ফেলানী মামলার বিচারের নামে হলো প্রহসন। সেখানেও গুরুত্ব পেলো ভারতীয়দের দেশাত্ববোধ।অক্ষুন্ন থাকলো তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। নুয়ে গেলো মানবিকতা। কেনো মানবাধিকার নিয়ে মিছে গান গায়?
ফেলানীর খুনিরা বেখসুর খালাস পায়।
হায় বাংলাদেশ ! ৭১ এর ভুমিকায় কৃতজ্ঞচিত্তে যাদেরকে সম্মানীত করে আসছো সেই প্রথম থেকে, তারাই বারবার রক্তাক্ত করেছে তোমার সীমান্ত। কাটাতাড়ের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিয়েছে বোন ফেলানীর যন্ত্রণামাখা নিথর শরীর। যেন সেখানেই ঝুলে আছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজ পতাকা। আমার জাতীয়তা।
তবে এটিও ঠিক যে বিচার প্রক্রিয়াতো আন্তর্জাতিক আদালতে হয়নি। হলে হয়তো সেখানে ফেলানীর হত্যার ঘটনায় ন্যায় বিচার পেতো বাংলাদেশ ।কেননা বিএসএফের নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানীর বিচার হয়েছে। এটি হয়তো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা।তাই খালাস পেয়ে গেলো খুনি। তাকে নির্দোষ প্রমান করার মধ্য দিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিলো, আমি আমার সীমান্ত নিরাপত্তার স্বার্থে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মানুষকে পাখির মত গুলি করে মারবো এবং সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কিছু নেই। নিজ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশী ভারত করতে পারে এমনটি। আমরাও করেছি। বিডিআরের গুলিতে বিএসএফ মারা যাওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। তবে সাধারণ নিরিহ মানুষ হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মত বিশ্বের আর কোন সীমান্তে হয় কিনা আমার জনা নেই। এমনকি ভারত-পাকিস্থান সীমান্তের কোন কোন এলাকায় দু-দেশের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ উত্তেজনা থাকলেও এত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেনা।
তাহলে কি ভারতের কাছে অনেক বেশি নতজানু মনোভাব প্রকাশের কারণেই আমাদের অবস্থান দূর্বল হয়ে পড়ছে?
ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ফেলানীর কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি ছড়ায় লিখেছেন:
আমাদের কূটনীতিবিদগণ ঝানু
ভারতের কাছে সদা থাকে নতজানু।
লাথি খায় গুঁতো খায় মুখে তবু হাসি
ভারতের দাদাগিরি খুব ভালোবাসি।
ভারতের অন্যায় আচরণগুলো
কোনোদিন কমবে না জানি একচুলও।
সীমান্তে মানবতা কেঁদে মরে তাই—
ফেলানীরা খুন হয়, সুবিচার নাই...
গণতান্ত্রিক দেশ!! ভারী আফসোস!!
ভারতের আদালতে খুনি নির্দোষ!
গুলি ছুঁড়বার তরে সদা অস্থির
বিএসএফ দাদা তুই বীর মহাবীর
খুনে রাঙা হতে তোর হাত নিশপিশ
ঠুসঠাস গুলি করে লাশ ফেলে দিস
এপারে বাংলাদেশ ওপারে ভারত
সীমান্তে খুলেছিস লাশের আড়ত
নিয়মিত গুলি করে বাঙালি মারিস
আমাদের সঙ্গেই কেবল পারিস
ভারতের সীমান্তে আছে মহা চীন
ওইদিকে ছুঁড়েছিস গুলি কোনোদিন?
সাহসটা কী রকম আছে দেখি তোর
থাকে যদি কলিজায় এতোটুকু জোর
চীনদেশে গুলি করে দেখা মিছিমিছি
গুলিতে উড়িয়ে দেবে ওরা তোর বিচি...
(মানবাধিকার নিয়ে মিছে গান গাই
করজোরে ফেলানীর কাছে ক্ষমা চাই...)
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩
সীমান্ত হত্যা বন্দ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোনমোহনের প্রতিশ্রুতির কথা বেশ পুরানো। ২০১০ এ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে মৌখিক ভাবে মোনমোহন বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তখন দেশে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি উচ্চকন্ঠে বলেছিলেন, সীমান্তে আর নীরিহ মানুষের ওপর গুলি চালাবে না বিএসএফ।তারপরও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। ২০১৩ সালের শুরুতেই হত্যা হয় চার বাংলাদেশী। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোন পথ এখনও বের হয়নি। তবে একের পর এক মিলছে প্রতিশ্রুতি। যদিও এসব প্রতিশ্রুতির কথা বলছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে এটির কোন প্রমান মেলেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলানীর বিচারের বেখসুর খালাস পেলো অভিযুক্ত বিএসএফ।
এ বছরের ৩ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী স্বস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি একজন বাঙালি আত্নীয়তার সম্পর্কে আমাদের জামাইবাবু। নড়াইলের ভদ্রবিলা গ্রামের জামাই তিনি। বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি শ্বশুড় বাড়ি ঘুরেও গিয়েছিলেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেয়ার সময় থেকে দেশের বিভিন্ন মহলে প্রত্যাশার আলো উঁকি দেয় যে এখন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গাঢ় হবে এবং সীমান্ত হত্যাকান্ডসহ নানা ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কূটনীতির বরফ গলতে শুরু করবে। মনে করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হবেন । যদিও তাঁর স্ত্রী শুভ্রা দিদি এখন আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। কিন্তু তার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে চিত্রা নদীর ধারে। শিল্পি এস এম সুলতানের জন্মস্থান নড়াইল সদরের তুলারামপুরে আছে ভারতের রাস্ট্রপতির স্ত্রীর শৈশবের অনেক স্মৃতি। ১৭ বছর বয়সে সাত পাঁকে বাঁধা পড়ে এ-পার বাংলার নড়াইল ছেড়েছিলেন শুভ্রা ।
রাষ্ট্রপতি জামাইবাবু, বিচার চাই না, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করুন।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে চলতি বছরে আট জন বাংলাদেশী ভারতের বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।যদিও গত ১২ জুন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ দাবি করেছেন, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে কোনো বাংলাদেশী নিহত হয়নি। অথচ তার বক্তব্যের মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেও যশোর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত হন।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন বন্ধে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ-ভারতের যে ক’টি অমীমাংসিত ইস্যু বাংলাদেশের মাথাব্যথার কারণ তার অন্যতম হলো সীমান্তে বিএসএফের হত্যা-নির্যাতন। ২০১১ সালে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ বাংলাদেশী। এর পরের বছর সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ৩৬ জন বাংলাদেশী নাগরিক হত্যাকান্ডের শিকার হন। এর মধ্যে ৩৪ জনই বিএসএফের হাতে সরাসরি খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৯৮ জন। এই সময়ে ৬৪ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট এক হাজার ৪৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে সীমান্তে। এর মধ্যে ৯৬৭ জনই বিএসএফের হাতে খুন হয়েছেন। ইতিমধ্যে ফেলানীর বিচারের নামে প্রহসন করায় পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) তিব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




