somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পহেলা বৈশাখ ; পান্তা-ইলিশ ; অতঃপর আমরা

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। সারা বিশ্বের বাঙালিরা এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যোদয় থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

বাংলা সনের সংক্ষিপ্ত ইতিকথাঃ

হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।

এই দিনটিতে আসলে বাংলাদেশে কি হয়ঃ-
এই দিনটিতে বাংলাদেশে যা হয় তার নাম নিতে হলে অবশ্যয় তা মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম।

১. মঙ্গল শোভাযাত্রা কিঃ-
বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে মিশে আছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই শোভাযাত্রায় চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরন, রং বেরংয়ের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সে বছরই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীগন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে প্রথম বারের মতো। শোভাযাত্রায় থাকে বিশালকায় চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ বিচিত্র সাজসজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তারপরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, সে বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। নববর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রার স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম এমনটাই বলেছেন। তিনি জানান, তখন এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। তবে বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

২। বৈশাখী মেলাঃ- এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রায় আনাচেকানাচে বৈশাখী মেলা উৎযাপন করা হয় । সেখানে বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলি ক্রয়বিক্রয় করা হয়। মোরগ লড়াই, ষাড়ের লড়াই, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি খেলাধুলা হয়ে থাকে ।

৩। পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ ভাজাঃ-
পান্তা-ইলিশের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। কথিত আছে, পান্তা-ইলিশের সূচনা হয় ১৯৮৩ সালে রমনার বটমূলে। দৈনিক জনকন্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ ছিলেন এর উদ্যোক্তা। অন্যদিকে সাংবাদিক শহিদুল হক খান নিজেকেই এর উদ্যোক্তা বলে দাবী করেন। তবে বলা হয়ে থাকে, শহিদুল হক সাংবাদিক বোরহানের দুই বছর পর থেকে নিয়মিত পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের আয়োজন করে থাকেন। সেই হিসেবে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এই রীতির প্রবর্তক বলা যায় সাংবাদিক বোরহান আহমেদকেই।

পান্তা-ইলিশ কি পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতি?

পহেলা বৈশাখের উৎসবের সাথে পান্তা ইলিশ খাওয়ার কি সম্পর্ক? তাও আবার মাটির পাত্রে! বাস্তবিক অর্থে বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়, তাই এ প্রশ্ন। যতদূর জেনেছি, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে পান্তা ইলিশের প্রচলন শুরু হয় ১৯৮৩ সাল থেকে। এবং তা রমনার বটমূলে, এর উদ্যোক্তা ছিলেন সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের কোন্ ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি থেকে এ ধরণের উৎসবী খেয়ালী চিন্তার উদ্ভব তা জানিনা। এমন লেখাও চোখে পড়েছে যেখানে, পান্তা ইলিশের উদ্যোগের ইতিহাসের রচনা করা হয়েছে অত্যন্ত দম্ভ ভরে, যেন এটি একটি বিশাল মহান কাজ। যা বাংলা সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ আর সেই সাথে বাঙালীকে করেছে ধন্য।
ইতিহাসের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের সাথে পান্তা ইলিশ খাওয়ার কোন সম্পর্কতো নেই-ই, বরং রয়েছে এক ধরণের বৈপরীত্য । বর্তমানে পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের একটি সার্বজনীন উৎসব, এটি খুবই আনন্দের বিষয়।
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলের সাধারণ চর্চা সকালে পান্তা ভাত খাওয়া। মূলতঃ দুপুরে অথবা রাতে রান্না করা ভাত যাতে সকাল বেলা নষ্ট না হয় সেজন্য পানি দিয়ে রেখে খাওয়া হতো। বিদ্যুতের অভাবে তখন গ্রামাঞ্চলে খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ ছিলনা। একারণেই এটি প্রধানতঃ গ্রামাঞ্চলেরই চর্চা। এই চর্চাটি আর্থিক দিক দিয়ে সকল শ্রেণীর পরিবারেই ছিল। এই পান্তাই আজ পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম বিষয় যার সাথে ঐতিহ্যের কোন মিল নেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষয়টি তা হলো পান্তার সাথে ইলিশের সংমিশ্রণ, শুধু মারাত্মক নয়, মর্মান্তিকও বটে।
সার্বজনীন উৎসবের খাবারগুলো এমন, আর্থিক দিক দিয়ে সব শ্রেণীর মানুষেরই তা গ্রহণের সামর্থ থাকে। কিন্তু পহেলা বৈশাখের প্রধান খাবার যদি ইলিশ পান্তা হয়ে থাকে আর সে উৎসবকে যদি সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বলার চেষ্টা করি তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য তা অবশ্যই পরিহাসের। কারণ এই উৎসবের প্রধান খাবারটাই থেকে দেশের অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত। এই প্রেক্ষাপটে কি করে এটা সার্বজনীন উৎসব হলো ? কারণটি বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখেনা। জোড়া ইলিশ কিংবা কেজি ইলিশ যেভাবেই কেনা হোকনা কেন এই সামর্থ ক’জনের আছে? সেই হিসাব উৎসব বোদ্ধারা কখনও করেছেন বলে মনে হয়না।
তাছাড়া ইলিশ একটি অভিজাত মাছ। যে মাছ এদেশ ও জাতিকে আন্তর্জাতিকভাবে গৌরবান্বিত করেছে। যে মাছ সম্মানিত মেহমানদের আতিথেয়তার অন্যতম একটি উপাদান। তার সাথে বাধ্য হয়ে খাওয়া পান্তা ভাতকে অপূর্ব সমন্বয় করে বাঙালী সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার এই নিদারুণ উন্মাদনা সত্যিই ব্যথিত করে। ভাবিত করে এই দৈন্য দশা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে। বাঙালীর খাবারের সংস্কৃতির ইতিহাসে কে কবে কোনকালে আনন্দ করে, উৎসব করে পান্তাভাতের সাথে ইলিশ খেয়েছে ? আর বর্তমানে ইলিশতো এদেশের ধনীক শ্রেণী ছাড়া অন্যদের কাছে সোনার হরিণ বৈ কি ! ইলিশ এখন পরিণত হয়েছে পররাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কন্নোয়ন ও স্বার্থ উদ্ধারে লোভনীয়, মোহনীয় টোপ হিসেবে। সেই দুর্লভ ইলিশ দিয়ে কিনা বাংলার সার্বজনীন উৎসব!!!
প্রতিটি সংস্কৃতিকে ঘিরে চলছে শেকড়ের সন্ধান। আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতির অত্যাচারে সত্যিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ভুলতে বসেছি এই বোধোদয় থেকেই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে অসহায় উদ্বিগ্ন শ্রদ্ধেয় গুণীজনরা চালাচ্ছেন প্রান্তকর প্রচেষ্টা। আর অপর দিকে চলছে বাঙালীর পান্তা ইলিশের মাতামাতি। এই মাতামাতি এগিয়ে চলছে বেপোরোয়া গতিতে। আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে রাজধানীর রমনার বটমূলের আধুনিক আবিষ্কার এখন বৈশাখী উৎসবের প্রধান বিষয়। এটা এখন আর গ্রাম বাংলার উৎসব নয়, এটি এখন একটি নাগরিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। নগরবাসীর দিক নির্দেশনা মোতাবেক এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে যার কোন সংযোগ নেই। ১৫৫৭ সালে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। এটিকে বলা হয় “সন-ই-এলাহী”। মোট বার মাসের সমন্বয়ে এই সন। মূলতঃ কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্য বা সুবিধার্থে বাংলা সনের আবিষ্কার। বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। এ সময় কৃষক ঘরে নতুন ফসল তোলে। আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল থাকে। ধার-দেনা শোধ করে। মনের আনন্দে নতুন জিনিসপত্র কেনে। বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে। ব্যবসায়ীরা আগের বছরের বকেয়া আদায় করে, হিসাব নিকাষ চুকিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খোলে অর্থ্যাৎ হিসাবের খাতাকে করে হাল নাগাদ। এই হালখাতাকে ঘিরেই উৎসবের আমেজে এ দিন সকালে বিন্নি ধানের খই, দই, চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি আর দুপুরে খিচুরি, কৈ মাছ, রুই মাছ সহ বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবারের আয়োজন করে। তখন ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখের দিন ক্রেতাদের বিভিন্ন মিষ্টিদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়ন করত। সোনার দোকানগুলো এখনও ঐতিহ্যগত আনন্দের এই ধারাটি বজায় রেখেছে। ক্রমে এই উৎসবটি তখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। আর সেই হালখাতার উৎসবই এখন “পান্তা ইলিশের” উৎসব ! ! !

তথ্যসূত্রঃ-

১। "বাংলা বর্ষপঞ্জির জন্ম"। বইপত্র। ১৩ এপ্রিল ২০১২। সংগৃহীত ১৩ এপ্রিল ২০১৩।

২। প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ, মুহাম্মদ লুৎফুর হক & রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, নওয়াজেশ আহমদ, দৈনিক প্রথম আলো

৩। উইকিপিডিয়া

৪। দৈনিক আমাদের সময়

৫। পান্তা-ইলিশ কি পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতি, লেখকঃ মোরশেদা খাতুন দিলারা।

৬। ছবি নেট থেকে নেয়া।
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×