গল্পের শুরুটা ১৯ শতকের শুরুর দিকে। আর তার রূপকার যে মানুষটি, তার নাম ’স্যার হেনরি পেলাট’। প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই মানুষটি-ই কানাডা’র টরন্টোর বুকে তৈরি করেছিলেন দানবীয় এক রাজপ্রাসাদ যা ’ক্যাসালোমা’ নামেই বিশ্বখ্যাত। সম্প্রতি ক্যাসালোমা ঘুরে এসে পৃথিবীখ্যাত এই রাজপ্রাসাদের অজানা অনেক কথা আর ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো আজ।
১৮৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি কানাডা’র ওন্টারিও প্রভিন্সের কিংস্টোন শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে স্যার হেনরি পেলাট -এর জন্ম। বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় হেনরী পরিবার সহ টরন্টোতে চলে আসেন যখন তার বয়স মাত্র ২ বছর। টরন্টো শহরের বুকে হেনরীর বাবা ’পেলাট অ্যাণ্ড অসলার’ নামে এক ষ্টক ব্রোকারেজ ফার্ম খুলে ব্যবসা শুরু করেন। সতের বছর বয়সে হেনরী ’আপার কানাডা কলেজ’ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর বাবা তাকে পাঠালেন ইউরোপ ঘুরতে। ঠিক তখন থেকেই তরুণ হেনরীর মনে শিল্প, ভাষ্কর্য এবং রূপকথার প্রাচীন দূর্গ তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ জন্মায় এবং মনে মনে তিনি ঠিক করেন, কোনদিন সুযোগ পেলে অসাধারণ কোন এক দূর্গ বানাবেন নিজের থাকার জন্যে।
স্যার হেনরী পেলাট
তরুণ বয়সের হেনরী
স্যার হেনরী পেলাট
ইউরোপ থেকে কানাডায় নিজের বাড়ি ফেরার পর হেনরী তার বাবার ব্যবসায় যোগ দিলেন। পাশাপাশি ইংল্যাণ্ডের রাণীর ব্যক্তিগত রাইফেল রেজিমেন্ট-এ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাম লেখালেন। এ সময়টাতেই তিনি খেলাধূলায় ভালো দক্ষতা অর্জন করলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সী হেনরীকে নর্থ-আমেরিকা চিনলো ’দ্রুত দৌড়বিদ’ হিসেবে।
ম্যারি ডজসনের সাথে হেনরীর পরিচয়, প্রণয় এবং বিয়ে - এ সবই তার তরুণ বয়সের ঘটনা। সেই সময়টাতেই তিনি এককভাবে ’টরন্টো ইলেকট্রিক লাইট কোম্পানী’-এর ব্যবসা শুরুর পর মাসিক ২৫ ডলার বেতন বাবদ তিনি সেই কোম্পানীর সেক্রেটারি পদে নিজেকে অভিষিক্ত করলেন। এই ব্যবসটি শুরুর সময়টাতে হেনরী টরন্টো সিটির সামান্য কিছু অংশে ’আর্ক লাইট’ স্থাপন করার অনুমতি লাভ করেন। এর ছয় বছর পর তাঁর কোম্পানী সিটি অব টরন্টোর রাস্তার সব বাতি স্থাপন করার কনট্র্যাক্ট পেল।
১৮৯২ সালে বাবার রিটায়ারমেন্টের পর হেনরী তার বাবার ’পেলাট অ্যাণ্ড অসলার’ কোম্পানীর হাল ধরলেন। তীক্ষ্ম বুদ্ধি আর ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিল। নর্থ ওয়েস্ট ল্যাণ্ড কোম্পানী, কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে এবং টরন্টো ইলেকট্রিক রেলওয়ে কোম্পানী থেকে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে এলো হেনরীর হাতে। ঠিক তখনই তার মাথায় এলো রূপকথার এক রাজপ্রাসাদ বানানোর। তখনও কি হেনরী জানতেন যে, তাঁর সৃষ্টি একদিন পৃথিবীখ্যাত হবে?
ওয়াইন রাখার ঘর
অফিস কক্ষ
লবি
অফিস কক্ষ
প্রাসাদের পেছনের দিকে যাবার রাস্তা
লিভিং রুম
১৯০৯ সালে এডওয়ার্ড জে. লেনক্স নামের এক ভদ্রলোকের করা ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে টরন্টো শহরের ড্যাভেনপোর্ট হিলের ওপরে বিপুল পরিমাণ জমি কিনে কিংবদন্তীর সেই রাজপ্রাসাদ বানানো শুরু হলো। হেনরীর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ৩০০ লোকের পরিশ্রমে মাত্র তিন বছরের মাথায় গড়ে উঠলো রাজকীয় প্রাসাদ ’ক্যাসালোমা’। নিজের বাসস্থান এই প্রাসাদের প্রতিটি পাথর হেনরীর নিজে যাচাই বাছাই করেছেন। সুদূর স্কটল্যাণ্ড থেকে ’স্কটিশ’ ধাঁচের পাথরগুলো কানাডায় জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর আসবাবপত্র? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত তাঁর বহুমূল্যের আসবাবগুলো ছিল তুলনাহীন।
লিভিং রুম
লিভিং রুম
প্রাসাদের পেছনের দিকে
প্রাসাদের পেছনের দিকে
টাইপরাইটার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের কোন এক সময় হেনরী পেলাট তার সহধর্মিনীসহ নিজ বাসভবন ’ক্যাসালোমা’তে এসে উঠলেন। যদিও প্রাসাদের কাজ তখনও অনেক বাকি ছিল। কিন্তু হেনরী তার স্বপ্নের প্রাসাদের কাজ দ্রুত শেষ করতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। এভাবেই বছর দশেক ক্যাসালোমা’তে হেনরী পেলাট তার পরিবার নিয়ে বাস করতে লাগলেন।
প্রাসাদের ভেতরে
লিভিং রুম
লিভিং রুম
বিলিয়ার্ড রুম
লিভিং রুম
ক্যাসালোমাতে যা রয়েছে: ৯৮ টি কক্ষ, ৩০ টি স্নানাগার, ২৫ টি ফায়ারপ্লেস, ৩ টি বোলিং অ্যালে, ৫০ মিটার শুটিং গ্যালারী, ওয়াইনের ১৭০০ বোতল রাখার জন্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কক্ষ, ৫০০০ ইলেকট্রিক লাইট বাল্ব, ৫২ টি টেলিফোন, সিটি অব টরন্টোর প্রথম ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক এলিভেটর, অসম্পূর্ণ অবস্থায় ১৮ মিটার লম্বা ইনডোর সুইমিং পুল, রাস্তার নিচ দিয়ে আস্তাবলে যাওয়ার জন্য ২৪৩ মিটার লম্বা টানেল ইত্যাদি। রাজপ্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ৪০ জন দাসী সর্বদা নিয়োজিত ছিল। সুবিশাল লাইব্রেরিতে দশ হাজার বই সংরক্ষিত ছিল। ডাইনিং রুমে ১০০ লোকের বসার ব্যবস্থা ছিল। হেনরী তার ব্যক্তিগত ওয়াশরুমটি দামী মার্বেল আর সোনা দিয়ে তৈরি করেছিলেন।
স্যার হেনরী পেলাট-এর শোবার রুম
গেষ্ট রুম
দ্বিতীয় তলা থেকে তোলা ছবি
দ্বিতীয় তলা থেকে তোলা ছবি
দ্বিতীয় তলা থেকে তোলা ছবি
অফিস কক্ষ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হেনরী’র ব্যবসা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্যাসালোমার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ তাকে বছরে প্রায় ১ লক্ষ ডলার গুণতে হচ্ছিলো তখন। ১৯২৪ সালের দিকে হেনরীর অনেকগুলো ব্যবসায় ধ্বস নেমে আসে। তিনি প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলার ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে তাঁর সহধর্মিনীর শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। ওই বছরই মিসেস হেনরী পেলাট মারা যাবার পর স্যার হেনরী পেলাট কপর্দক অবস্থায় তাঁর স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ ক্যাসালোমাকে ’সিটি অব টরন্টো’-এর কাছে হস্তান্তর করে মাত্র তিন ট্রাক নিজস্ব মালামালসহ কমদামী বাসায় উঠলেন।
ম্যারি পেলাট -এর শোবার ঘর
ম্যারি পেলাট -এর শোবার ঘর
স্যার হেনরী পেলাট -এর ওয়াশরুম
ব্যবহৃত ফোন
ব্যবহৃত জামা-কাপড়
স্যার হেনরী পেলাট -এর শোবার ঘর
নি:স্ব অবস্থায় ১৯৩৯ সালে স্যার হেনরী মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর কাছে ১৮৫ ডলার ৮ সেন্ট ছিল এবং পাওনাদাররা তাঁর কাছে ৬০০০ ডলার পেত।
লিভিং রুম
লিভিং রুম
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত পিয়ানো
স্যার হেনরী পেলাট এবং ম্যারী পেলাট-এর ব্যবহৃত জুতা
গেস্ট রুম
স্যার হেনরী পেলাট এবং ম্যারী পেলাট-এর ব্যবহৃত জিনিস
স্যার হেনরীর মৃত্যুর পর অনেকগুলো বছর ’ক্যাসালোমা’ জন-মানবহীন ভাবেই পড়ে ছিল। যদিও ক্যাসালোমাকে ঘিরে অনেক পরিকল্পনা হচ্ছিল তখন । ১৯২৭ সালের দিকে খুব অল্প সময়ের জন্যে ক্যাসালোমা পরিণত হয়েছিল ’নাইট ক্লাবে এবং একে অ্যাপার্টমেন্ট হোটেলে পরিণত করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
ঘোড়ার গাড়ি
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত ফোর্ড কোম্পানীর দামী গাড়ি
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত ফোর্ড কোম্পানীর দামী গাড়ি
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত ফোর্ড কোম্পানীর দামী গাড়ি
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত ফোর্ড কোম্পানীর দামী গাড়ি
স্যার হেনরী পেলাট-এর ব্যবহৃত ফোর্ড কোম্পানীর দামী গাড়ি
অবশেষে ১৯৩৭ সালে ’কিওয়ানিজ ক্লাব অব ওয়েস্ট টরন্টো’ ক্যাসালোমা’কে সিটি অব টরন্টোর থেকে লিজ নিল। এই প্রতিষ্ঠানটি ক্যাসালোমার হারিয়ে যাওয়া অস্থিত্বকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলো এবং ক্যাসালোমা পরিণত হলো একটি জাদুঘরে। আজ যদি স্যার হেনরী পেলাট বেঁচে থাকতেন, তাহলে আবারও হয়তো তাঁর স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ ক্যাসালোমাকে তার আগের রূপে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হতো।
স্যার হেনরী পেলাটের অস্ত্র
এখানে বসেই স্যার হেনরী পেলাটের জীবনীর ভিডিও দেখেছিলাম
স্যার হেনরী পেলাটের ব্যাক্তিগত বাগান
সূত্র:
১. ক্যাসালোমা
২. উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:১২