somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরায নগরী দর্শন - শেষ পর্ব

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শিরাযে আজ শেষ দিন। সকালে রয়াল শিরায হোটেলের জম্পেশ বুফে নাশতা করে হোটেল থেকে চেক আউট করে বের হতে প্রায় ১০ টা বেজে গেল। রৌদ্রোজ্জল দিন, বেশ গরমই লাগছিল বলা চলে। আমার পরিবার এবং আমাদের সহভ্রমনকারী লেমনের পরিবার, দু’টো গাড়ি রওনা হয়ে গেলাম, পেছনে ফেলে আসলাম সা’দী, হাফেয এর স্মৃতি বিজড়িত নগরী “শিরায”!

আমাদের প্রথম গন্তব্য হল শিরায থেকে ৬০ কি.মি. উত্তর পূর্বে অবস্থিত পেরসপোলিস বা “তাখত-এ-জামশিদি”। আসলে এ দিন আমাদের যা জায়গাগুলো দেখার পরিকল্পনা সেগুলো শিরাজ থেকে তেহরানের দিকে যেতে পড়ে। তাই পরিকল্পনাটাও সেভাবে করেছিলাম যাতে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে দেখতে আমরা তেহরানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৮ অব্দে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য হাখামানশি (Acheamenid dynesty) রাজ্যের সম্রাট দারিয়ুশ দ্য গ্রেট বর্তমান ফারস প্রদেশের রাজধানী শিরায নগরী থেকে ৬০ কিমি উত্তর-পূর্বে কুহে রহমত বা মেহর পর্বতের উত্তর-পশ্চিম অংশকে নির্বাচিত করে তাখতে জামশিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র রাজা খাশাইয়ার শাহ ও নাতি রাজা প্রথম আরদাশির ক্রমান্বয়ে এর বিভিন্ন মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এক লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই বিশাল স্থাপত্য নির্মাণে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বছর সময় লেগেছিল।


তাখতে জামশিদ


তাখতে জামশিদের প্রবেশ পথ

তাখতে জামশিদ মহলটি তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র নোরুজ (পারস্যের নববর্ষ উৎসব) ও মেহরগান উৎসবটি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালনের জন্য। যেহেতু হাখামানশি সাম্রাজ্য তৎকালীন দুনিয়ার সর্ববৃহৎ রাজ্য ছিল, তাই নওরোজ উৎসবে শামিল হতে সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ উপঢৌকনসহ এই মহলে হাজির হতেন। যেমন; শুশ নগরীর প্রতিনিধিরা জীবন্ত সিংহ ও যুদ্ধাস্ত্র, আর্মেনিয়ার প্রতিনিধিরা স্বর্ণ, রৌপ্য ও ঘোড়া, বাবেল বা ইরাকের প্রতিনিধিরা স্বর্ণখচিত পোশাক ও মহিষ, বাইজেন্টাইন প্রতিনিধিরা বিভিন্ন মূল্যবান পাথর খচিত পাত্র ও ঘোড়া, সোগদি প্রতিনিধিরা ভেড়া ও এর চামড়া দ্বারা তৈরি পোশাক, কৃষ্ণসাগর ও আনাতোলির প্রতিনিধিরা স্বর্ণখচিত পোশাক ও ঘোড়া, ভারতের প্রতিনিধিরা যুদ্ধাস্ত্র ও খচ্চর বাদশাহকে উপহার দিতেন। দারিয়ুসের নিজস্ব প্রাসাদে প্রতিনিধিদের খাবার পরিবেশন করা হত। যা এখনো তাখতে জামশিদের গায়ে অংকিত রয়েছে!



খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে গ্রিক বীর অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট তাখতে জামশিদ আক্রমণ করেন এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে একে ধ্বংস করেন। পেরসপোলিসকে ১৯৭৯ সালে ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর ২১ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ১৫ দিনের নোরুজের ছুটিতে এখানে উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ছবিতে দেখুন, লোকজন প্রচুর, কারণ আমরাও এই নোরুজের ছুটিতে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম।



ঈগল গ্রিফিন (হোমা)



অসমাপ্ত প্রবেশ দ্বার










পেরসপোলিস দেখতে দেখতে সত্যিই হাজার বছর আগে চলেগিয়েছিলাম। সূর্য তখন একেবারে মাথার ওপর, গণগণে রৌদ্র। বাস্তবে ফিরে এসে ছুটলাম পরবর্তী গন্তব্য “নাগশে রোস্তাম”। জায়গাটা পেরসপোলিস থেকে ১২ কি.মি. উত্তর পূর্বে। এখানে মূলতঃ পাহাড়ের গায়ে রয়েছে হাখামানশি (একামেনিড) এবং সাসানিদ সাম্রাজ্যের রাজাদের কবর। অনেক আগের ইরানিরা এটি জানত না, পাহাড়ের গায়ে যেহেতু ঘোড়ার ছবি এবং সমর যুদ্ধের বিরত্বগাথা আকা আছে, তাই তারা এই জায়গার নাম তাদের জাতীয় বীর রোস্তামের নামে করে। এছাড়া নাগশে রোস্তামের এই এলাকার মধ্যে একটি স্থাপনাকে জোরোস্তার ধর্মের কা’বা বলা হয়।



রাজাদের কবর


নাগশে রোস্তাম


জোরোস্তার ধর্মের কা’বা

নাগশে রোস্তামের বাইরেই উটে চড়ার ব্যবস্থা ছিল। দুই ছেলেকে নিয়ে কিছুক্ষণ উটের পিঠে ঘুরে নিতেও ভুললাম না। :)

বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে, ক্ষুধায় পেট চো চো করছিল। নাগশে রোস্তাম থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে হাইওয়েতে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে আবার চলতে লাগল গাড়ি। শিরায থেকে তেহরানের দূরত্ব ৯৫০ কি.মি.। পরের গন্তব্য “পাসারগাদ” যেটি কিনা শিরায নগরী থেকে তেহরানের দিকে ১৩৬ কি.মি.। বিকেল চারটা নাগাদ পৌছে গেলাম পাসারগাদ বা পারস্যের মহান বীর ও একসময়কার বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য হাখামানশি (Acheamenid dynesty) রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি! এটি ইরানের সর্বপ্রাচীন সমাধি, যেটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৯০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গ্রিক বীর অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই সমাধিতে দাঁড়িয়ে সদম্ভ উক্তি করেছিলেন, “সমাধির প্রত্যেকটি ইট পাথর উপড়ে ফেল! দেখতে চাই কে ছিল সেই মহান বীর! যার অধীনে গোটা বিশ্বে ছড়ি ঘুড়িয়েছে পারস্য সাম্রাজ্য!”

পাসারগাদ মূলতঃ সাইরাস দ্য গ্রেট এর শাসনামলে হাখামানশি (একামেনিড) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ থেকে ৫৩০ এর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এটিও ইউনেসকো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। হাখামানশি সম্রাট ক্যামবাইসিস দ্বিতীয় সম্রাটের আগ পর্যন্ত পাসারগাদই ছিল রাজধানী। পরে ক্যামবাইসিস দ্বিতীয় বর্তমান খুজেস্তান প্রদেশের সুসাতে তার রাজধানী সরিয়ে নেন। পরবর্তীতে সম্রাট দারিয়ুস পেরসপোলিসে রাজধানী স্থাপন করেন। যাহোক, ছবিতে দেখুন এবার।


সাইরাস দ্য গ্রেট এর সমাধি


প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ

এটিই ছিল আমাদের এই ভ্রমনের শেষ দর্শনীয় স্থান। বিকেল ৬ টা নাগাদ আমরা পাসারগাদ থেকে তেহরানের উদ্দেশ্যে রওনা দেই, সাথে নিয়ে ফিরি অনেক অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি। সত্যিই একটা অসাধারণ ভ্রমন ছিল এটি। ভোর ৪ টার দিকে তেহরান পৌছাই আমরা প্রায় ৮১৪ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে। এই ট্রিপে ৫ দিনে আমি প্রায় ২০০০ কি.মি. এর বেশী গাড়ি চালিয়েছিলাম যেটা আমার জন্য ছিল একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ধন্যবাদ ইরানের মহাসড়ক নির্মানকারী সংস্থাকে।


তেহরান থেকে শিরায...

আমার এই পোস্টের বেশ কিছু তথ্য আমি নিয়েছি আজকে (২৫ ফেব্রুয়ারী) একুশের বই মেলায় মুমিত আল রশিদ ভাইয়ের প্রকাশিত “ইরানের পথে প্রান্তরে” বই থেকে। মুমিত ভাই মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, বর্তমানে ইরানের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি গবেষক। উনি ইরানের প্রায় ২২ টি প্রদেশ ঘুরেছেন এবং খুবই তথ্য সমৃদ্ধ এই বইটি লিখেছেন। যারা ভিন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য জানতে ইচ্ছুক তারা বই মেলার ১২ নম্বর প্যাভিলিয়নে কাকলী প্রকাশনী থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন।



সবাই ভাল থাকবেন, ইনশাআল্লাহ দেখা হবে ইরানের অন্য কোন জায়গা নিয়ে লেখা ভ্রমন পোস্টে। :)

নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ১
নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ২
নোরুজ ঘোরাঘুরি - শিরাজ নগরী দর্শন - ৩
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২১
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×