বীর মুক্তিযোদ্ধা সমশের মবীন চৌধুরীর স্মৃতিগাথা.............
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসে আমি মেজর জিয়ার অধঃস্তন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলাম। মার্চের ১ তারিখ থেকে ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অ্যাডজুডেন্টের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ১১ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে আমরা সাতজন ছিলাম বাঙালি। আর ৩০০ সৈনিকের মধ্যে সকলেই ছিল বাঙালি। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন পাঞ্জাবি লেঃ কর্নেল আব্দুর রশীদ জেনজুয়া। আর মেজর জিয়া ছিলেন সহ-অধিনায়ক।
২৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে খবর আসে যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, যিনি ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠতম সামরিক অফিসার ছিলেন, তাকে হঠাত্ করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ব্রিগেডিয়ার আনসারিকে তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। এ খবর পেয়ে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই বিস্মিত ও আতঙ্কিত হই। এ খবরটা পেয়েই অষ্টম বেঙ্গলের সৈনিকরা উত্তেজিত হয়ে যায়। এদিকে, সেনানিবাস থেকে বিশ বেলুচ রেজিমেন্টের একটি প্রতিনিধি দল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দুটো ট্যাঙ্ক বিধ্বংসি কামান (যেগুলো আগেই আমাদের দিয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য) ফেরত নেয়ার আগ্রহ জানায়। আমাদের সৈনিকরা সেগুলো ফেরত দিতে রাজি হচ্ছিল না। এই চরম অস্থিরতার মধ্যে মেজর জিয়া, আমি এবং ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ ব্যাটালিয়ান সদর দফতরে গিয়ে হাজির হই এবং মেজর জিয়া বলেন, ‘এগুলো এ রাতে ফেরত দেয়া যাবে না। পরে দেখা যাবে।’ এরই মধ্যে ষোলশহর, যেখানে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল অবস্থিত ছিল এবং নতুনপাড়ায় অবস্থিত সেনানিবাসের মধ্যে ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। ষোলশহর রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার একটি রেল কার ষোলশহর রেল ক্রসিংয়ে নিয়ে ক্রসিংটা বন্ধ করে দেন। ফলে সেনানিবাস চট্টগ্রাম শহর থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২৫ মার্চ ১৯৭১। চারদিকে চরম অস্থিরতা। পরদিন সকাল ১০টার দিকে নবনিযুক্ত আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার আনসারির কাছ থেকে টেলিফোন আসে। অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে সেই টেলিফোনটি আমিই রিসিভ করি। আমাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জেনজুয়া তখন অফিসের বাইরে অবস্থান করছিলেন। আনসারী আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলেন, যে কোনো মূল্যে আজ বিকালের মধ্যে রেল কারটি অবশ্যই সরাতে হবে। এ খবরটা তোমার কমান্ডিং অফিসারকে জানাও।
ব্রিগেডিয়ার আনসারির এই বার্তাকে আমি নিজের হাতে লিখে যখন কমান্ডিং অফিসারকে দেখানোর জন্য রেল ক্রসিংয়ের দিকে যাচ্ছিলাম, পথে মেজর জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি উনাকে এই বার্তার কথা জানাই। উনি চমকে উঠে বললেন, এই রেল কারটি তোমাদের জীবন বাঁচাবে। এটা যাতে সরানো না হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা নিশ্চিত করো। বার্তাটি নিয়ে যখন আমি কর্নেল জিনজুয়ার কাছে দেই, তাত্ক্ষণিক তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, ব্যাটালিয়নের সমস্ত শক্তি প্রয়োজনে তিনশত সৈনিককে মোতায়েন করে রেল কারটি যেন সরানো হয়। কমান্ডিং অফিসারের এই নির্দেশের কথা যখন আমি মেজর জিয়াকে জানাই, তখন উনি বলেন, ‘তিনশত সৈনিক ব্যবহার তুমি করতে পার। কিন্তু বিশ্বস্ত কিছু সুবেদারকে দিয়ে তুমি নিশ্চিত করো, রেল কারে সৈনিকরা হাত লাগাবে কিন্তু কোনো শক্তি প্রয়োগ করবে না।’ মেজর জিয়ার সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমাদের সৈনিকরা রেল কারকে ধাক্কা দেয়ার ভান করে। কিন্তু কোনো শক্তি প্রয়োগ না করার কারণে সেই রেল কারটি ওখানেই পড়ে থাকে। এতে আমাদের অধিনায়কের হতাশা এবং রাগ বেড়েই যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত কারটির ব্রেক কেটে দিয়ে তা ওখান থেকে সরানো হয় এবং সেনানিবাসের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। এই অবস্থাতেও সময় সময় ইপিআরের অ্যাডজুট্যান্ট মেজর রফিক জানাচ্ছিলেন, রাজনৈতিক নেতারা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেননি—তারা কি করবেন। তারা নাকি তখনও ইয়াহিয়া খান সরকারের সঙ্গে সংলাপের চেষ্টা করছিলেন, একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে।
সেই ২৫ মার্চের কালো রাতে মধ্য রাতের পরপরই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে তারা প্রথম আক্রমণ চালায় সেনানিবাসের ভেতরে। যেখানে বেলুচ রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টারে লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীসহ প্রশিক্ষণাধীন শত শত বাঙালি সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই আক্রমণের খবর মেজর জিয়ার কাছে পৌঁছানো হয়। তাত্ক্ষণিকভাবেই উনি গর্জে উঠেন। বললেন, ‘উই রিভোল্ট’ (আমরা বিদ্রোহ করলাম)। মেজর জিয়ার সেই বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে করা হয়নি। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তিনি এই ঐতিহাসিক এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের তাত্পর্যতম সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করার পরপরই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের একস্থানে জড়ো করা হয় এবং একটি পানির ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের উদ্দেশে ঘোষণা দেন, উনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বলেন, ‘এখন থেকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ।’ উপস্থিত অফিসার ও সৈনিকদের সমর্থন চাইলে একবাক্যে আমরা সবাই একাত্মতা প্রকাশ করি। উনি আরও বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা শুধু নয়, এখন এই স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে। আমরা সবাই আমাদের প্রস্তুতির কথা ওনাকে জানাই। শুরু হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পূর্ববাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন মুহূর্তের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়।
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাতজন বাঙালি অফিসার এবং তিনশ’ সৈনিক আমাদের যেসব অস্ত্র ছিল, গোলাবারুদ ছিল, তা নিয়ে রেললাইন ধরে আমরা কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হই।
এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটে, যেটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রেললাইন ধরে যখন আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম, মেজর জিয়ার বাসভবনের পাশ দিয়েই আমরা পার হচ্ছিলাম। তখন আমি উনাকে স্মরণ করিয়ে দিই, বাসায় উনার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন, তাদের কি হবে। কোনো বিলম্ব না করেই উনি আমাকে বললেন, So are the families of the three hundred man who are coming with me. আল্লাহ দেখবে। Let’s go. সারারাত হেঁটে ভোরের দিকে আমরা কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করে নদীর ওপারে পটিয়ায় গিয়ে একটি বনের ভেতরে আমাদের অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করি। এরই মধ্যে ইপিআরের ৬৫ জন সৈনিক ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কাপ্তাই থেকে বিদ্রোহ করে আমাদের সঙ্গে কালুরঘাটে যোগ দেয়। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনী। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর বিকালের দিকে মেজর জিয়া সৈনিকদের উদ্দেশে আবার বক্তব্য রাখেন এবং বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতির একটি চিত্র অংকন করেন। তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকে দিয়ে শপথ পাঠ করান যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করব এবং প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দেব। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটাই ছিল, সবচেয়ে প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য শপথপাঠ।
কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টার, যেটাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করা হয়, মেজর জিয়া ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা সেখান থেকেই দেন। সেই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ এই ঘোষণায় তিনি বাংলাদেশ ও বাইরের সব বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য আহ্বান জানান। সর্বশেষে উনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ঘোষণা দেন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা।
মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং দিকনির্দেশনায় সম্মুখ সমরে লিপ্ত হলাম আমরা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে। ২৯ মার্চ উনি আমাকে এবং ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীকে একটি প্লাটুনের দায়িত্বে দিয়ে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা দেন। চকবাজারে আমাদের সেই প্রতিরোধ দুর্গের কারণে পাকিস্তান আর্মি কালুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে পারছিল না। একটানা চার দিন যুদ্ধে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এপ্রিলের ৭ তারিখে মেজর জিয়ার নির্দেশে মেজর মীর শওকত আলী ও আমি কালুরঘাটের কাছে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালাই। সেখানে পাকিস্তান আর্মির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকেই নিহত হন এবং সেখানে পাকিস্তান আর্মি পিছপা হতে বাধ্য হয়।
এক পর্যায়ে ১১ এপ্রিল কালুরঘাট সেতু রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী এবং আমি গুরুতরভাবে আহত হই। আমাদের সৈনিক ও সহমুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমি পাকিস্তান আর্মির হাতে বন্দি হই। সেখানে উপস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আমাকে মারধর করেন এবং পরে তাদের একটি গাড়িতে করে আমাকে চট্টগ্রাম সার্কিট
হাউসে নেয়া হয়। চট্টগ্রামে নেভাল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিত্সার পর আমাকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাখা হয় এবং তার দুই সপ্তাহ পর ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
বন্দি অবস্থায় চরম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার আমার ওপর চালানো হয়, যদিও গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে আমি শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ছিলাম। বন্দি অবস্থায় আমাকে কোনো চিকিত্সা দেয়া হয়নি। আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতাসহ ছয়টি অভিযোগ এনে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে ছয়টি অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, তার সবক’টিতে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত ছিল। আল্লাহর রহমতে সেই বিচার প্রক্রিয়া পাকিস্তান সরকার শেষ করতে পারেনি। কারণ ১৬ ডিসেম্বরে তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ আট মাস আট দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ আমি দেখতে পাই।
যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থায় ন্যূনতম চিকিত্সা থেকে আমি বঞ্চিত ছিলাম। চিকিত্সাহীনতার কারণে আমি শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাই। আজও সেই পঙ্গুত্ব আমি বহন করে বেড়াচ্ছি। তবে এই পঙ্গুত্বই আমার গর্ব।
লেখক : যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ জিয়ার সহযোদ্ধা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




