পর্ব - ০১, আপলোড ০৬/০৯/২০১৩
পর্ব - ০২, আপলোড ১০/০৯/২০১৩
পর্ব - ০৩, আপলোড ১৩/০৯/২০১৩
পর্ব - ০৪, আপলোড ১৭/০৯/২০১৩
-------------------------------------------------------------------
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসছে । ধানক্ষেতের আল ধরে পিপিলিকার মত আসছে মানুষ হণ্যেরবিলে । যদিও লাশের কাছে বাতাসে ভাসছে শরীর গুলিয়ে ওঠা তীব্র গন্ধ। তবুও কমছেনা উৎসুক মানুষের ভিড়। নাক চেপেই যেতে হচ্ছে লাশের কাছে। ইতিমধ্যে বমিও করে ফেলেছে দুজন। "মানুষ পচা গন্ধ" টা বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ গন্ধ। সেই গন্ধ প্রিয় মানুষের হলেও কাছে যাওয়া যাইনা, ছুয়ে দেখা হয়না। কী অদ্ভুত মানুষের শরীর!
হাসপাতাল থেকে আসা দুজন ডোম শিতলপাটিতে পেচিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধলো লাশ। সেখানে উপস্থিত থানার দারোগা আমাকে আবারও ডাক দিলেন। ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই তিনি বললেন, আপনি তাহলে নিশ্চিত এই "লাশটি" আপনার স্ত্রীর না?
- না, দারোগা সাহেব। সে কোন মতেই আমার স্ত্রী না। যদিও লাশটির চেহারা বুঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু আমার স্ত্রীর শরীরের গঠন এমন না।
আপনি এক কাজ করুণ, হাসাপাতালে চলে আসুন। মর্গে ঢুকে ভাল করে আবার দেখে নিতে পারবেন।
- সেটির বোধ হয় কোন প্রয়োজন নেই দারোগা সাহেব। আমার স্ত্রীর উচ্চতা পাচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি।এই লাশের হাইট পাচ ফুটেরও কম বলে মনে হচ্ছে।
সেখানে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বেশ কয়েকজন আমার কথা শুনে মাথা ঝাকালো। তাদের মধ্যে থেকে দাড়িমুখে মাঝ বয়সী একজন বললেন, "মাস্টোর মশাই ঠিকই কইছেন। তাঁর বাড়িওয়ালী অনেক উচা-লম্বা।" এরমধ্যে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকলো সোমা বৌদির মেয়ে শ্যামলী । দারোগাকে উদ্দেশ্য করে সে বললো, "লতা কাকী রোজ আমার মাথার চুল বেধে দিতো।কাকীকে আমি ভাল মত চিনি। এ লাশ লতা কাকীর না।"
সূর্য্য ডুবে গেছে। হণ্যেরবিলে মানুষের জটলা তখনও কমেনি। একটি ভ্যানে লাশ উঠিয়ে মর্গের পথে রওনা হলো পুলিশ। তার আগে সুরতাহাল রিপোর্ট তৈরি করলেন দারোগা সাহেব। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে সাক্ষ্যি হিসেবে তিনজনের নাম ঠিকানা নেয়া হলো।বিশেষ করে আমার নামও নেয়া হলো সাক্ষ্যি হিসেবে। সুরতাহাল রিপোর্টে দারোগা সাহেব লিখলেন, "আমি এস আই হারুণ স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পাইয়া অদ্য চার ঘটিকায় ডিমলা উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত হণ্যেরবিলের উত্তর-পূর্ব কোণ হইতে একজন মহিলার অর্ধ গলিত লাশ উদ্ধার করিয়াছি। তাহার বয়স আনুমানিক ২০ বছর । তাহার পরনে কেবল সাদা রঙের একটি কামিজ ছিল। ঘটনাস্থল হইতে নীল রঙের একটি ছেড়া সালোয়ার ও কালো রঙের একটি ওরনা এবং একটি বালা ( ডান হাতে পরিহিত অবস্থায়) উদ্ধার করা হইয়াছে। লাশ পরে থাকার স্থান হইতে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে পাওয়া গিয়াছে এক জোড়া হিল জুতো যাহা উদ্ধার হওয়া মৃত ওই নারীর বলিয়া প্রতিয়মান হইয়াছে। একই স্থান হইতে একটি রুমাল উদ্ধার করা হইয়াছে।
লাশের শরীরের বেশ কিছু স্থানে পচন ধরিয়াছে। তবে তাহার গলা ও পিঠের কাছে ফোলা জখমের দাগ রইয়াছে। ময়নাতদন্তের জন্য নীলফামারি সদর হাসপাতালের মর্গে লাশ প্রেরণ পূর্বক উপস্থিত গ্রামবাসীর মধ্যে তিনজন ব্যক্তির কাছ হইতে লাশ উদ্ধারকালীন সময়ের সাক্ষ্য গ্রহন করা হইয়াছে।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর এখন সব মানুষের জটলা আমাকে ঘিরে । গ্রামবাসী ধরেই নিয়েছিল উদ্ধার হওয়া লাশটি লতারই হবে। ঘটনাস্থলে না আসলে এমন গুজব হয়তো ছড়িয়ে পড়তো। কেননা সোমা বৌদির কাছে খবর পেয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমিও সারা পথ এমনটি ভাবছিলাম। আর মনে মনে বলে গেছি,
"সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ ।
বিনশ্বৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।
সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ ।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ।"
ইদানিং অধিক পরিমানে আমার নেয়া পড়ছে ভগবানের নাম। উঠতে-বসতে প্রতিক্ষণে, ভগবান যেন আমার অন্তর জুড়ে! আসলে বিপদগ্রস্থ হলে ধর্মের প্রতি মানুষের আসক্তি বেড়ে যায়। কিন্তু ধর্মের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের যে যোগাযোগ এবং দু'পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট "স্বার্থ ও শর্ত যুক্ত বিনিময়" সম্পর্কর প্রতি কখনও নির্ভরতা আসেনি আমার। এটা করলে ওটা হবে, এই করলে তাই পাবো, এতসব শর্ত ও নিয়ম কানুন কেনো? তাইতো ভগবানের কাছে সবসময় আমার আর্জি থাকে, "কৃপা কর গুরু সাধন, ভজন, পূজণ বিনা।"
এর আগেও হণ্যেরবিলে এসেছি । তবে কখনও লাশ দেখতে নয়। সারা বছর জুড়েই খুব নিরিবিলি এবং নির্জণ পরিবেশ থাকে এখানে। বিশেষ করে ভাদ্র মাসে বোর ধানগাছ বড় হতে শুরু করলে দিগন্ত জুড়ে থাকা সবুজের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় হণ্যেরবিল। একসময় এখানে মাছ চাষ করা নিয়ে খুনোখুনিও হয়েছে। মূলত পেশীশক্তি যার যত বেশি, তাদেরই আধিপত্য এই বিল এলাকায়। তবে গত ১৩-১৪ বছর ধরে বদলে গেছে হণ্যেরবিলে মালিকানা নির্ধারণের নিয়ম-নীতি। এটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের ওপর নির্ভর করে। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের দলের ছেলেপুলের হাতে চলে যায় পুরো নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয় প্রশাসনের যেন কিছুই করার থাকেনা।
এইসব ভাবছি, আর ধানক্ষেতের আল ধরে হেটে চলেছি ফিরতি পথে। কিন্তু আমার নাকে যেন এখনও লেগে আছে অজ্ঞাত ওই নারীর অর্ধ গলিত লাশের পচা গন্ধ। বুঝতে পারছি এই গন্ধটা আরও অনেকদিন লেগে থাকবে আমার নাকের পিছেপিছে। কিছুই করার নেই। এমন সময় বেজে উঠলো মোবাইল। রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম একটি নারী কন্ঠ।
আমি হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকেও তিনি হ্যালো..... হ্যালো....... বলতে থাকলেন। সম্ভাবত কলটি ওয়ান সাইড হয়ে যাচ্ছে। ওই নারী আমার "হ্যালো" বলা শুনতে পাচ্ছেননা। এরপর কেটে গেলো।
আমি কলব্যাক করলাম। শুনতে পেলাম বিজিটোন। আবারও কল দিলাম।বিজিটোন। যতবার দিতে থাকি, দেখি নাম্বর বিজি।
(চলবে .....)
২৪ সেপ্টম্বর ৬ষ্ঠ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




