কুরবানীর ঈদ ছোটবেলা থেকেই একটা সেকুলার উৎসব হিসাবে উদযাপিত হতে দেখছি। এর উৎস ধর্মীয় হলেও 'প্রিয় জিনিস কুরবানী'র থিওরি নিয়া খুব বেশি বাঙালি মুসলমানের মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয়না। আমার যেসব হিন্দু বন্ধুরা টুকটাক গরুর মাংস খায় এই দিনটা তারাও বেশ মজা করেই উদযাপন করে দেখেছি। কার গরু কতো বড়, কার গরুর দাম কতো বেশি এই বিষয়গুলা দিয়া সামাজিক স্ট্যাটাস দেখানোর বা ধরে রাখার ব্যাপার আছে। এইখানে এসে গরু কুরবানী সামাজিক ক্ষমতাকাঠামো বিন্যাসের রিচুয়ালে পরিণত হয়। অনেকটা আগের কালের বিভিন্ন যজ্ঞের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজা যেমন তার সোস্যাল স্ট্যাটাস এবং ক্ষমতা জাহির করতেন, বিষয়টা তেমনি। যেকোন ধর্মীয় কুরবানী বা বলীরই এই ধরণের সামাজিক গুরুত্ব থাকে। এজটেকরা ধর্মীয় কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের মাংসের চাহিদা পুরোনের বানিজ্যিক সুবিধাও তৈরি করেছিলো। আধুনিক বাংলাদেশে কুরবানীর ঈদ ঘিড়ে গরু ছাগল ছাড়াও এদের চামড়া ব্যাবসা থেকে শুরু করে আরো নানাবিধ আনুসাঙ্গিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং জীবিকার সুবিধা গড়ে উঠেছে। ধর্মীয় গুরুত্ব শূণ্যের কোঠায় চলে গেলেও এর অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারনেই কুরবানী আরো দীর্ঘদিন বাংলাদেশে টিকে থাকবে।
যেকোন ধর্মীয় বা সেকুলার উৎসব কিংবা তার সাথে জড়িত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের সমালোচনা করা যেতে পারে। কুরবানীর ঈদএর ক্ষেত্রেও তাই। তবে কুরবানীকে বর্বর, অসভ্য, হিংস্র ট্রাডিশন বলে অনেকেই যে ধরণের সমালোচনা করেন তাতে যুক্তি তর্ক এবং সমালোচনার গভীরতা দুইই কম থাকে। বলি কসাইর কি দোষ? কসাইতো একটা জরুরি কাজ করে। গরুর মাংস আমি খাবো, কিন্তু এর কাটাকুটিকে বলবো অসভ্য, বর্বর, এইটা অনেকটা একধরণের ব্রাহ্মণ্যবাদী শ্রেণী চেতনার মতো। এই জাতীয় সমালোচনা ভারতবর্ষের সূদীর্ঘ বর্ণবাদী ও জাত পাত ভেদএর যেই ট্রাডিশন সেই ট্রাডিশনেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ব্রাহ্মণ্যবাদী শ্রেণী চেতনা সমাজের নানান প্রান্তিক এবং ব্যাবসায়ী জাতির লোকজনের সেবা ঠিকই নেবে বেঁচে থাকার এবং ভোগ করার তাগিদে, কিন্তু আবার তার পরিশ্রমী কাজের প্রচন্ডরকম বর্ণবাদী সমালচনা করবে, তাকে এবং তার কাজকে অসভ্য বর্বর বলবে, তাকে পাপী এবং তার কাজকে পাপ কাজ বলবে। এই কারনে কৃষকের উৎপাদিত ধানএর উপর ব্রাহ্মনের বেঁচে থাকে নির্ভর করলেও কৃষক তার চোখে জমিতে ধান ফলিয়ে পাপ কাজ করে, কারন লাঙলের ফলায় কতোনা ছোট ছোট জীব নিহত হয়। বড়ই আজব ধরণের মানবিকতার সংজ্ঞা তৈরি হয় এই ধরণের শ্রেণী চেতনায়। গরুর মাংস খেয়েও যারা কুরবানীকে অসভ্য ও অমানবিক বলেন তাদের মানবিকতার সংজ্ঞাও এই ধরণের এলিটিস্ট শ্রেণী চেতনায় তৈরি হওয়া। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে বাঙলায় যেসব বড় বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তার বড় অংশই গরু কুরবানী নিয়া। মধ্যযুগে ভারতের অনেক জায়গাতেই এই কুরবানী নিয়াই দাঙ্গা হয়েছে। গরু কুরবানীর শাস্তি স্বরূপ কসাইওএর পুত্রকে জবাই দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ৩০/৪০এর দশকে দেখা গেছে মাংসের উৎস হিসাবে গরু রপ্তানিতে কোন আপত্ত্বি না থাকলেও মুসলমানদের গরু কুরবানীতে ব্রাহ্মণ এবং হিন্দু উগ্রবাদীদের বিরাট আপত্ত্বি। এসব ঘটনার রেকর্ড আছে ইতিহাসে। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাষাতেই যখন বাংলাদেশের এই সময়ের মুক্তমনা হিসাবে পরিচিতরা মুসলমানের গরু কুরবানীর সমালোচনা করেন তখন কিঞ্চিত দুশ্চিন্তায় পরি আমি।
এর বাইরে যারা বলেন যে ছোট বাচ্চাদের সামনে কুরবানী দেয়া বা ছুড়ি চাপাতি নিয়া রক্তারক্তি কাটাকাটি ইত্যাদি কুৎসিত কাজ, এতে তাদের মনমানসিকতায় খারাপ প্রভাব পরে সেটাও খুবি অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা। তাইলে কসাইএর বাড়ির যেই ছোট বাচ্চাটা ছোটবেলা থেকে কসাই হয়ে ওঠে ছুড়ি চাপাতি নিয়া রক্তারক্তি কাটাকাটির মধ্য দিয়া তারা কি কুৎসিত হয়ে বড় হয়, হিংস্র হয়ে বড় হয়? বাংলাদেশের তাবৎ খুন খারাবি কি এইসব কসাই ছোটলোকের বাচ্চারা করে? আমি ছোটবেলায় মুরগি জবাই দিয়েছি অনেকবার। বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগি আসার আগে অনেকেরই দিতে হয়েছে। আধুনিক শ্রম বিভাজনের কারনে মুরগি জবাই দেয়া এখন আমার কাজের মধ্যে পরেনা। হয়তো আমার পুত্র হলে ভবিষ্যতে তার কাজের মধ্যেও পরবেনা। তাই বলে এটা মনে করার কোন কারন নাইযে সেইটা আমার পুত্র করলে সে অসভ্য, বর্বর এবং হিংস্র হয়ে উঠবে, কেননা তা হলে আমি ব্রয়লার মুরগিগুলা কিছু অসভ্য, বর্বর, হিংস্র মানুষের কাছ থেকে কিনে থাকি।
কৃষিজীবী নাগরিক সমাজে যখন শিকারজীবীরা মিশে যেতে বাধ্য হয়েছে তখন থেকেই কুরবানী বা বলীর ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ট্রাডিশনের সূত্রপাত। শিকারীর জঙ্গল কেটে কৃষকএর নগর তৈরি হয়েছিল, শিকারীর তাই সেই নগরে কসাই হতে হয়েছে। বাঙলার ব্রাহ্মণ্যবাদী শ্রেণী চেতনায় এই কসাই বরাবরি ছোটলোকের জাত, অচ্ছুৎ। গরু কুরবানী দেয়া মুসলমানও এই শ্রেণী চেতনায় ছোটলোকের জাত, অচ্ছুৎ। গরু কুরবানীর সমালোচনা করতে গিয়া মুসলমানবিরোধী এই জাতীয় বর্ণবাদী শ্রেণীচেতনা আয়ত্ত্ব করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১২:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



