পর্ব - ০১,আপলোড ০৬/০৯/২০১৩
পর্ব - ০২,আপলোড ১০/০৯/২০১৩
--------------------------------------------------------------------
পর্ব - ০৩
এক ধরণের খোচা লাগা যন্ত্রণা কুন্ডুলি পাকাচ্ছে বুকের ভেতর। ঘুম নেই দু চোখে। রাতের নিরবতা ছাপিয়ে গেছে ঝিঝি পোকার ননস্টপ ডাকাডাকির তিব্রতায়। এরই মাঝে থেকে থেকে কুকুরের গোঙানী। অবশ্য ঝিঝি পোকারা একটু বিরতি দিলেই, কানে ভেসে আসে বাড়ির পেছনের বাঁশঝারের পাতায় পাতায় ঘসা খাওয়ার মৃদু শব্দ। বেশ লাগে। মিষ্টি একটা সুর। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে শেষ হয় র্নিঘুম রাত। পাশের বাড়ির মোরগটা গলা ছেড়ে ডাক দিলে টের পাই হয়েছে ভোর।
আজ লতা নিখোঁজের দশম দিন। এখনও সন্ধানহীন অবস্থায় রয়ে গেছে বিষয়টি।এসময়ের মধ্যে অগ্রগতি বলতে থানায় জিডি করা, পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দেয়া এবং তালিকা করে ২ শ ৫৭ জনকে লতার অন্তর্ধানের খবর মোবইল করে ও স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে জানানো।
নীলফামারির ডিমলা উপজেলার নাউতারা, গয়াবাড়িসহ আশেপাশের গ্রামে মানুষের মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে তার অন্তর্ধানের খবরটি। বিশেষ করে স্থানীয় পত্রিকায় এ সংক্রান্ত নিউজ বের হওয়ায় জেনে গেছে প্রায় সব মানুষ। কেউ বলছে, "মাস্টরের বউ পলিয়েছে," কেউ বলছে, জ্বেনে নিয়ে গেছে, কেউ কেউ রহস্যর গন্ধ খুঁজছে।আর এদিকে "নীলফামারি বার্তা" নামের দৈনিক পত্রিকায় ঘটনাটি রহস্যজনক বলে ইঙ্গিত দেয়ায় কথার হাত-পা গজিয়ে চলে গেছে বহুদূর ।
গতকাল সকালে বাসায় এসেছিলেন নাউতারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি লতার আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে বেশ কৌতুহল দেখালেন। ডিমলা থানার ওসি মোস্তফা কামাল নাকি মোবাইল করে তার কাছে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন, সেকথা বললেন বেশ ভাবের সাথে। সেটির প্রমান দেখাতে তিনি কয়েকবার ওসি সাহেবের মোবাইলে সাত সকালে কল দিলেন। কিন্তু ওসি সাহেব রিসিভ করলেন না। নিশ্চয় এত সকালে তিনি ঘুম থেকে ওঠেননি। তাকে চতুর্থ দফা রিং না দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব ঘরের মধ্যে পাইচারি শুরু করলেন। সামনের বৈঠকখানা থেকে উঠে বেড রুমের কাছে এসে থেমে গিয়ে বললেন, তোমার বউয়ের একটা ছবি দাওতো দেখি।
ছবির এ্যালবম তাকে দেবো বলে হাতে নিলাম। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, একটু উঙ্ষতা নেয়ার জন্য কি লোকটা লতার ফটো দেখতে চাইছে? শুনেছি তিনি নাকি খুব ধর্মপরায়ণ মানুষ। দু-বার হজ্বও করেছেন। কিন্তু তার চলাফেরা ও উঁকি ঝুঁকি মারার স্বভাব নিয়ে আড়ালে আবডালে সমালোচনা করে এলাকার মানুষ। লতা নিজেওতো একদিন বলছিল, বলা নেই, কওয়া নেই, হুটহাট করে বাড়ির উঠানে চলে আসেন চেয়ারম্যান কাকা।
এইতো গত বর্ষায়। তখন ঘরের সাথে এ্যটাচ বাথরুম বানানো হয়নি। লতাকে গোসল করতো হতো কলপাড়েয়। সেই সময় সদর দরজা খোলায় ছিল। লোকটা হনহন করে নাকি ঢুকে পড়ে বাড়ির উঠানে। কাশিও দেয়নি। কলপাড়ে চাদর দিয়ে আড়াল করে গোসল করছিল লতা। চাদর একটু ফাকা করে লতা দেখেছিল, ঘরের বারান্দায় উঠে তিনি দু:খবন্ধু বলে দু'বার ডাক দিলন। সারা শব্দ না পেয়ে ফিরেও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কলপাড়ে লতার পায়ে ধাক্কা লেগে বালতিটা উল্টে যায়। শব্দ কানে যেতেই চেয়ারম্যান সাহেব কলপাড়ের কাছে গিয়ে কে ... কে বলে ডাক মারেন। লতা চুপ করেছিল।
কত খারাপ মানুষ! দুপুর দুইটার সময় আমি কখনও বাড়ি থাকি। কলেজে তখন ক্লাস নেয়া চলে। আর বাড়ি থাকলেও দুপুর দুইটার সময় গোসলে যাবোনা। তাছাড়া পুরুষ মানুষ কখনও চাদর দিয়ে আড়াল করে গোসল সারে। উনি জেনে বুঝেই কলপাড়ে গেছিলেন।
সেদিন রাতে খাওয়া শেষে বিছানায় গেছি দুজনা। লতা আমার শরীরে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বেশ অভিমানের সুরে বললো, ঘরের লগে পাকা বাথরুম কবে কোরবা?
এই তো করে ফেলবো।
কলপাড়ে চাদর ঢেকি স্নান করতি আমার ভাল লাগেনা।
আচ্ছা, ঠিক আছে। সামনের মাসে কাজে হাত দেবো। এবার একটু বুকের ভেতরে আসো লক্ষীটি।
আসতাছি। তার আগে বলো, আমাগো চেয়ারম্যানের কি দিনের বেলা কোন কাম-কাজ নাই?
কেনো? হঠাৎ চেয়ারম্যান কাকার কথা বলছো।
ছবির এ্যলবাম হাতে নিয়ে কতক্ষুণ চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলাম জানিনা। হাত থেকে যখন চেয়ারম্যান সাহেব এল্যবামটা টেনে নিলেন, তখন যেন ঘোর কাটলো। গায়ে গুতো মেরে চেয়ারম্যান সাহেব বললো, কোন জগতে হারালে গো দু:খু?
না কাকা। লতার কথা মনে আসলো।
চেয়ারম্যান কাকা পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলেন। আর মাঝের মধ্যে আহ: বাহ: সুন্দর, দুজনকে বেশ ভাল লাগছে, সত্যি দারুণ বউ তোমার, উহ: এটিতে অনেক সুন্দর লাগিছে, এমনই ভাবে তিনি তাঁর অনুভুতি ব্যক্ত করতে থাকলেন। আমি নীরবে চেয়ে রইলাম। চেয়ারম্যান সাহেব ছবি দেখা শেষ করতে করতে বললেন, আচ্ছা দু:খবন্ধু, এক কাজ করলে কেমন হয়?
কি কাজ কাকা?
গোটা নীলফামারিতে মাইকিং করিয়ে দেই। খুব বেশি খরচা করতে হবেনা।
সেটি মন্দ বলেননি । কিন্তু গত দু'দিনে সৈয়দপুর, রংপুর ও দিনাজপুরের সব কয়টা সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ করেছি।
নীলফামারির স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়েছো?
নিয়েছি। এমনকি সদর হাসপাতালের মর্গেও গেছি। আমার লতা কোথায় গেলো চেয়ারম্যান সাহেব?
দু:শ্চিন্তা করিও না। আমার সাথে যোগাযোগ রাখিও। আচ্ছা, এখন আমি চলি। ও, ভাল কথা, মনের মধ্যে কোন সন্দেহ উদয় হলে আমাকে জানাইতে ভুল করিও না।
ঠিক আছে।
চেয়ারম্যান চলে গেলেন। আমি সদর দরজাটা লাগিয়ে আসলাম। কলপাড়ে এসে হাতমুখ ধুতে ধুতে মনে হলো লতা সেদিনের ওই ঘটনা নিয়ে পরে আর কিছু বলেনি আমায়। বদমায়েশ চেয়ারম্যান বুড়ো কি সেদিন সরিয়ে ফেলেছিল কলপাড়ের চাদর? সত্যি সত্যি যদি সরিয়ে ফেলতো, তাহলে ?
কি যা তা ভাবতে শুরু করেছি। সেদিন অসম্মানজনক তেমন কিছু হলে নিশ্চয় বলতো লতা। নাকি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপন করে ফেলে সংশ্লিষ্ট ভিকটিম। জানিনা, পরে অবশ্য একবার ওই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। লতা নিজে থেকে কিছু বলেনি। হয়তো বলার মত কিছু নয়।
তবে গত দুই-তিন মাস ধরে খেয়াল করছিলাম, তার চলাফেরা ও কাজকর্মে অলসতা ও বেখেয়ালী মনোভাব দিনকে দিন বাড়ছে। সে স্বভাবগত ভাবে একটু আত্নভোলা। কিন্তু সে নিজের যত্নের ব্যাপারেও খুব বেশি উদাসীন হয়ে পড়লে তা অস্বভাবিক বলে মনে হতে থাকে আমার । একই সাথে আরও পরিলক্ষিত হলো যে, সে সৌন্দর্য্য হারিয়ে রোগা-কাহিল ও দূর্বল হতে শুরু করেছে। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু করি । পরিস্থিতির যৎ সামান্য উন্নতি হয়। তবে তার আচরণগত কিছু সমস্যা ভাবিয়ে তোলে। এসব নিয়েই গত মাসে ডাক্তারবন্ধু মনোচিকিৎসক মহিত দেবনাথের সাথে মোবাইলে কথা বলি। স্কুলে আমরা তাকে মুহিত বলে ডাকতাম। সে প্রাথমিক বিবরণ শুনে ধারণা করে লতার আচরণগুলো মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয় ।
মুহিত নিজে পাগলের ডাক্তার বলে মানুষের অসুস্থতার কোন সিমটমের কথা শুনলেই মানসিক রোগী মনে করে বসে, তা ঠিক নয়। লতা সত্যি সত্যি মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছিল। তারপরও সেদিন থানায় ওসি সাহেবেরে সাথে আলাপকালে লতার মানসিক অসুস্থতার কথা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়নি। বলিনি, কারণ কথা প্রসঙ্গে ওসির আরও হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। তাছাড়া ডাক্তার বন্ধু আস্বশ্ত করে যে লতার পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশি দিন সময়ও লাগবেনা।
মুহিতের পরামর্শে লতাকে ঢাকায় এনে প্রথমে উঠেছিলাম টিপু সুলতান রোডে দূর সম্পর্কের এক পিসির বাসায়। নীলফামারি ফিরে আসার আগের দুইদিন বন্ধুর অনুরোধে তার ওখানে রাত্রিযাপন করলাম।ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই খুব ভাল মানুষ। ওর বউ বেশ বুঝদার টাইপের মেয়ে। মনোচিকিৎসকের বউ বলে কথা! সেও হাফ ডাক্তার! তবে পুরোমাত্রায় গৃহিনী। শহরে থাকা বউরা যে গেও গ্রাম থেকে আসা মানুষদের এত খাতির-যত্ন করতে পারে, তা না দেখলে বুঝতে পারতোনা লতা।
সপ্তাহখানেক ঢাকায় ঘুরাঘুরি করার ফলে লতার অসুস্থতার ভাব কাটতে শুরু করে । ডাক্তার বন্ধু অল্প কয়েকদিনের একটি কোর্স দেয় এবং কিছু টিপসও দিয়ে দেয় মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। কিন্তু কেনো লতা মানসিক রোগী হয়ে পড়ছিল, সেটির পেছনে প্রত্যক্ষ কোন কারণ না থাকলেও পরোক্ষভাবে একাধিক কারণ আছে বলে জানিয়েছে মুহিত। তবে জেনেটিক ব্যাপার খুব বেশি দায়ি নয়। তার মতে শাররীক অসুস্থতার মধ্যে চলতে থাকা বিষন্নতাই এক সময় সৃষ্টি করে মানসিক চাপ। এটি কখনও ধীরে ধীরে, কখনও অতি দ্রুত প্রসার লাভ করে। "সিজোফ্রেনিয়া" নামে একধরণের মানসিক রোগের লক্ষণ লতার ভেতরে আছে বলে জানায় মুহিত। ঠিকমত চিকিৎসা করা না হলে "ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস" নামে আরও একটি জটিল মানসিক রোগ জন্ম নেয় মন ও মস্তিস্কে ।
কথা প্রসঙ্গে মুহিত জানিয়েছিল, কিছু রোগী আছে যাদের ভেতর সিজোফ্রোনিয়া ও ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের বৈশিষ্ট্য গুলো একই সাথে বিদ্যমান থাকে। এধরণের রোগীর ভেতরে চলমান মানসিক সমস্যাকে বলে সিজোঅ্যাফেকটিভ ডিসঅর্ডার। আশার কথা হলো লতার ভেতরে সিজোফ্রেনিয়ার দু-একটি লক্ষণ থাকলেও বাইপোলার ডিসঅর্ডার তার মস্তিস্কে বাসা বাধেনি। তবে লতার এই পরিস্থিতির পেছনে আমি অনেকাংশে দায়ী বলে সেদিন দোষারোপ করে মুহিত।
সে আমার খুব কাছের বন্ধু। ঠাকুরগাঁ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আমরা একই বছর ম্যাট্রিক পাশ করি। মুহিত অবশ্য লেখাপড়ায় খুব একটা ভাল ছিল না। ক্লাস এইট পর্যন্ত তার রোল ছিল ২০ এর ওপাশে। বরং ১০ এর মধ্যে থেকেছি আমি। কিন্তু মেট্র্যিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে এসে আমি করলাম ফেল। পরপর দু'বার সাইন্স নিয়ে ফেল করে শেষে মানবিক নিয়ে পেলাম সেকেন্ড ক্লাস। মুহিত তথন মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। পরে সে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেলো জার্মানি। আর এদিকে ইতিহাসে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে নীলফামারির ডিগ্রি কলেজে আমি শুরু করলাম প্রভাষক জীবন।
(চলবে...)
আগামী ১৭ সেপ্টম্বর মঙ্গলবার সকালে ৪র্থ পর্ব।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




