নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে থেকে শহুরে বাস্তবতায় একটু স্নেহ মমতার পরশ পাবার লোভে প্রেমে পরটা জরুরী হয়ে পরে । আমিও প্রেম পরলাম, যার প্রেমে পরেছিলাম তার নাম টা আপতত নাইবা বললাম, আমার নাম টা না হয় জেনে নিন । শুভ্র, আমার নাম । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আই বি এ তে কোন রকমে চান্স পেয়েও নিজের জীবন চালানর জন্য টানা দু বছর পায়ের চপ্পল ঘসেও যখন কোন চাকুরী পেলাম না তখন প্রেমের ভুত আমায় চেপে বসলো । তা যেই সেই প্রেমের ভুত না , এক্কে বারে রাজসিক প্রেম । ব্যাপার টা সেই বাংলা সিনেমার মাজাঘসা গল্পের মতই। গরীবের ছেলে বড়লোকের মেয়ে ইত্যাদী ইত্যাদী ।
আমার ডেরা ছিলো নাখালপাড়ার ভাঙ্গা খোয়ার সরু রাস্তা দিয়ে ঢুকে কিছুটা এগলেই মিস্ত্রী লেন। ওখানেই একটা আদিম কালের প্লাসটার খসা অর্ধেক বানানো এক বিল্ডিঙের ছাঁদ কুঠুরিতে । দিনের বেলায় যেখানে আলো ঢুকতে সাহস করে না রাতের বেল কি হয় সে তো বুঝতে পারা যায় । মশক কুলের অভয় আশ্রম । প্রশ্ন করতে পারেন শহর জুড়ে এতো ভালো ভালো বাসা থাকতে এমন একটা জায়গায় কেনো এলাম । আমার এক দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি এটা। তাদের বাড়ি দেখে রাখার মতো কেউ কে পাচ্ছিলো না , তো যখন আমি তাদের কাছে যেয়ে থাকার জন্য হাত পাতলাম, তারা হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলো । তারা আমাকে তাদের বাড়ির বিনা বৈতনিক কেয়ার টেকারের কাজের সম্মানে সম্মানিত করলেন ।
ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম । কোথায় আমার প্রেমের গল্প বলবো তা না করে নিজের বাহারী ছাঁদ কুঠুরীর বন্দনা গাইতে বসে গেলাম । যাইহোক মূল ঘটনায় আসি, একদিন সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরছি, বাড়ি মানে আমার ছাদে ফিরছি যেখানে একটা ছেড়া অতান্ত ময়লা তেল চিটচিটে মশারী আর ঘামে ভেজা তিলা পরা বালিশ যার বিভিন্ন অংশ দিয়ে তুলা নামক বস্তু বেড়িয়ে আসার আপ্রান চেষ্টায় ব্যাস্ত আর এক পা ভাঙ্গা খান কতেক ইট দিয়ে ঠেক দেয়া নাম না জানা কাঠের বিছানা অপেক্ষা করছে। যথারিতী লোড শেডিং , ঘুট ঘুটে অন্ধকার, মিস্ত্রী লেনের ঢোকার মুখেই ঠক করে পায়ে শক্ত কিছু ঠোক্কর খেয়ে যেন দূর সরে গেলো ।পায়ে ব্যাথা না পেলেও কৌতূহলী হয়ে উঠলাম । আঁধারের ও এক প্রকার আলো আছে, মিশমিশে আঁধারের মাঝে হালকা আবছা মতোন আলো, চোখ যখন আঁধার সয়ে যায় তখন বোধয় নিজেই জমিয়ে রাখা কিছু আলো দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে ঠিক তেমনি একটা আলোর মতো অবস্থায় দেখলাম কালো চৌকোনা জাতীয় কিছু টা দূরে পরে আছে । পায়ের ঠোক্কর খেয়ে বেচারা দূরে একটা আধ খাওয়া ভাঙ্গা এক টুকরা ইটের উপর আছড়ে পরে আছে । খপ করে তুলে পকেটে নিয়ে দ্রুত হাটা দিলাম । অভাবীর কাছে পরে পাওয়া বস্তু সোনার মতোন । যা পাবো তাতেই লাভ ।
ঘরে ফিরে হাতিয়ে হাতিয়ে জলের কলশি খানা খুঁজে ঢক ঢক করে জল খেয়ে ভাড়ি নিঃশ্বাস ফেললাম । সকালের পর থেকে এই জলের উপরেই আছি । পেটের ভেতর ছুঁচোর পাল ডিগবাজি দিচ্ছে । আঁধারে পুরা ঘর হাতিয়েও খাবার মতো কিছু পেলাম না । শেষে নিজের কপাল কে হাজার টা গালি দিয়ে ভাঙ্গা খাটের কোনায় গিয়ে বসে পরলাম । এরি মধ্যে বিদ্যুৎ বাবাজির আগমন ঘটেই গেলো । বাড়ি ওয়ালার কৃপায় একটা ফ্যান পেয়েছি যা ঘোরার থেকে বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় ক্যাচর ম্যাচর করে । মাঝে মাঝে আমার এই ফ্যান টা কে মঙ্গল গ্রহের কোন যোগাযোগ মাধ্যম মনে হয় । তারা হয় তো আমার দুরাবস্থা দেখে আমাকে সংকেত দিচ্ছে, ও হে শুভ্র, মঙ্গলে আসো এখানে খাদ্য ও বাসস্থান দুই টাই আছে । কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না বলে যাওয়াটা ঠিক হয়ে উঠছে না । যাই হোক পকেট থেকে কালো বস্তু খানা বের করে দেখলাম উহা আর কিছুই নয় একটা বাটন মোবাইল। খানিক টা খুশি হলাম । ওটা বেচে কিছু আয় উন্নতি হবে । কিন্তু মোবাইল টা বন্ধ এর চার্জার আমার কাছে নাই । হাঁসি পেলো খুব, উপরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ও খোঁদা এইটা কেমন তামাশা মোবাইল দিলা বিনা চার্জারে ওটা দিয়ে আমি কি করবো। তারপরেও মোবাইল টা টেপা টিপি করতে লাগলাম । আমার অত্যাধিক কৌতহল আর টেপা টিপের ধাক্কায় মোবাইল বেচারার আলো জ্বলে উঠলো । স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা ইন্সার্ট সিম । মুচকি হাসি দিয়ে মোবাইল টা দূরে ছুড়ে ফেলে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম ।
ধুরুম দড়াম শব্দে প্রতিদিনের মতোই ঘুম ভেঙ্গে গেলো । বাড়ির আশে পাশে হাজারো বিল্ডিং এর কাজ হচ্ছে । আমি মাঝে মাঝে ভাবি এতো বিল্ডিং এ কারা থাকবে । তিব্র ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আশার উপক্রম। ছাঁদ কুঠুরির পাশে সাপ্লাইয়ের পানির নল থেকে গড়গড়িয়ে জল পরছে । হাত মুখ ওই জলে ধুয়ে, মোবাইল খানা পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। আশেপাশে কোন মোবাইলের দোকানে গিয়ে বেচে দিলে সকালের নাস্তার টাকা হয়ে যাবে ভাগ্য ভালো থাকলে দুপুরের খাবারের টাকাও হয়ে যেতে পারে । নিচে নামতেই বেলায়েত মামার সাথে দেখা ।কিরে শুভ্র কই যাস, পেছন থেকে ডাক দিলেন বেলায়েত মামা । দেখি নাস্তা করবো ভাবছি , বিরক্ত হয়ে বলি । তোর মামী তোকে একটু বাজারে যেতে বলেছে, তুই বাজার টা করে তার পরে নাস্তা করিস। হাতে একটা মস্ত বাজারের ব্যাগ গছিয়ে দিলো সাথে এক হাজার টাকা । টাকা দেখে মন ফুর ফুরা হয়ে গেলো । বাজারে গিয়ে পঞ্চাশ টাকার নাস্তা করলাম, পঞ্চাশ টাকা রাখলাম দুপরের খাবারের জন্য আর এক’শ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাবার খরচ । ব্যাস লাইফ আজকে জিংগালালা ।
নীলক্ষেতের চিপায় বসে দুপরে হালফ তেহেরি খেয়ে ঢেকুর তুলে বেড়িয়ে পকেটে হাত দিতে মোবাইলে হাত ঠেকে গেলো । যাহ বাবা, মোবাইলটার কোন হিল্লা করা হলো না । সাথের বড় ভাই কে দেখিয়ে বিস্তারিত বললাম, তিনি মোবাইল টা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে বললো, চল ! কোন মোবাইল রিপিয়ারের দোকানে গিয়ে দেখি কি বলে? দোকানী মোবাইল খানা ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে চার্জের পিন গেছে । চার্জের পিন ঠিক করতে দুই’শ লাগবে । বড় ভাই হাঁসি দিয়া বললো, তাইলে আর কি, ঠিক করে ফেলো ভাই সেই সাথে একটা চার্জার ও দাও, আমাদের শুভ্র ভাইয়ের মোবাইলের একটা হিল্লে হয়ে যাক । আমি চমকে উঠলাম, না, না, আমার কাছে টাকা নাই । আরে চিন্তা নাই বালক, আমি ধার দিচ্ছি পরে দিস, বেশ কিছু খোঁচা খুঁচি করার পর মোবাইল টা জীবিত হয়ে গেলো ।বড় ভাই তার মানি ব্যাগ হাতরিয়ে একটা সিম বের করে বললেন, আমার আরো চার পাঁচ টা আছে তুই এটা নে । এটা ধার না, বাকি টাকা কিন্তু ধার, পরে দিয়ে দিবি কিন্তু । মাথা চুলকে বললাম, ভাই ধার তো দিলেন, শোধ করার জন্য একটা বা দুই টা টিউশানি যদি লাগিয়ে দেন তাইলে ভালো হতো। আচ্ছা যা কাল আসিস একটা টিউশানি আছে হাতে ওটা তোকে দিয়ে দেব ।
হাতে মোবাইল পেয়ে বেশ ফুরফুরা লাগছে, কাকে কাকে কল দেয়া যায় তার একটা লম্বা লিস্ট করে ফেললাম । কিছুক্ষন পরিচিতদের কল করলাম কেউই ফোন ধরলো না , ধুত্তরিকা- কেউ ফোন ধরছে না কেন? ডায়েল প্যাডে নাম না জানা বিভিন্ন নাম্বারে কল দেয়া শুরু করলাম । কারোই ইচ্ছে হলো না আমার কল ধরার । ফোন টা বিছানায় আঁছড়ে ফেলে বিছানায় সটান হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম । টিং টিং শব্দে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অন্ধকারে এক আদ্ভুত নীলচে আলোয় ঘর ভরে আছে আর কোথা থেকে যেনো টিং টিং শব্দ ভেসে আসছে । এতো দিন জানতাম কেবল সিলিং ফ্যানটাই কেবল মঙ্গল গ্রহের বার্তা দেয় এখন কি সত্যি সত্যি মঙ্গলের কোন প্রানী এলো নাকি । পিঠের নিচে কেমন ঝিনঝিন করে উঠলো। এ বাবা , এ কি হচ্ছে আমার সাথে , তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে দেখি মোবাইল খানা নিজ প্রচেষ্টায় বাজচ্ছে । অচেনা এক নাম্বার থেকে কল এসেছে । কাঁপা হাতে কল টা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে মিস্টি কিন্নর কন্ঠি কিচির মিচির করে উঠলো । আপনি আমাকে কল দিয়েছিলেন?
আমি বেমালুম চেপে গেলাম , জ্বী না, আমি কল দেই নাই ।
ইস বললেই হলো, আপনার নাম্বার আমার মোবাইলে মিস কল হয়ে আছে যে, ওপাশ থেকে কিচির মিচির করে বলতে লাগলো । কেনো কল করেছেন, আমি কি আপনাকে চিনি ?
আপনি আমাকে চেনেন কি না জানি না, কিন্তু আপনার গলা কিন্তু চিনির মতো মিষ্টি ।
ফ্ল্যার্ট করছেন, মধ্য রাতে ফ্ল্যার্ট করে কিন্তু বদমাইশ লোক জন । চিনির সাথে খানিক টা করল্লা মিশে গেলো মনে হয় ।
জ্বি না ফ্ল্যার্ট করছি না, সত্য কথা বললাম ।
ও আচ্ছা, তো এইবার সত্য বাগিশ মশায় কি বলবেন কেন আমাকে মিস কল দিয়েছিলেন ।
অমন রিনিঝিনি কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলে না বলে কি আর পারি
চুপ, একদম চুপ, ঠিক করে বলেন কেন মিস কল দিলেন ।
আসলে আজ আমি নতুন মোবাইল নিয়েছি, পরিচিত অনেক কেই কল করেছি কেউই কল রিসিভ করে নাই, তখন কিছু অচেনা নাম্বারে কল করেছিলাম, এর মধ্যে হয়তো আপনার নাম্বার ও ছিলো ।
বললেই হলো, এই সব ঢঙ্গের কথা আমি অনেক শুনেছি, সত্য করে বলেন কই থেকে আমার নাম্বার পেয়েছেন , না বললে আমি পুলিশে কমপ্লেইন করবো । রিনিঝিনি কন্ঠ এইবার ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো ।
আমি সত্যি বলছি, কারো কাছ থেকে নাম্বার নেই নাই ।
হুম, শুনুন আর কখনো আমাকে কল করবেন না । মনে থাকবে ? বেশ কাটা কাটা গলায় ওপাশ থেকে বলে উঠলো ।
জ্বী অবশ্যই করবো না।
মনে থাকে জেনো, রাখলাম । কুটুস করে মোবাইল টা কেটে গেলো। মনে হলো শতাব্দী পরে কে যেন মনে দড়জায় টোকা দিয়ে পালিয়ে গেলো । তিব্র হাহাকার এসে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আঁছড়ে পরলো ছোট্ট হৃদয় সৈকতে । আপন কেউ কে হারানর বেদনায় মন নীল হয়ে গেলো । তিব্র পানির পিপাসা পেলে যেমন ঠোঁট শুকিয়ে যায় ঠিক তেমনি যেন কলিজা শুকিয়ে গেলো এক অচেনা পিপাসায় ।
সারা রাত আর ঘুম এলো না, মাথার মধ্যে কেবলি বাঁজতে লাগলো মিষ্টী কন্ঠির কিচির মিচির । চোখ বন্ধ করলেই মনে হলো, আবার মনে হয়তো কল দেবে। মোবাইল টা তাই হাতের কাছে রেখে শতেক ছিদ্র মশারী দিয়ে টিনের চাল দেখতে লাগলাম । সারা রাতে আর কল এলো না। এমন করেই ভোর হয়ে গেলো । অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গেছিলো জানা ছিলো নাই, ঘটর ঘটং শব্দে তন্দ্রা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেলো । রাজ্যের বিরক্ত নিয়ে জেগে উঠলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৪