somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিকুনগুনিয়া না, নামটা হওয়া উচিত ছিলো "ব্যথা-রোমন্থন"

৩০ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্য মার্চ। সারা শরীরে লালা লাল সরিষার দানার মতো কি যেনো বের হলো। এফবি বন্ধুর তালিকায় অনেক তরুণ ডাক্তার বন্ধু আছে। তারা আমার কবিতার ভীষণ ভক্ত। তাদের সাথে আমার শরীরের অবস্থানটা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার কথা শুনে কয়েকজন বাসায় দেখা করতে এলো। ওরা সবাই দেখে বললো,
"এতো চিকুনগুনিয়ার লক্ষন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনার কোন জ্বর বা ব্যথা নেই।" সবাই দেখে বললো, যেহেতু আপনি নিয়মিত যোগা করেন সেহেতু চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস আপনার দেহে ঠিকমত আক্রমন করে কাহিল করতে পারে নি সেহেতু আপনার জ্বর ও ব্যথা নেই। হয়তো এমন হতে পারে আপনার দেহে ভাইরাসটি রোধক তৈরী করতে পারে অথবা যদি ভাইরাসের সবগুলোকে মেরে ফেলে তাহলে আবার হতে পারে এবং হলে পরবর্তিতে খুব শক্তিশালী আক্রমন হতে পারে। অতএব একটু সাবধানে থাকবেন। এই বলে তারা চলে গেলো।

তারপর মার্চ গেল এপ্রিল গেলো মে গেলো। জুনের দুই তারিখে আমার স্ত্রীর চিকুন গুনিয়া হলো। তিনদিন জ্বরে, পাঁচদিন অরুচিতে এবং দশ বারদিন ব্যথায় ভুগে ভালো হয়ে গেলো। তারও শরীরে আমার মতই লাল লাল দাগ হয়েছিল। এর পর পরই আমার মেয়ের বন্ধু বান্ধবীদের ও তার অফিস কলিগদের হতে শুরু করলো। তাদের বাসায় গিয়ে তাদের যতোটুকু সেবা শুশ্রূষা করার আমি করলাম। ওদের পাশে থাকতে অনেকে ভয় পাচ্ছে। কারণ ওকে কামড়ানো মশা যদি কামড়ায় তাহলে তাদেরও হবে। আর ব্যথার যন্ত্রণায় সকলের ডর।

আঠার জুলাই রাত এগারটায় আমার মেয়ের কলিগের বাসা থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। রাত সাড়ে বারটায় কেমন জানি শীতশীত লাগছে এবং হাতের কবজিতে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। বুঝতে পারলাম মশা এবার ভালভাবেই বসিয়ে দিয়েছে। শরীরে ভলো করে দেখলাম তখনও লাল লাল দানাগুলো বের হয় নি। ডাক্তার বন্ধুদের কথা মত বুঝতে পারলাম, গতবারের ব্যর্থতায় এবার চিকুনগুনিয়া লক্ষ লক্ষ সৈন্য সামন্ত নিয়ে আমার দেহে আক্রমন চালিয়েছে। অট্ট হাসি দিয়ে বলছে, 'এবার যাবে কোথায়!'

এ রুগীর সেবা করতে গিয়ে দেখেছিলাম, কারো কারো ১০৩ থেকে ১০৫ ডিগ্রী জ্বর উঠেছিলো এবং তা তিন চারদিন পর্যন্ত থাকতো, অরুচিতে খেতে পারতো না। কিন্তু সারা রাতে আমার জ্বর ১০২ এর উপর উঠলো না। সকালে এক হালি আনারস কিনে আনলাম। কোন কিছু না খেয়ে সারাদিন আনারস খেলাম। দেখি রাত আটটার দিকে জ্বর থেমে গেল। সকলের মধ্যে প্রায় পাঁচ সাতদিন অরুচি ভাব ছিলো, তবে তা আমার মধ্যে ঘটে নি। ফলে রাতে পেট ভরে ভাত খেলাম। ডাক্তার বন্ধুদের পরমর্শে রাতে শোবার আগে নাপা এক্সটেণ্ড সেবন করলাম একটা। শুয়ে ঘুম আর আসে না।

সারারাতে ব্যথা সারা শরীরের এখান থেকে সেখানে ছুটা ছুটি শুরু করলো। কখনও কব্জিতে, কখনও কনুইয়ে, কখনও হাঁটুতে কখনও পায়ের গোড়ালীতে। ব্যাথার চোটে কি আর ঘুম আসে। মোটেও না। তাই ব্যথাকেই অনুসরন করতে থাকলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কৈশোরের কথা।

আষাঢ় শ্রাবণের পুরো বর্ষা চলছে। একদিন দুপুরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। বাতাবীলেবুর গাছ থেকে একটা কাঁচা লেবু তুলে দে ছুট বাড়ীর পাশে খেলার ছোট্ট মাঠে। মাঠে গিয়ে গলা ছেড়ে দিলাম হাক। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো কৈশোরের খেলার সাথীরা। পাঁচজন করে দল ভাগ করে শুরু হয়ে গেলো আমাদের বাতাবীলেবু দিয়ে ফুটবল খেলা। খেলার দশ পনের মিনিটে তিন দুই গোলে এগিয়ে। মাঠ তখন বৃষ্টির জলে থৈ থৈ করছিলো। বল পেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি, ডান পাটা মাত্রার একটু বেশী এগিয়ে পড়াতে ভারসাম্য হারিয়ে নিতম্ব গিয়ে পড়লো বাঁ পায়ের গোড়ালীর উপরে। পড়েই ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে দশ বার ফুট দূরে গিয়ে থামলাম। উল্টে পা সোজা করতে গিয়ে দেখি পায়ের পাতা আর সোজা করতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু করে দিলে বন্ধুরা এসে চ্যাংদোলা করে বাসায় নিয়ে গেলো। আমার এ অবস্থা দেখে বাবা তো ভীষণ ক্ষেপা। রেগে বন্ধুদের বললেন,
"দূর হ ওকে নিয়ে। এতো করে বলি এসব খেলায় পেটের ভাত জুটবে না। পড়াশুনা বাদ দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে খেলা আর খেলা। খাম হয়ে বাসায় আসলি কেন? দেখি বন্ধুরা কতো সেবা যত্ন করে?" আমি বন্ধুদেরকে বললাম,
"আরে বাপের কথা শুনিস না, আগে খেরুর মাকে ধরে নিয়ে আয়।" আমার কথা শুনে তিন চারজন দৌড় দিলো খেরুর মাকে ডাকতে।

খেরুর মা। আমাদের ঐ অঞ্চলে একজন প্রসিদ্ধ মালিশকারক ছিলেন। অদ্ভূত তার হাতের যশ। তার হাতের মধ্যে যে কোনো ব্যথা পড়ুক না কেন সঙ্গে সঙ্গে দূর। কিছুক্ষনের মধ্য খেরুর মা ভিজতে ভিজতে এলেন। আমার বাঁ পাটা কোলে তুলে নিয়েই এমন কৌশলো মোচড়ালো, পট শব্দ করেই সোজা হয়ে গেলো। ঐদিকে বাবা চিৎকার করে বলছে,
"খেরুর মা, কোন পয়সা চাল ডাল কিচ্ছু দিবো না যতই চিকিৎসা করো।" খেরুর মা উত্তরে বলে,
"আপনে শান্ত হন, আগে ভাই ভালো হোক তারপর দেখা যাবে।" তারপর আমাকে বললো,
"দাদা, পা সোজা করে দিলাম, কিন্তু ব্যথা সারতে চার পাঁচদিন লাগবে। তবে সারাদিন শুয়ে না থেকে পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবি। আমি সকাল বিকাল এসে মালিশ করে দিয়ে যাবো।" ঠিকই পাঁচদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যথা দূর হয়ে গেল। ভুলে গিয়েছিলাম সেই ব্যথার কথা। চিকুনগুনিয়া বাঁ পায়ের গোড়ালীর ব্যথাটা ভাসিয়ে দিয়ে মনে করে দিলো সেদিনের কথা। খেরুর মা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে।

চিকুনগুনিয়া পুরাতন ব্যথাগুলো প্রতি প্রহরে ভাসিয়ে তুলছে, আর নিয়ে যাচ্ছে সেই পুরানে দিনের স্মৃতিচারণে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ ধরতে গিয়ে বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে পেলাম আঘাত। ফুটবল খেলতে গিয়ে কত যে বুটের আঘাত লেগেছিলো তা ইয়াত্তা নাই। সব যেন ভাসিয়ে তুললো প্রহরে প্রহরে। শুয়ে শুয়ে বিশেষ দিনগুলোর আঘাতের স্মৃতিচারণ করতে থাকি। এভাবেই কেটে গেলো চারদিন।

পঞ্চমদিন ডাক্তার বন্ধুরা এসে আমাকে দেখে তারা মহাখালী আইইডিসিআর এ নিয়ে গেলো রক্ত পরীক্ষা করানোর জন্য। সিএনজি থেকে নামবার সময় দেখি ডান পায়ের উরুর মাংশটা টেনে ধরেছে। ঝিঝি লাগলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। মাংশের উপরে হাত বুলিয়ে দেখি সেই পুরানো ঝিঝির মতো থোপসা লাগানো ব্যথা। মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে যায়,
"পেয়েছি সেই স্মৃতির কথা।" সবাই কথাটা শুনে পেয়ে বসলো,
"বলুন দাদা, আপনার স্মৃতির কথা শুনি।" আমি বললাম,
"ঠিক আছে, রক্তটা দিয়ে যেতে যেতে বলবো।"

সাতাত্তের দিকে। আমিও তখন যৌবনের প্রারম্ভে। খেওয়া জাল দিয়ে মাছ মারার ভীষণ সখ ছিলো। তবে সঙ্গে বৃষ্টি থাকতে হবে। অর্থাৎ আষাঢ় শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বৃষ্টির দিনে মাছ মারতাম। এ সময় বড় বড় পুকুরে খেওয়া জালে মাছ উঠে না। ছোট ছোট নয়নজলী, খাল ডাবায় ভাসা মাছ আশ্রয় নিতো। এসবে জল কম থাকে, বষ্টির দিনে মাছ থৈ থৈ করে। জালের খেওয়া দিলে জাল ভর্তি মাছ উঠে আসতো। একদিন পাঁচ বছর বয়সী আমার ভাতিজাকে নিয়ে মাছ মারতে বের হলাম। ভাতিজা ছিলো আমার মাছ কুরানি খলইধারক সঙ্গী। একটা দাম পুকুরের পাড়ে ভাতিজাকে বসিয়ে জাল ফেলার উদ্দেশ্যে কয়েক স্থানের দাম পরিস্কার করতে পুকুরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনেক পুরাতন খাস পুকুর। পুকুরের তলায় তলানী পড়তে পড়তে পুকুরের গভীরতা কমে গেছে। এখন বর্ষাকালে কোমর জল থাকে। পুরাতন পুকুর, তাই এ পুকুরে কৈ মাগুর শিং শোল মাছ পাওয়া যায়। বৃষ্টি হচ্ছে ঝম ঝম করে। আমি লুঙ্গী মালকোচা মেরে পুকুরে নামলাম। নামতেই এক ঢোড়া সাপ এমনভাবে ডান পায়ের উরু কামড় বসালো, সবকটি দাঁত বসিয়ে কামরে ধরে থাকলো। আমি সাবধানে ওর মুখ ফাঁক করে ধরে সব দাঁতগুলো ছাড়িয়ে সাপটিকে দূরে ছুড়ে দিলাম। দেখি ক্ষত দিয়ে রক্ত দরদর করে পড়ছে। আমি মাথা থেকে গামছাটা খুলে উরুতে পেঁচিয়ে বেঁধে দিলাম। যথারীতি মাছ মেরে খলই ভর্তি করে বাসায় ফিরে মাকে বললাম,
"মা, নিতেন কবিরাজকে একটু ডেকে নিয়ে আয়।" মা উত্তরে বলে,
"কেন, কি হইসে?" আমি বললাম,
"কিচ্ছু না, একটা ঢোড়া সাপ কামড়াইছিলো। অনেক রক্ত বারাইছে। একটু অসুধ নেওয়া লাগবে।" মা নিতেন কবিরাজরে ডেকে আনলেন। কবিরাজ এসে ক্ষত দেখে কিছু গাছগাছড়া দিয়ে অসুধ বানিয়ে আমায় সেবন করালেন। আর বললেন,
"কোন ভয় নাই। কয়েকদিন ঝিমঝিমানী থাকবে, পরে সেরে যাবে।" সেই ঢোড়া সাপের কামড়ের ঝিমঝিমানী ব্যথাটা চিকুনগুনিয়া আবার ভাসিয়ে তুললো।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৫:১৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×