পর্ব ০১, আপলোড ০৬/০৯/২০১৩
পর্ব ০২, আপলোড ১০/০৯/২০১৩
পর্ব ০৩, আপলোড ১৩/০৯/২০১৩
-------------------------------------------------------------------
ঢাকায় মুহিতের বাসা থেকে আসার সময় অনেকগুলো ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছিলাম। মেডিকেল সাইয়েন্স বিশেষ করে হিউম্যান ব্রেনের ওপর গবেষণাধর্মী কয়েকটি বইও কৌতুহলবশত চেয়ে নেই। মুহিত তাতে কোন আপত্তি করেনি। তবে সে একটি কথা বলেছিল, এইসব জার্নাল পড়ে যেন আমি আমার সহধর্মীনি লতাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনায় পতিত না হই। এটি ঠিক যে লতার ভেতরে মানসিক রোগ বাসা বাধতে শুরু করেছে, যা একটু পরিচর্যা, একটু চিকিৎসা পেলেই সুস্থ হয়ে যাবে।
নীলফামারি চলে আসার পর এতদিনেও বইগুলো দেখা হয়নি। দুপুরে খাওয়ার পর বইগুলো নিয়ে বসলাম। যদিও লতা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই উবে গেছে আমার কোন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে। খিদেও যেন লাগেনা আগের মত। খেতে হয়, তাই খাই।
বলতে গেলে গত কয়েকদিন ধরে আমার তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে বাড়ির পাশের দুই প্রতিবেশী।সংসারেতো এখন কেউ নেই। একজন বিবাহিত কর্মজীবী পুরুষ মানুষের পক্ষে একা একা রান্না করে খাওয়া বেশ ঝামেলার কাজ। মেসে থাকাকালীন সময়ে অভ্যাস থাকলেও বিয়ের পর তা কেটে গেছে। আমার প্রতিবেশীরা অনেক ভাল। বিশেষ করে সোমা বৌদি। আমি বাড়িতে ফিরলেই ছোট ছোট বাটিতে তরকারি আর এক থালা ভাত নিয়ে তিনি চলে আসেন। আমার খাওয়া শেষ হলে তবেই বাড়ি ফেরেন। আজইতো গল্পে গল্পে সোমা বৌদিকে বলছিলাম, সেই বেকারত্বের দিনগুলিতে একসময় অভিমান করে বাড়ি ছাড়া হই। আমার বাবা ছিলেন খুব জেদি এবং মেজাজি মানুষ। মায়ের সাথে যে খুব ভাল আচরণ করতেন, এমনটি মনে পড়েনা। আমার প্রতি তাঁর যৎসামান্য ফিলিংস ছিল কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দিহান। তিনি কখনও আমাকে বাড়ি ফিরে আসতে বলেননি। আমিও তাই যোগাযোগ রাখিনি বছরের পর বছর। তারপর একদিন শুনলাম বাবা মারা গেছেন। তারও কিছুদিন পর ছোট ভাইও মারা গেলো সড়ক দূর্ঘটনায় । মা থেকে গেলেন বড়দা'র সংসারে। বাবার যা সম্পত্তি অল্পকিছু ছিল, তা পুরোটাই হাতিয়ে নিয়েছেন দাদা।
বৌদির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ঠাকুরগাঁ থেকে নীলফামারি কি খুব বেশি দূর? তারা কি আমাকে খবর দিতে পারতো না!
বৌদি বললেন, ওই সব নিয়ে ভেবে মনটাকে আরও ভারী করে তুলোনা। এমনিতেই তুমি লতার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে মনকষ্টে আছো।
অনেকক্ষণ ধরে ম্যাগাজিন গুলোর পাতা উল্টে যাচ্ছি অনর্থক। পড়তেও ইচ্ছে করছেনা। এভাবেই উল্টাতে উল্টাতে একটি শিরোনামে এসে থেমে গেলাম। এটির বাংলা অনুবাদ করলে মানে দাড়ায় "মানসিক রোগীর আত্নহত্যার প্রবণতা।" লেখার একেবারে শেষে এসে দেখলাম এটির লেখক ভারতীয় একজন গবেষক ও সাংবাদিক। তিনি তার লেখায় মানসিক রোগীদের আত্নহত্যার প্রবণতা নিয়ে অসংখ্য ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেখানে মার্কিন Psychiatrist Robins Eli রচিত গবেষণাধর্মী বই The Final Months থেকে অনেক কিছু উদ্ধৃত্তি করেছেন।। এছাড়া আরও কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে লেখার শেষে। Psychiatrist Robins Eli তাঁর গবেষণায় এমন ১৩৪ জন মানুষের উদাহরণ দিয়েছেন, যারা সকলে মানসিক রোগ থেকে আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়।
একটি লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলাম। গবেষক লিখেছেন, ১৯৭৪-এর জুলাইয়ের এক দিন। ফ্লোরিডার "চ্যানেল ফর্টি" টেলিভিশন চ্যানেলের সঞ্চালিকা ক্রিস্টিন চুবুক তাঁর সহকর্মীদের বললেন, তাঁর নিজের অনুষ্ঠান ‘সানকোস্ট ডাইজেস্ট’ শুরুর আগে তিনি এক্সট্রা একটা লাইভ নিউজ প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করবেন। তার আগে কোনও দিনই ক্রিস্টিন এ রকমটা করেননি, তাই সহকর্মীরা একটু অবাক। ক্রিস্টিন মুচকি হেসে নিউজ অ্যাংকর-এর চেয়ারে বসলেন, সামনে নিউজ কপি।
প্রথমে দু’তিনটে ন্যাশনাল নিউজ, তার পর স্থানীয় একটা রেস্তোরাঁয় গোলাগুলির খবর পড়লেন, তার পর বললেন, ‘চ্যানেল ফর্টি যেমন যে কোনও রক্তারক্তির সর্বশেষ ও তরতাজা খবর আপনাদের সামনে দেখায়, ঠিক সে রকমই একটা অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড এখন আপনারা দেখবেন।’ বলেই ডেস্কের নিচে ব্যাগের মধ্যে রাখা পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলভার তুলে নিয়ে ডান কানের পিছনে ঠেকিয়ে গুলি করলেন।
কী সাংঘাতিক! এটা আবার কী কাহিনী! এমন মানুষও আছে । আমি আবার পড়তে শুরু করলাম........ ক্যামেরাম্যান মানুষটি প্রথমে ভেবেছিলেন ক্রিস্টিন বুঝি মজা করছেন, কয়েক মুহূর্ত পরেই ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া, নিউজ ডেস্কের ওপর ধড়াম পড়ে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটা দেখে বুঝলেন, কী হয়ে গেল। নিমেষে হইহই গোলমাল, চ্যানেলটা হঠাৎ অন্য একটা রেকর্ডেড অনুষ্ঠান দেখানো শুরু করল। টিভির সামনে বসে থাকা বহু দর্শক হতভম্ব, অনেকেই ভয় পেয়ে টিভি-অফিসে ফোন করে জানতে চান, গুলির দৃশ্যটা বানানো তো?
কী চুপিসারে, অথচ কী প্রকাশ্যেই না চলে গেলেন ক্রিস্টিন! তিনি কি সত্যি সত্যি মানষিক রোগী ছিলেন? নাকি ব্যতিক্রম কিছু করে দেখানোর ইচ্ছে থেকেই তিনি নিজের জীবন নিয়ে খেললেন। সেটিও যদি হয়ে থাকে, তবে বলবো, তিনি মানষিক রোগের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছিলেন। এমন অবস্থায় পৌছানোর পর কারোর আশ্রয় হয় পাগলাগারদে, কেউ করে ফেলেন আত্নহত্যা। তাই বলে মানসিক রোগে আক্রন্ত হওয়ার কারণেই যে সব আত্নহত্যা সংঘটিত হয়, তেমনটি নয়। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অনেকে নিজ শরীরে কেরাসিন ঢেলে আগুনে পুড়ে প্রকাশ্যে আত্নহত্যা করে। কিছুদিন আগেই এমন একটি ঘটনার কথা জানলাম। যদিও ৬৩ সালের ঘটনা। কিন্তু সেটি ওই সময় বিশ্বব্যাপি বেশ আলোড়ন তুলেছিল। তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রোমান ক্যাথলিক সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রকাশ্যে আত্নহত্যা করেছিলেন একজন সন্ন্যাসী। ভিয়েতনামের হো চিন মিন শহরে ঘটে সেই সন্ন্যাসীর প্রকাশ্যে আত্নহত্যার ঘটনা। সেটি অবশ্য মুহিতের কাছ থেকে নিয়ে আসা এই বইতে দেয়া নেই।
ঘটনার বিবরণ ছিল এমনই যে, কয়েকজন সাংবাদিককে ডেকে এনে তিনি তাদের সামনে বসেন পদ্মাসনে। কিছুক্ষণ পর একটি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে ছুয়ালেন নিজের শরীরে। সম্ভাবত আগে থেকেই দাহ পদার্থ সঞ্চালিত হয় এমন কোন কিছু তিনি শরীরে মাখিয়ে রাখেন। মুহুর্তেই তার লকলকে শরীরে জ্বলে ওঠে আগুন। সেই আগুনের গ্রাসে দগ্ধ ওই সন্ন্যাসীর শরীরটা একটুও নড়েনি, মুখ থেকে বেরোয়নি অস্ফুট কোনও আওয়াজও। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর একজন ফোটোগ্রাফার সেই দহনচিত্র ক্যামেরাবন্দি করে "ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো অব দ্য ইয়ার’"এর সম্মান কুড়িয়েছিলেন ।
ক্রিস্ট্যানা বা ওই সন্ন্যাসী যেকারণেই আত্নহত্যা করুক না কেনো, বা তারা মানসিক রোগী ছিল, কি ছিল না, তা নিয়ে কোন কৌতুহল নেই আমার। আমি বিশ্বাস করি লতা জীবিত আছে এবং সে আত্নহত্যা করতে পারেনা। মনোচিকিৎসক বন্ধু মুহিতের সাথে আজও সকালে এ প্রসঙ্গে কথা হলো দীর্ঘ সময়। সে বলছিল, লতার ভেতরে সিজোফ্রেনিয়া'র (SCHIZOPHRENIA) লক্ষণ যেহেতু সামান্য পরিমানে ছিল, সেহেতু ধারণা করা যায় যে মনের ভুলে হঠাৎ করে বাড়ির বাইরে চলে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখানে সবচেয়ে দু:শ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, লতা একজন নারী। কোন খারাপ মানুষের খপ্পরে পড়ে গেলে তার জীবনের পরিণতি কোন পথে ধাবিত হবে, তা সহজে অনুমান করা যায়। মুহিত বলছিল, তুই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে থাক যেন তেমন কিছু না ঘটে। তবে এটুকু নিশ্চিত থাক বৌদি মানে তোর বউ আত্নহত্যা করেনি।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শুনতে পেলাম বাইরে অনেক মানুষের চিল্লাচিল্লি এবং ছুটাছুটির শব্দ। ধুপ করে বিছানা ছেড়ে চলে এলাম জানালার কাছে। দেখতে পেলাম শত শত মানুষ ধানক্ষেত পেরিয়ে হণ্যেরবিলের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
কি হয়েছে সেখানে?
এমন সময় হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে আসলেন সোমা বৌদি। সাথে তার মেয়ে শ্যমলী। হাফাতে হাফাতে বৌদি বললেন, হণ্যেরবিলের ওখানে একটি লাশ পড়ে আছে। চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। ফুলে ব্যাঙ হয়ে গেছে।গায়ে নাকি কোন কাপড় নেই।
কি বলছো বৌদি?
হ্যা, একটু আগেই শ্যামলীর ছোট কাকু সেখান থেকে ফিরলো। বলছে সম্ভাবত ওটা কোন নারীর লাশ। হাতে একটি বালা আছে।
(চলবে...)
আগামী পর্ব ২০/০৯/২০১৩শুক্রবার।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৫৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




