কেউ যদি প্রশ্ন করে যে আমাদের দেশের গনমাধ্যমগুলোর অবস্থা এখন কেমন তাহলে আমি লজ্জা পাব। আমার মনে আছে বছরখানের আগেও আমরা খুব গর্ব করে বলতাম বিশ্ববাসী যে ভারতকে প্রিন্ট মিডিয়ার রজধানী বলেন সেই খেতাবটি বোধহয় আর ভারতের থাকবে না। আমাদের হয়ে যাবে। পাটশিল্প নিয়েও এমন কথা আমরা শুনেছিলাম কয়েকবার যে পাট রপ্তানীতে ভারত কখোনোই আমাদের ধরতে পারবেন না। সেই কথা খুব বেশিদিন আমাদের বলতে হয়নি। এখন ভারত ঠিকই বিশ্বের এক নম্বর পাট রপ্তানীকারক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের ডাইল খাইয়া ঝিমায়।
যাই হোক আমি বলছি না যে আমাদের মিডিয়ার বর্তমান অবস্থার জন্য ভারত দায়ি। হয়তো আমরা নিজেরাই দায়ি। কিন্তু যেই দায়ি হোক আসল সত্য হল আমাদের দেশের মিডিয়া এখন পুরাই বিতর্কীত।
আমাদের দেশের মিডিয়ায় নিরপেক্ষতা বলে কোনো শব্দ নাই। আমার জানা মতে একমাত্র একুশে টেলিভিশন ও এর মালিক সালাম সাহেব আছেন যিনি নিরপেক্ষ। যিনি হাসিনা বা খালেদা কাউকে গোনেন না। ফলে তার পক্ষে কিছুটা নিরপেক্ষতা রাখা সহজ হয়েছে।
বর্তমান সময়ে দেশের মিডিয়ার নিরপেক্ষতা এইটুকুই। বাকি সবই নির্দষ্টি দল বা কোনো গোষ্ঠির পক্ষে আচরন করে। আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম বা এই টাইপের কিছু পত্রিকা আছে যারা একটি গোষ্টির পক্ষে লেখেন। এরা অনেক সত্য নিউজ যেমন দেন তেমনি কেউ কেউ অসত্য নিউজও দেন। যেমন আমার দেশ, সেদিন লাকিকে আঘাত করা নিয়ে এই আঘাত ছাত্রলীগ করেছে সেই নিউজটি সঠিকই দিয়েছিল কিন্তু যে যে ছাত্রলীগ কর্মীর নাম উলে্লখ করেছে তা ছিল ভুল। আবার দেখবেন সুশিল ঘরানা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে যারা ব্যস্ত সেই মিডিয়াগুলি পুরোপুরি অন্যরকম নিউজ দেয়। এরা ভুলেও জামাত শিবিরের পক্ষে কোনো নিউজ দিবে না। অর্থাত্ আপনাকে যদি সত্যিই দেশের খবর জানতে হয় তাহলে গন্ডাখানেক ভিন্ন ভিন্ন মতের পত্রিকা অথবা দেশের কমপক্ষে দশটা চ্যানেলের খবর দেখতে হবে। আর না হলে সরাসরি বিবিসি শুনতে হবে। মানে হল নিরপেক্ষ খবরটি জানতে আপনাকে দেশে এত মিডিয়া থাকতেও বিদেশী মিডিয়ায় ধর্না দিতে হবে। আমার ধারনা আমরা একটু অপরিপক্ক সময়ে স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। আর না হলে যে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের আমরা হারিয়েছি তাদের শূন্যতা এ জাতি আর পূরন করতে পারেনি।
ফলে এদেশে স্বাধীন সার্বভেৌম কোনো মিডিয়া গড়ে ওঠেনি। আপনারা দেখবেন এই শাহবাগ আন্দোলনেও কিন্তু জাতি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে এই মিডিয়াগুলোর কল্যানে। মিডিয়ার কল্যানেই এই আন্দোলনটিকে ২য় মুক্তিযুদ্ধ বলা হচ্ছে। আবার নাসি্তকদের আখড়াও বলা হচ্ছে। শাহবাগে যেমন লাখ লাখ লোক হয়েছে তেমনি আজ সারা বাংলাদেশে পুলিশি অ্যাকশন সত্বেও লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করেছে। এখন আগামী কালের পত্রিকায় যদি আপনি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটি পাওয়ার আশা করেন তবে তা হাস্যকর হবে। কারন কে লিখবে সত্য কথা? দেশের মিডিয়াগুলো তো স্পষ্টই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছে। কেউ মন্তব্য করতে পারে , বা কলাম লিখতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দরকারও নাই। কিন্তু নিউজের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা থাকা জরুরী। যা ঘটছে তাই বলতে হবে। সত্যিই যদি ব্লগার ইমরানের একপাশে ছাত্রলীগের সভাপতি ও অন্যপাশে ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারী থাকেন তো সেটাই লিখতে হবে। মিডিয়া যদি কাউকে বাঁচানোর জন্য কোনো তথ্য পাশ কাটিয়ে যায় তবে তা এ জাতির তথ্য অধিকারের সাথে বেঈমানী করা ছাড়া আর কিছুই না। আমি টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনি সংবাদের জন্য , আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতাদর্শ দেখার জন্য না। এসব মতাদর্শ তাদের উক্তিতে থাকতে পারে। যেমন মওদুত বললেন যে শাহবাগের আন্দোলন সঠিক না, আবার হানিফ বলল যে সঠিক। এখন পাঠক চিন্তা করে দেখবে কার কথা যুক্তিযুক্ত।কিন্তু সেই কনক্লুশনও যদি সংশি্লষ্ট পত্রিকাটি করে দেয় তবে পাঠকদের নিতান্তই অবমাননা করা হয়।
শাহবাগ আন্দোলনে কত পরিমান লোক ছিল , কোন কোন দলের লোক ছিল বা সবাই নিরপেক্ষ কিনা সেকথা স্পষ্ট মিডিয়ায় আসতে হবে। পাঠক বিবেচনা করবে যে তারা কি করবে। দুখজনকভাবে ওয়ান ইলেভেনে যারা এই দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল তাদের স্বপক্ষের মিডিয়াগুলো এখন একজোটে আবারো তাদের অনিরপেক্ষ চেহারা দেখানো শুরু করেছে। এসব কারনেই নিরপেক্ষ মানুষও অন্য পক্ষের খবর জানার জন্য আমার দেশ কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার ধারনা যারা অতিরিক্ত আমার দেশ কিনছে তারা প্রায়ই নিরপেক্ষ। কারন তারা এই দুই ধরনের খবরের কম্বিনেশন করতে চায়। এই কাজটি একজন সহ সম্পাদক বা সম্পাদকের করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই কাজটি এখন পাঠককেই করতে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো মানুষের বাক স্বাধীনতা কতটা দরকার? কেন দরকার? আসলে মানবতা ও সভ্যতা যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁেচে থাকার মজাটা দিতে হয় তবে তাকে স্বাধীনতা দিতে হবে এই পরিমান যে পরিমানে অন্যের ক্ষতি না হয়। এখন কথা হল আমরা কি স্বাধীন। এই সামুতেই আমি কি আমার মনের কথাগুলো সমস্ত নীতিমালা মেনেও বলতে পারব? আমার ধারনা যে পারব না। সব বলতে গেলে ব্যান খেতে হবে।
আমি গত বছর দুয়েক ধরে দেখছি সামুতে যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ বলে কোনো পোষ্ট দেয়া হলে তা ব্যান করা হয়। সত্য মিথ্যা আর যাচাই করতেও যাওয়া হয় না। কিন্তু তার পরেও সামুর বিরুদ্ধেই কিন্তু এই অভিযোগটি এসেছে যে সামু শিবিরের পক্ষের লেখালেখিতে মদদ দেয়। তাহলে কি হল, মিডিয়াকে দোষারোপ কিন্তু শুনতেই হয়। মিডিয়া যদি সত্যিই স্বাধীন থাকে তাহলেও দোষারোপই করবে সর্বোচ্চ। কিন্তু বিনিময়ে জনগনকে সঠিক সংবাদটি হয়তো দেয়া যাবে। আজকের একটি ঘটনা বলি, আজ কিন্তু জামাত শিবির অথবা ইসলামী ১২ দল , এদের মিছিল থেকে সাংবাদিকদের মারা হয়েছে। এই খবরটি সবাই দিচ্ছে। আবার ইটিভির সাংবাদিককে মারধোর করে ক্যামেরা ভেঙে ফেলেছে ছাত্রলীক। এই ফুটেজটি ইটিভি দেখাচ্ছে কিন্তু অন্য মিডিয়ায় আসছে না। দেখবেন আগামী কাল কিছু মিডিয়ায় শেষোক্ত ঘটনাটাই বেশি করে হাইলাইট করবে কিন্তু শিবিরের বিষয়টি আবার তারা লিখবে না। এভাবে মিডিয়াগুলি চামচায় পরিনত হচেছ।
বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করেছিলেন, তার পূর্বে কিন্তু দেশে একটি শ্রেনী এই বাকশালকে ২য় বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছিল। এই বাকশাল যে ২য় বিপ্লব তা বোঝানোর জন্য শত শত নিউজ হয়েছে, আর্টিকেল লেখা হয়েছে। শেষশেষ শুধু বাকশালের পক্ষ শক্তিই একমাত্র মিডিয়া দখল করে ফেলল। এর পরিনতিতে আমাদের দেশের মিডিয়ার স্বাধীনতা ভুলুণ্ঠিত হল। এবং পরিনতি কি কি হয়েছে সেই ইতিহাস তো আমরা সবাই ই জানি। পরে সামরীক শাসন এসে এই বাকশাল বন্ধ করতে হয়েছে।
সেই দ্বিতীয় বিপ্লবের পক্ষেও কিন্তু সাধারন জনগন দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আজও দেখবেন অনেকে বলবে বাকশাল ভালই ছিল। আবার অনেকে এটাকে ঘৃনা করে। মিডিয়ার দায় হল দুই পক্ষের কথাই সুষ্ঠু ভাবে তুলে ধরা। এবং মিডিয়া যাতে ব্যান না হয় , কোনো মিডিয়ার স্বাধীনতায় যাতে কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। এখন আবার শাহবাগকে কেন্দ্র করে ২য় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তার ক্ষেত্রেও নিউজে নিরপেক্ষতা রাখতে হবে। এই ২য় মুক্তিযুদ্ধে জনগনের কতটা আস্থা আছে আর কতটা নাই তা মিডিয়ায় স্পষ্টত আসতে হবে। যদি না আসে, যদি দেখা যায় মিডিয়া খুবই একপেশে আচরন চালিয়ে যাচ্ছে তবে তো অবধারিতভাবে এই এতগুলি মিডিয়া এদেশে থাকার আর দরকার থাকবে না। আমরা যদি এই এ্যাঙ্গেল থেকে সকল খবর পাই তবে তো বাকশাল আমলের মত চারটি পরাধীন পত্রিকার জগতেই ফিরে যাচ্ছি আমরা।
প্রথম আলো হোক আর আমার দেশই হোক যার যা দোষ, যার যা গুন স্পষ্টত বলতে হবে। শাহবাগ আন্দোলন যদি দলিয়করন হয় তবে তাও লিখতে হবে। আবার শিবিরের মিছিল থেকে যদি বোমা মারা হয় তবে তাও লিখতে হবে। একটি পত্রিকা কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান। তারা জনগনের কাছে সত্য প্রকাশে ওয়াদাবদ্ধ। তাদের বিশেষ কোনো মতাদর্শ প্রচার করতে হলে স্বাধীন গনমাধ্যম নয় এরা বেশ্যাবৃত্তি বা এই জাতিয় কোনো একপেশে ব্যবসা করতে পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




