somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাশগুলো বাঙালির, বাংলায় কথা বলে, বাংলায় করে প্রতিবাদ

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভয়াবহ বিষাক্ত এক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ। প্রতিদিনই দেখছি লাশ। পোড়া লাশ, গুলিবিদ্ধ ঝাজরা লাশ, কোপানো লাশ, ডুবন্ত লাশ, গলিত লাশ, বস্তাবন্দি লাশ!
লাশগুলো সব বাঙালির। বাংলায় কথা বলে। বাংলায় করে প্রতিবাদ। বাংলায় লেখে গান, গল্প-কবিতা, বাংলায় করে ধর্ম চর্চা, বাংলায় করে যুক্তি-তর্ক, বাংলায় দেয় মতামত।
লেখক, ব্লগার মুক্তচিন্তার মানুষ অভিজিৎ রায়কে চলে যেতে হলো অন্ধকারময় বাংলাদেশ ছেড়ে। ভাবতে কষ্ট হয়, ভয়ে কাঁপতে থাকে শরীর, একজন বাংলা ভাষাভাষি মানুষ, একজন ব্লগার, একজন লেখক যিনি তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা "বইমেলা প্রাঙ্গন" থেকে ফেরার পথে নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। ঠিক এমনই এক বই মেলা থেকে ফেরার পথে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রগতিশীল লেখক ও অধ্যাপক হুমায়ন আজাদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়।

আমরা কি প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল ও মুক্ত চিন্তার মানুষদের বাঁচতে দেবোনা?
ব্লগার অভিজিৎ রায়ের সাথে কখনও আলাপ-পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। তবে অনিয়মিত হলেও মুক্তমনা ব্লগের একজন নীরব পাঠক আমি। তাঁর লেখালেখির ধরণ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি হওয়ায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধর্ম, ভগবান বা সৃষ্টিকর্তা নিয়ে তিনি তাঁর ধ্যান-ধারণার প্রকাশ ঘটাতেন যুক্তিতর্কের আলোকে। জন্মগত সুত্রে পাওয়া তিনি তাঁর "হিন্দুত্ব" নিয়েও সমালোচনা করেছেন। অভিজিত তাঁর নিজের লেখায় বলেছেন, "রক্ত ছাড়া মুক্তি আসবেনা। চরম অন্ধকার ছাড়া আলো বোঝা যাবেনা।"
কিন্তু তাঁর ক্ষত-বিক্ষত কোপানো লাশ আর মিরপুরে পুলিশের সহায়তায় ঝাজরা হওয়া পরিবহন শ্রমিক সুমন দাস ও রবিনের গুলিবিদ্ধ লাশের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা আমি। দুটি লাশের মৃত্যু যন্ত্রণায় তারতম্য থাকলেও চলমান সময়ে লাশের মিছিলে যোগ হওয়া মুখগুলো আমাদের রাজনীতির নিষ্ঠুরতার করুণ পরিণতি। ক্ষমতা আগলে রাখা কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করার মিশনে তাই "আইটেম" হচ্ছেন কেবলই সাধারণ মানুষ, যারা খেটে খাওয়া বাঙালি, যাদের গাড়িতে কখনও উড়বেনা জাতীয় পতাকা, থাকবেনা পুলিশের নিরাপত্তা বলয়।
কেবল অভিজিত, বিশ্বজিত, রবিন বা সুমন নয়, কোন মানুষেরই পেটের চিন্তা, পরিবারের সুখ-দু:খ, অসহায়ত্বর কথা কখনও ভাববেনা রাষ্ট্র। বরং তাদেরই ট্যাক্স ও ভ্যাটের টাকায় আকাশে আকাশে, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবেন যারা, ভাল ভাল সুস্বাদু খাবারে যারা পেটভর্তি করে আসছেন বাংলাদেশ সৃষ্টিলগ্ন থেকে, তারাই আমাদের লাশের স্তুপ ডিঙিয়ে ক্ষমতাসীন হন, অথবা ক্ষমতা আগলে রাখতে চান জনগণের ভোটাধিকার ক্ষুন্ন করে।
অভিজিত নাস্তিক, না আস্তিক, সেটি বিবেচ্য নয়। তিনি আওয়ামী লীগ ঘেষা, নাকি বামপন্থি, নাকি ডানপন্থি, সেটিও কথা না। তিনি একজন লেখক। তিনি যুক্তির পথে হাটতেন। আমাদের নিষ্ঠুর রাজনীতি তাঁর পথচলা থামিয়ে দিলো।
আমরা যারা বাংলা ব্লগে লেখালেখি করি, তারা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ মানুষ, যারা নিজের আনন্দে লেখালেখি করেন, নিজস্ব মতামত, ধ্যান ধারণা একে অন্যের সাথে শেয়ার করেন। রাস্ট্রর নিয়ম-নীতি বদলে দেয়া, মানচিত্র বদলে দেয়া কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি করেননা ব্লগাররা। আমরা কারোর ধর্মচর্চায় বাধা দেইনা। বরং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি, লেখাপড়া ও চিন্তাশক্তির সমন্বয়ে করি ব্লগিং, যা কখনও কখনও রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মের দোষত্রুটি তুলে ধরে মাত্র।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন নানা পেশা ও বয়সের মানুষ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত থেকেই অসংখ্য লেখা আসতে শুরু করেছে দেশের বাংলা ব্লগগুলোতে। সামু ব্লগের নির্বাচিত পাতায় উঠে আসা লেখাগুলোর একটিতে ব্লগার মঞ্জুর চৌধুরী আহারে মুসলমান! আহারে ইসলাম! আহারে শান্তির ধর্ম! শিরোনামের লেখায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "আমি বাজি ধরে বলতে পারি ঐ সময়ে রাস্তায় কমসেকম এক দেড়শ মানুষ ছিল। প্রত্যেকে একটা করে মোক্ষম কিল দিলেই ওরা ভর্তা হয়ে যাবার কথা। আমরা বীর বাঙ্গালিরা পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরা পাঁচ বছরের শিশুটিকে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিতে পারি, কিন্তু এইসব জানোয়ারগুলিকে ঠিকই বীরদর্পে পালিয়ে যেতে দেই।
বাঙ্গালির বীরত্ব এখন ফেসবুক এবং টক শোতে নিন্দা জানানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর বেশি আমাদের কোন দৌড় নেই।"

অপর একটি লেখায় ব্লগার গোলাম দস্তগীর লিসানি বলেছেন, সরকার-বিরোধী এই দুই শক্তির মধ্যে ছায়াযুদ্ধ যখন প্রকট, তখন তাতে নাস্তিক ইসু ঢালতে পারলে লাভ কতটুকু, তা জামাতি শক্তি ইতোমধ্যেই জানে। নব্বইয়ের দশকে যখনি জামাতি রাজাকারগুলোর জন্য বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার হয়েছিল, তখনি 'নাস্তিক' 'নাস্তিক' সোরগোল তুলে তসলিমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে তসলিমাবিরোধী নাস্তিক বিরোধী আন্দোলন করে রাজাকার বিরোধী আন্দোলনকে মাটির সাথে সফলভাবে মিশিয়ে দেয়া গিয়েছিল।
ব্লগার অভিজিতকে নিয়ে অল্প কথায় নাস্তিকতা ও আস্তিকতার ইতিহাস তুলে ধরে একটি পোস্ট দিয়েছেন ব্লগার মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি ওই পোস্টে যথার্থ বলেছেন পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ দেয় মানুষের উপর জোড় করে আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতা চাপিয়ে দেওয়া হলে ফলাফল বিপরীত হয়
বাস্তবতা হলো, আমরা যাার ব্লগে লেখালেখি করি, সময় এসেছে সব মত, পথ ও বিশ্বাসের লেখকদের এক কাতারে সামিল হওয়ার। প্লিজ কোন ভেদাভেদ করবেননা। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা মন্তব্য করে বসি। তদন্ত ছাড়াই বলে দেই এটা অমুক গোষ্টির কাজ।
নাস্তিক হলে তাকে আস্তিকরা মারবেন,
মুক্তিযোদ্ধা হলে রাজাকাররা মারবে,
আওয়ামী লীগ হলে বিএনপি বা জামাত-শিবিররা মারবে,
মৌলবাদীরা মরলে নাস্তিকরা মারবে,
বিএনপি-জামাত মরলে পুলিশ মারবে,
- এমনই সব প্রচলিত ধ্যান ধারণা আমাদের চিন্তা-চেতনার জায়গায় পঁচন ধরাতে শুরু করেছে। দোষারোপের রাজনীতিতে জড়িয়ে আমরা কখনও প্রকৃত সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করিনা। এতে বাস্তবিক অর্থে লাভ হয় ওই শ্রেণীর, যারা আস্তিক ও নাস্তিকতার দ্বন্দে কৌশলে হাসিল করে নেই নিজেদের স্বার্থ । লাভ হয় ওই শ্রেণীর, যারা কখনও চায়নি বাংলাদেশ নামে কোন রাস্ট্রের জন্ম হোক।
একটি গবেষণা হওয়া উচিৎ, একজন "নাস্তিক" তার লেখালেখির মধ্য দিয়ে কতজনকে তার দলে টানতে পারেন। আমার মনে হয় খুব বেশি পারা যায়না। তাহলে একজন নাস্তিককে হত্যা করে ধর্মের কি লাভ ? তেমনই ভাবে একজন ধর্মান্ধ, মৌলবাদী অশিক্ষিত মানুষের বুকে বুলেট বিদ্ধ করে কিলাভ, যদি তার অন্ধত্ব ঘোচাতে না পারি।
এমনই নানা অসঙ্গতির উত্তর খুঁজে বের করার পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে সজাগ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। ব্লগাররা যেন এই নোংরা রাজনীতির প্রতিপক্ষ দমনের "ট্র্যামকার্ড" হিসাবে ব্যবহার না হন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪২
৫১টি মন্তব্য ৪৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×