somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ২.১৩ শেষ (একটি কথ্য ইতিহাস-উইং কমান্ডার (অব.) এস. আর. মীর্জা )

১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্র: স্বাধীনতার পর সকল মুক্তিযোদ্ধাকে কোনো একক সরকারি ব্যবস্হার অধীনে আনা হলো না বা তাদেরকে কাজে লাগানো হলো না। এর ফলে সমাজে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো- এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
উ: মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জন্য বিরাট একটা ফোর্স ছিলো। সেই ফোর্সকে বঙ্গবন্ধু সরকার একদম ভুলে গেলো। তাদের জন্য কিছু করা হলো না বা তাদেরকে নিয়ে কিছু করা হলো না। তাদেরকে বাড়ি চলে যেতে বলা হলো। অথচ উচিত ছিলো এদের সকলের একটা তালিকা তৈরি করে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তুলে তাদেরকে দেশ গড়ার নানামুখী কাজে লাগানো। এটা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বুঝেছিলেন। সে জন্য তিনি মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বুঝলেও অন্য নেতারা সেটা বোঝেননি। বঙ্গবন্ধু মিলিশিয়া বাহিনী গঠন পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন। এর ফলে সমাজে ক্রমশ: এক ধরনের অস্হিরতা দেখা দিলো।

আর একটি বিষয়ে বলবো। স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি যে শাসন ব্যবস্হা ও কাঠামো ছিলো- সেই কাঠামো ও প্রশাসন ব্যবস্হা রেখেই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করলেন। একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্হা যা মানুষের প্রত্যাশা ছিলো- সেটা তিনি করলেন না। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ন ভুল ছিলো। এই কাঠামো ভেঙে নতুন করে স্বাধীন বাংলার উপযোগী করে প্রশাসন ব্যবস্হা গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিলো। অনত: যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো তাদেরকেই মূল দায়িত্ব দেয়া উচিৎ ছিলো। স্বাধীনতার পর পরই আপনারা শুনেছেন বহুল আলোচিত,বহুল উচ্চারিত সিকসটিনথ্‌ডিভিশনের কথা। যুদ্ধের পর পরই কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষরে হাজার হাজার সার্টিফিকেট দেয়া হলো যারা কোনোদিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো না। এ দেশের মানুষ এদেরকেই ঐ বাহিনী নামে অভিহিত করলো। সিকস্‌টিনথ্‌ডিভিশন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরে যারা মুক্তিযোদ্ধা হলো।

মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ব্যবস্হার অধীনে না আনার ফলে যা হলো- সেটা তো আপনি আজো দেখতে পাচ্ছেন। সারা দেশে বিশৃঙ্খলা এসে গেলো। যে স্পিরিট নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিলাম- সেই স্পিরিটটাকে কিভাবে আস্তে আস্তে ধ্বংস করা যায়- সেই চেষ্টা চলতে লাগলো। এ জন্য অনেক ঘটনাও কাজ করেছিলো। যেমন- বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে স্বাধীনতা বিরোধী প্রায় সকলকে ক্ষমা করে দিলেন। আর দালাল আইন যেটা করা হয়েছিলো- সেটারও ছিলো অনেক ফাঁক ফোকর। এই ফাঁক-ফোকরের ভেতর দিয়ে অনেক হত্যাকারী,নারী নির্যাতনকারী জেল থেকে বেরিয়ে আসলো। যারা প্রকৃত কালপ্রিট,যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলো- তাদের তো কোনো বিচার হলো না। এভাবে কমবিনেশন অব অল দিস ফ্যাক্টরস্‌কাজ করায় স্বাধীনতার পর যে সুন্দর বাংলাদেশের কল্পনা আমরা করেছিলাম--যেখানে সবাই সুখে থাকবে,কেউ না খেতে পেয়ে মারা যাবে না,গরীব থাকবে না,সম্পদের সুষম বন্টন হবে- এ সবের কিছুই হলো না।

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি আরো দু’একটি কথা বলতে চাই। আমার মতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ওয়াজ লুটেড ফোর টাইমস্‌। প্রথমে আমরা লুট শুরু করি ১৯৭১ সালের মার্চে। তারপর তো আমরা বেরিয়ে গেলাম এবং আশ্রয় নিলাম ভারতে। দিনাজপুর এলাকার কথা আমি জানি,হিন্দুরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলো,তখন কিছু কিছু মুসলমান হিন্দুদের সাহায্য করছিলো ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। অন্য এলাকাতেও এমনটা দেখা গেছে। পাবনায় আমার আত্মীয় ছিলেন রাজা মিয়া,তিনি হিন্দুদের চলে যেতে সাহায্য করেছেন,পঞ্চগড়ের চলনবাড়ি,এটা বোদা থানায়,সেখানে আমার এক মামা ছিলেন- তিনি হিন্দুদের চলে যেতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু বর্ডারে কিছু কিছু মুসলমান কেবল দিনাজপুর এলাকাতেই নয়- অন্যান্য বেশ কয়েকটি এলাকায়ও মুসলমানরা বিশেষ করে ময়মনসিংহ এলাকার মানুষ হিন্দুদের সমস্ত কিছু- বাসনপত্র,টাকা-পয়সা,সোনাদানা যা ছিলো সব,এমন কি কাপড় চোপড় পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়। এইসব অসহায় মানুষগুলো রিক্ত হস্তে ভারতে পৌছায় কেবল প্রাণে বাঁচার জন্য।

আপনারা তো জানেন একটা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছিলো সারা দেশেই। আমি যখন ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও যাচ্ছিলাম তখন শেরপুরে,বগুড়ায় সংগ্রাম কমিটিকে কাজ করতে দেখেছি। ঠাকুরগাঁওয়ের এম.পি ছিলো আমার বন্ধু মানুষ। অন্যান্য নেতাদেরও আমি চিনতাম যেহেতু আমি ঠাঁকুরগাঁওয়ের মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে যখন ইপিআর-রা বিদ্রোহ করলো-তখন ঐ বাহিনীর অবাঙালি কিছু সৈনিক-অফিসার প্রাণ হারায়। কিছু কিছু অবাঙালি যারা বিহারী নামে পরিচিত- তাদের অনেকেই নিহত হলো বাঙালি বিদ্রোহীদের হাতে। এ সমস্ত জায়গা থেকে যে সমস্ত টাকা-পয়সা,সোনাদানা এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়- সেগুলো রক্ষার ভার দেয়া হয়েছিলো একজনকে। আমি জানি, যে ভদ্রলোককে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো তিনি বর্ডার ক্রস করে ভারতে গেলেন বিশাল অঙ্কের ঐ টাকা, সোনাদানা,মূল্যবান সামগ্রী নিয়েই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে হি ডিড নট ডু এনিথিং। সেখানে তার এক আত্মীয় ছিলো- সেখানেই তিনি যুদ্ধের পুরো সময়টা ছিলেন এবং বেশ ভালোভাবে ছিলেন। এটা আমি জানি।

এরপর তৃতীয় স্টেজে এসে যুদ্ধের সময় আবার লুট শুরু হলো পাকিস্তানিদের দ্বারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নর্থ বেঙ্গল থেকে চাল ভর্তি গাড়ি আসতো ঢাকায়। কুর্মিটোলায় অবস্হানরত আর্মিরা এ সব চাল জোর করে রেখে দিতো। পেপসি কোলার আগের মালিক সে সময় চালের ব্যবসায়ী ছিলো। তার নামটা এখন আমার মনে পড়ছে না তিনি মারা গেছেন। আর্মিরা তার কাছে চাল বিক্রি করতো খুবই কম দামে। চাউল লে যাও,রুপিয়া দেও। মালিক তো মহাখুশী। সে চাল বিক্রি করেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর অবশ্য তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিলো। তবে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর আমরা স্বাধীনতার পর যখন দেশে ফিরলাম- তখন আবার লুট শুরু করলাম। সুতরাং এক বছরের মধ্যে বেঙ্গল ওয়াজ লুটেড ফোর টাইমস্‌।

প্র: মুক্তিযুদ্ধকালের কোনো ঘটনার কথা কি মনে পড়ে- যা আজো আপনার স্মৃতিকে নাড়া দেয় ?
উ: সেপ্টেম্বর মাসে আর্মির দ্বিতীয় অফিসার্স ব্যাচের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়ে মালদহ থেকে ট্রেনে করে আমি যখন কলকাতা ফিরছিলাম তখন ট্রেনেই এক হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি একটি বিজনেস অরর্গানাইজেশনে কাজ করেন। তিনি আমাকে চিনলেন যে,আমি বাংলাদেশের মানুষ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। নানা কথাও হলো। তিনি এক পর্যায়ে বললেন,আপনারা খুব লাকি মানুষ যে ইন্দিরা গান্ধী বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আপনারা তাঁর পুরো সহায়তা পাচ্ছেন। কিন্তু যদি মুরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী থাকতেন তাহলে এই সাহায্য আপনারা পেতেন না। তিনি আরো বলেন, মুরারজী দেশাই নাকি প্রো-আমেরিকান। আর একটা কথা তিনি বললেন,আপনারা যখন স্বাধীন হবেন তখন আপনাদের দেশে মাড়োয়ারিদের কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না। ভদ্রলোকের সেই কথা দু’টি কেন জানি আজো আমার কানে বাজে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম: ড. সুকুমার বিশ্বাস
সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : অক্টোবর ০২, ০৩, ২০০৩

শেষ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:৩১
১২টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×