প্লেয়ার, ক্যামেরা, মেমরি কার্ড ইত্যাদি।
প্রায় সব মোবাইল ফোনের দৃশ্যমান এন্টেনা অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় স্মার্টফোনের পথচলা। আসে জিপিআরএস বা এডিজিই প্রযুক্তির নেট ব্রাউজিং সুবিধা, আলাদা মেমরি কার্ড স্লট, টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি, ওয়াইফাই, হাই রেজোলুশান ক্যামেরা, হাই রেজোলুশান ভিডিও দেখার সুবিধা, ভিডিওকল, জিপিএস, ডেডিকেটেড জিপিইউ, ভয়েস মেমো ও কমান্ড, বিভিন্ন ধরণের সেন্সর ইত্যাদি।
বর্তমানে সর্বাধুনিক মোবাইল দিয়ে করা যায় না এমন বিষয় খুব কমই আছে। এমনকি মোবাইল ফোন প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ফলে পারসোনাল কম্পিউটার বা পিসি ও ল্যাপটপের বিক্রির হার কমে গেছে বলে তথ্যসূত্রে জানা যায়। অনেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান পিসি বিক্রি কমিয়ে মোবাইল ফোন উৎপাদনে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
উপরের এত কথার একটা সারমর্ম আছে। সেটা হচ্ছে- মাত্র কয়েকবছর আগে অর্থাৎ টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির মোবাইল বাজারে আসার আগে মোবাইল ফোনের আকার যত ছোট ছিল তত সেটা আকর্ষণীয় মনে হত। যেমন নকিয়ার কিংবা এরিকসনের নিচের সেট দুটি একসময় খুব আকর্ষণীয় মনে হত শুধুমাত্র ছোট সাইজের কারণে।
সহজভাবে বলতে গেলে আমরা ভাবতাম- যেই সেট যত ছোট তার দাম তত বেশি!
কিন্তু টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি আসার পর ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। এখন যে সেটের ডিসপ্লে যত বড় তার মূল্য তত বেশি। আর মোবাইল ফোন নির্মাতারাও ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সেট বাজারে ছাড়ছে।
বিশ্বসেরা মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোনটি? আমার মত অধিকাংশ পাঠক একবাক্যে স্বীকার করবেন- নকিয়াই বিশ্বের সেরা মোবাইল ফোন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিগত কয়েকবছর নকিয়ার কিছু একগুয়ে সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে নকিয়ার আধিপত্য কমে গেছে। নকিয়ার সিমবিয়ান ও উইন্ডোজভিত্তিক মোবাইল ফোনের চেয়ে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপলের আইওসভিত্তিক আইফোন অনেক বেশি ফিচারসমৃদ্ধ, অ্যাপসসমৃদ্ধ ও ইউজার ফ্রেন্ডলি হওয়ায় নকিয়াকে হটিয়ে বাজার দখল করে নিচ্ছে। অ্যাপলের আইফোনের কথা বেশি বলা লাগে না- অ্যাপল অ্যাপলই। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড ওএস দিয়ে বাজার দখলে শীর্ষে আছে যে প্রতিষ্ঠানটি সেটা হল স্যামসাং। স্যামসাংয়ের বিষয়টি যেন এমন- এলাম, দেখলাম, জয় করলাম! এরপর আছে মটোরোলা, এলজি, এইচটিসি, সনি এরিকসন ও হালের সনি।
টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির প্রথম সফল মোবাইল ফোনটি হল ২০০৮ এ বাজারে আসা অ্যাপলের আইফোন। আইগড স্টিভ জবসের চিরন্তন ‘বাইরে সদরঘাট, কিন্তু ভিতরে ফিটফাট’ নীতিতে তৈরি ফ্রন্টে শুধু একটা হার্ডওয়ার বাটনযুক্ত ডিভাইস আইফোন মোবাইল ফোনের আউটলুকের ধারণা পুরোপুরি বদলে দেয়।
যদিও আইফোনের প্রথম মডেলটির ফিচার তেমন আহামরি কিছু ছিল না তারপরও সেটা এককভাবে সর্বাধিক বিক্রিত মোবাইল হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। আইফোনের সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবছর আইফোনের প্রতিটি মডেল এককভাবে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোন হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।
তথ্যসূত্র এখানে যদিও অনেক তথ্য অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে!
আর আগ্রাসী স্যামসাং আইফোনের কনসেপ্ট নকল করে বাজারে আনে অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক গ্যালাক্সি সিরিজের প্রথম সেট গ্যালাক্সি এস যা প্রথম বছরেই রেকর্ড পরিমাণ বিক্রি হয়।
পাশাপাশি এইচটিসির ডিজায়ার মডেলের প্রথম সেটটিও অ্যান্ড্রয়েড অগ্রযাত্রার বিশাল অবদান রাখে।
আর গত দুই বছর ধরে স্মার্টফোনের আধিপত্যের লড়াই মাত্র দুই মোবাইল ফোন নির্মাতার দুই ফোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে- অ্যাপলের আইফোন বনাম স্যামস্যাংয়ের গ্যালাক্সী এস ফ্ল্যাগশিপ।
যাহোক, এবার পোস্টের শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি। অনেক গবেষণা করে প্রথম যে অ্যান্ড্রয়েড ফোনটি কিনি সেটা হল এইচটিসি ডিজায়ার এইচডি-
যুক্তি ছিল- ৪.৩ ইঞ্চির বিশাল ডিসপ্লেতে মুভি দেখা, ব্রাউজিং করা যাবে যাতে সব জায়গায় ল্যাপটপ সাথে নিতে না হয়। তার উপর GSMarena তে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ট্যাগ দেখে আর কিছু চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। রাইফেলস স্কয়ার মার্কেট থেকে কেনা নতুন এই সেটটি প্রথম প্রথম খুব ভাল লাগত। কিন্তু কিছুদিন পর মনে হল- সেটটি খুবই ভারী এবং চার্জ একেবারেই কম থাকে। ফলে মাত্র তিন মাসের মাথায় সেটটি বিক্রি করে দিয়ে কিনলাম- স্যামস্যাং গ্যালাক্সি এস ফোর জি।
কিন্তু নদীতে গোসল করে পুকুরে নামলে যেমন ছোট মনে হয়- তেমনি এই সেটটিও মনে হল প্রয়োজনের তুলনায় ছোট, স্পিডও কম।
তারপর ভাবলাম- যদি এমন একটা সেট পাওয়া যায় যেটার ডিসপ্লে হবে বড়, স্পিড হবে বেশি, ল্যাপটপের প্রায় সব কাজ করা যাবে কিন্তু ওজন তুলনামূলক হালকা হবে- তাহলে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই অনেক গবেষণার পর কিনলাম স্যামসাং গ্যালাক্সী নোট ।
৫.৩ ইঞ্চি বিশাল ডিসপ্লের এই ফ্যাবলেট সেটটি প্রথম প্রথম ভাল লাগলেও গত কিছুদিন আগে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছি- কারণ এত বড় সেট কানে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে ইচ্ছে হয় না, পকেটে রাখলে সারাক্ষণ চাপ পড়ার ভয় থাকে, বড় ডিসপ্লে হওয়াতে আসলে চার্জও বেশিক্ষণ থাকে না। ফলে প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। বরং মাঝে মাঝে বের করে ট্যাবলেটের মত ব্যবহার করা যাবে।
এরপর কিনলাম এইচটিসি ডিজায়ার সি। সেটটি ওজনে হালকা-মাত্র ১০০ গ্রাম, ডিসপ্লে সাইজ ৩.৫ ইঞ্চি, চার্জ থাকে মোটামুটি ভালই। (চার্জ থাকার বিষয়টি ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও মাল্টিমিডিয়া চালানোর উপরও নির্ভর করে। মডারেট ব্যবহারে দুইদিন চার্জ থাকে।)
স্যামসাংয়ের প্রথম গ্যালাক্সী এস সেটটির ডিসপ্লে ছিল ৪.০ ইঞ্চি। এরপর গ্যালাক্সী এস টু তে বাড়িয়ে হল ৪.৩ ইঞ্চি। তারপর সর্বশেষ গ্যালাক্সী এস থ্রি হল ৪.৮ ইঞ্চি। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপলের আইফোনের ডিসপ্লে শুরুতে ছিল ৩.৫ ইঞ্চি। পরবর্তী আইফোন থ্রিজি, থ্রিজিএস, ফোর, ফোরএস পর্যন্ত সেই সাইজ অক্ষুণ্ন থাকে। সম্প্রতি বাজারে আসার আইফোন ৫ এর ডিসপ্লে ৪.০ ইঞ্চি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আইফোনের ডিসপ্লে নিকট ভবিষ্যতে ৪.০ ইঞ্চির উপর যাবে না- কারণ অ্যাপল সম্প্রতি আইপ্যাড মিনি বাজারে আনার ঘোষণা দিয়ে ফোন ও ট্যাবলেটের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে। অপরদিকে স্যামসাং আইফোনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্যালাক্সী এস থ্রির একটা ৪.০ ইঞ্চি ভার্সন গ্যালাক্সী এস থ্রি মিনি বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ স্যামসাং আবার প্রথম মডেলের সাইজে ফিরে গিয়েছে।
এই অধমের পরামর্শ হল- যদি প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য অ্যান্ড্রয়েড কিনতে চান তাহলে ৩.৫ থেকে ৪.০ ইঞ্চি ডিসপ্লের ফোন আপনার বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী কিনুন। আর যদি আপনি শৌখিন ব্যবহারের জন্য বড় ডিসপ্লের অ্যান্ড্রয়েড কিনতে চান- তাহলে আপনি যে কোন অ্যান্ড্রয়েডই কিনতে পারেন।
আর যারা দুটোই চান এবং যথেষ্ঠ বাজেট আছে- তারা মোটামুটি দামে একটা ৩.৫ থেকে ৪.০ ইঞ্চি ডিসপ্লের অ্যান্ড্রয়েড কিনুন। বাকী টাকা দিয়ে একটি ট্যাবলেট বা ফ্যাবলেট (ফোন+ট্যাবলেট) কিনুন। অ্যান্ড্রয়েড ফোনটি রাখুন পকেটে আর ট্যাবলেট/ফ্যাবলেট রাখুন ব্যাগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




