রাস্তাটি, সাপের চলার মত করে বেঁকে, মিশেছে নদীর ঘাটে । দু’ধারে শস্যক্ষেত । কাছে কোন মানব বসতি নেই । দৃষ্টির অপারে কয়েকটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে ,এখনও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে দেয়নি । কলিম ,কলি কে কখনও কাঁধে নিচ্ছে ,কখনও বা কোলে ,আবার হাঁটতেও বলছে মাঝে মাঝে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো ,গন্তব্যস্থল থেকে তিন মাইল দূরে হবে । আরেকটু হাঁটলেই বর্ষায় প্রফুলচিত্ত ধামালিয়া পাড়ি দিতে হবে । সন্ধ্যার পর মাঝি পাওয়ার কথাও না ।
‘বাপজান, আর কত দূর ?উদ্বিগ্নচিত্তে কলিম কে বললো ।
-কলিমের কৌশলী উত্তর,এই তো নদী পার হলে ,একটু হাটলেই তোমার নানু বাড়ি ।
‘জানো, মা । সামনে নদীটি দেখবে ,সেখানে কত রাত যে কাটিয়ে দিয়েছি । বিচিত্র অভিজ্ঞতা,কত সব দেখিছি !
-চোখযুগল আশ্চর্যতা প্রকাশ করে কলি বললো, কি দেখেছো !
- কত সুন্দর জ্যোস্না,বড় বড় মাছ ধরেছি,এখানেই রান্না করে খাওয়া, হা হা হা হা ,মজার সেই দিনগুলি রে মা ।
-কলির প্রশ্নবোধক চোখ বিশ্বাস করতে পারছিলো না ,হঠাৎ হাস্যরস করার কারণ কি ।
সন্ধ্যারা বিদায় নিয়ে রাত এখন কর্তব্যরত । সুঁইয়ের মত চিকন চিকন বৃষ্টিও শুরু হয়েছে ।একেবাড়ে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে না ,অঝোর বৃষ্টির প্রভল সম্ভবনা । ‘পাঠক,আমার ভয় হচ্ছে ,কলির জন্য । গঠনচারি উচ্চ শব্দে বাঁজ পড়ার সাথে সাথেই কলির দু’হাত কলিমের গলা জড়িয়ে ধরলো । অনিচ্ছা সূচক, ভয়ার্ত চিৎকার কলির মুখ থেকে আলোর ঝলসানির মতই বের হয়ে গেল ।
প্রায় ত্রিশ মিনিট যাবত হাক ছাড়ছে ,কিন্ত কেউ আসছে না ,এখন বাড়ি ফিরলেও রাত শেষ হয়ে যাবে । তার চেয়ে বরং নদীটা পার হতে পারলে ১ ঘণ্টাখানেক পর গন্তব্যে পৌঁছা যাবে । । এছাড়া বাড়ি ফিরে যাওয়াটা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে । সাত-পাঁচ হিসাবে এখানে প্রার্থনারত অপেক্ষা করাই টা শ্রেয় । একান্ত মনে ভাবছিলো কলিম ।
হঠাৎ দেখলো সে তীরে একটি আলো আসছে ।
মা রে ! এখনই পার হয়ে যাব ,দেখ আসছে কে জান ।
মেয়ের মন্তব্যের অপেক্ষা না করে ,কে ভাঈঈঈ…...আসছেন তাহলে ...অনেকক্ষণ আপেক্ষায় আছি ই ই …
-‘না, কোন জবাব আসলো না ,তবে কেউ একজন ঠিক ই আসছে ।
‘নৌকা আসতেই কলিম আবিষ্কার করলো, ‘এ কোন ছেলে নয়,পুরোপুরি বৃদ্ধা বুড়ি এবং বেটে ,মাথার চুল ছেলেদের মত করে কাটা ও অর্ধপাকা। চামড়া বাজ কিন্তু সে তুলনায় মুখের চামড়া এতটা ঝুলে পড়েনি ।
নৌকা তে পা দেওয়ার সাথে সাথেই লাশ পঁচার গন্ধ পেল । কলি, বার বার এমন করতে লাগলো ,যেন এখনই কষে একটা বমি করবে ,কিন্তু হচ্ছে না । অদ্ভুদ !
বুড়িটি কলিকে কিছু না বলে,রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, ’এত রাত করে এসেছেন কেন! সন্ধ্যার আগেই আসবেন ! ‘কলিম,বুড়ির ‘‘আসবেন’’ কথাটি শুনে ভয় যেন চুপসে গেল । এ শব্দটির উচ্চারণ তো বুড়ো মানুষের মতো না ! যদিও শব্দ টি অপষ্ট স্বরে বলেছে ।
-মা, এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়, ২০ বছর পর ,তাই গল্পে মজে এ অবস্থা । কলিমের চোখদ্বয় যেন ক্ষমা প্রার্থনা করছে ।
ঘুঙ্গানি শব্দে বুড়ি উচ্চারণ করলো ‘মা’ ।
কলিম মাছের সন্ধানে নদীতে, এখন স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালোতে হচ্ছে । হঠাৎ লক্ষ্য করলো ,একটি লাশ স্রোত ওবাতাস উপেক্ষা করে বিপরীত দিকেই যাচ্ছে ,লাশ- নৌকার কি নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হচ্ছে !লাশটি এসময় কলিমের নৌকায় ধাক্কা গেল ,দমকা বাতাসে হঠাৎ বন্ধ জানালা খোলে যাবার মত করে । কেঁপে উঠলো কলিম, এখন কি লাফ দিব পানিতে ! পানিতে তো লাশ ! যেতেও পারছি না ,স্নায়ুর চাপ এত বেড়েছে ,চিৎকার করার শক্তি নেই । শক্তি সঞ্চার করে ,লাশটি তে বৈটা দিয়ে গুঁতো দিল এবং লাশটি পানিতে তলিয়ে গেল । প্রশান্তির নিশ্বাসে কলিম , শান্তি খুঁজে পেয়েছিল ।
স্তব্দ,নির্বাক হয়ে আসছে কলিম, দেড় দশক আগে,এই ধামালিয়াতেই লাশ পচাঁর গন্ধ পেয়েছিল ।স্মৃতিমন্থন যেন এখনও বাস্তবতার মত আঘাত করছে ।
ও ‘মা , তুমি মাঝে বসো ,কিনারে বসলে পড়ে যাবে । বুড়ি-আবেগ-আদর আশ্রিত স্বরে বললো ।
-জবাব না দিয়ে কলি ,মাঝখানে তে এসে কলিমের গা ঘেঁসে বসলো ।
নদীর পার হতে হতে বুড়ি কলির সাথে কয়েকটা কথা বলাতে ,ভাল লাগছে কলির । এভাবে এক সময় নৌকা ঘাটে পৌঁছালো ।
‘আমার কাছে দিন ,আমি আপনার মেয়েকে নামিয়ে দিই , বৃদ্ধা বুড়ি কলিম কে বললো ।
-না অসুবিধা নেই ,আমি নামিয়ে দিচ্ছি ,আপনি তো অনেক কষ্ট করেছেন ।
আমার হাতটা ধরো ,আস্তে আস্তে নামো ...এই বলে কলি কে নামালো । এবং তাড়াহুড়া করে বললো কোথায় যাবেন আপনারা! প্রবল ঝড় হবে ,মনে হয় ,সামনের রাস্তা ঘাট ও ভাল নয়। আচ্ছা যান ।
-হ্যা ঝড় হবে ,কি করা যাবে আর ।
কলিম ও ভাবছে এগুলো ,ঝড়ের সম্ভবনা অনেক ।
বুড়ির হাতের বাতিটি নিভে গেল ,বাতাসের বেগ বাড়ায় । তারপর বৃদ্ধ বুড়িটি অনায়াসেরই বাতিটি জ্বালিয়ে নিল ,অথচ এ রকম বাতাসে বাতিটি জ্বলার প্রশ্নই আসে না । ধামালিয়ার বুকে বাতিটি ,প্রায় নিভতে গিয়েও নিভে নি ।
কলিমকে আরও ভয় পেয়ে বসলো ,
আকাশের অবস্থা খারাপ ,যদি কিছু মনে না করেন,তাহলে আজকের রাত অমার এখানেই কাটিয়ে দিতে পারেন ,শুধু একটি রাত থাকার জন্য সুযোগ দিতে পারি ,তবে আযান পড়ার সাথে সাথে চলে যেতে হবে ,আপনাদের ।
কোন বাক্য বিনিময় না করে ,বুড়ির বাড়ির দিকে রওনা দিল ।
দাদি ,আমার দাদু তো তোমার মত বৃদ্ধ, সে সোজা হয়ে হাঁটতেই পারে না , তুমি তো সোজা হয়েই হাঁটছো ,বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে বসলো ,কলি ।
বুড়ি শুধু রক্ত চুক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকলো কিন্তু তা কলির চোখ এড়িয়ে গেল ।
আরেহ,বোকা মেয়ে ,সবাই কি এক ? কেউ কেউ সোজা হয়ে চলতে পারে ,, কলিকে নির্ভয় ,দেওয়ার চেষ্টা । অবশ্য করিমের ও একই প্রশ্ন, ভয়ংকর কিছুর আভাস দিচ্ছে ।
স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ,নোংরা ,এদিক সেদিক নানান কিছুর পালক পরে আছে । সব কিছুই যেন পুরাতন ধব্বংনাবশেষ । ছোট-বড় হাড্ডি ক্ষীণ আলোতে চোখে পড়ছে । কোনটি আবার অর্ধেক মাটিতে পোঁতা । একটি নিশাচর পাখি ভাঙ্গা দরজায় একপায়ে(অপর পা টি কেউ যেন তেঁতলে দিয়েছে) বসা ।
কলিমের হাতটি বৃদ্ধ বুড়িটি ,বেশ শান্ত শিষ্ট পরিবেশে খাচ্ছে ,রক্তে ঠোঁট,চোয়াল মাখা। যেমনটা করে টা করে পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ খায় । কলিম তার সব টা উজার করে দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করছে । কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না একদম, চোখে অবিরত অস্রুজল । বুড়ির পা টা বগল বরাবর রেখে ,হাতে কলিমের হাত ধরে জোরে টান দিচ্ছে ছিঁড়েফেলার ,সর্বশক্তি দিয়ে । কাটুরিা যেমন করে কাট কাটতে গিয়ে টান দেয় ।
এ স্বপ্ন দেখে কলি চিৎকার করে উঠে । আমি ঝড়ের রাতের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে কিছু একটা জবতে ছিলাম,তখন আর্ত চিৎকার কানে আসে ,আমার বুঝার বাকি রইলো না কিছু, ৮৮ সালের বন্যার পর পরিত্যাক্ত ঝোপ-ঝাড়ের দিকে দৌড় দিলাম। আবিষ্কার করি ,কলিমের জ্ঞান নেই ,কলি বাবার বুকে আলিঙ্গন করে কাঁদছে ।
প্রাথমিক চিকিৎসার কিছুক্ষণ পর কলিমের জ্ঞান আসে, আমার কৌতূহলী মন প্রশ্ন ছোড়ে দেয় কলিমের দিকে‘এত রাতে এই ঝোপ-ঝাড়ে আপনার কিভাবে ? একটু আগেই কলিকে ঘুমাতে পাঠালাম । কলিম যেন কোন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না ,সেই সাথে আমিও । সব শুনে আমি প্রশ্ন রাখলাম কলিমের উদ্দেশ্যে । এসবের পেছনে অতীত কোন ঘটনার সাথে যোগসূত্র আছে ? মনে পড়ে কোন ঘটনা ,যার সাথে মিল থাকতে পারে ?
কলিম একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ,উদ্দম নিয়ে বললো ‘‘ বহু বছর আগে ,আমি নদীতে আসি বোয়াল মাছ স্বীকার করতে । আমার তাবুর একটু দূরেই ঝাউ বন । সেখানে একটি মেয়ে গভীর রাতে খুব চিৎকারে ফেটে পড়ছিল , মা! ও মা ! বলে বাঁচার জন্য চিৎকার ছুড়ে দিচ্ছিলো , এ ঝাউ বন ,নদীর স্রোত , জ্যোস্না সব কিছু কে যেন তার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল । কিন্তু ! একটি দীর্ঘশ্বাস দিয়ে থেমে গেল কলিম ।
-কিন্তু টার পর কি হয়েছিল কলিম সাহেব ? আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাঁর চোখ থেকে নেমে যায়নি তখনও ।
- আমি মেয়েটার শেষ চাওয়ার প্রতিদান দেয়নি, এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি ।
কান্নায় বাঁধ ভেঙ্গেছে কলিমের । যেমন করে নরপশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘুঙ্গানি দিয়ে কাঁদছিলো ,তেমন ই । আমি শান্ত করার চেষ্টা করলাম ।
তারপর আবার শুরু করলো কলিম ।
- আমার মাছ স্বীকারের রক্তে মেশা নেশায় মত্ত ছিলাম । এখানে আমি আর নরপশুরা ঘাতক হয়ে আসছিলাম । আমার শিকার টা ছিল মাছ ,আর তাদের ….. । আমি বশিতে ধরা মাছ টি কে তুলতে চেষ্টা না করে ...মেয়ে টা কে বাঁচার জন্য এগিয়ে আসতে পারতাম । আমি মাছ টি পেয়েছিলাম ,মেয়েটি জীবন টা হারিয়ে ছিল । আমিও তো ঘাতক …
এই সব বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলো বারবার ।
আমি কলিম সাহেব কে থামাতে চেষ্টা করিনি ,কাঁদুক সে প্রাণ ভরে মন উজার করে কাঁদুক ।
চিকিৎসকের পরামর্শে কলিমের হাত কেটে ফেলতে হয় । কিন্তু কলিম বাকি এই একহাতে দিয়ে ভালো কাজ করেছেন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪৪