...........................................................................................
সিংহল হতে দামেশক যাচ্ছিল জাহাজটা। যাত্রীরা কয়েকজন আরব বনিকের এতিম পরিবার-পরিজন। সাথে সিংহলের রাজার পক্ষ হতে কিছু মূল্যবান উপহার সামগ্রীও ছিল, যা শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে যাচ্ছে দামেশক; খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের দরবারে। রসদ নিতে জাহাজটাকে পথে থামতে হল দেবল (করাচী) বন্দরে।
দেবল সিন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। সিন্ধু অববাহিকার অসহায় মানুষ সে সময় শাসিত এবং শোষিত হচ্ছিল অত্যাচারী রাজা দাহিরের হাতে। উপহারসামগ্রীতে পূর্ণ ঐ জাহাজ দাহিরের লোভী চোখ এড়াতে পারল না। গিয়ে পড়ল কেমন করে যেন। আর যায় কোথায়? জাহাজের মালামাল লুট করে অসহায় যাত্রীদের বন্দী করা হল।
পার্শ্ববর্তী মাকরান তখন মুসলমানদের অধীনে। মাকরানের শাসনকর্তার দূত সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে দাহিরের দরবার হতে অপমানিত হয়ে ফিরে এল। এমনি সময় দাহিরের বন্দীশালা হতে কেমন করে যেন এক যুবক পালাতে সক্ষম হল। সাথে নিয়ে গেল এক চিঠি। অন্য এক বন্দিনী নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছে সেটি আর প্রাপক ইরাকের প্রবল প্রতাপশালী শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ!
কী ছিল সেই চিঠিতে? অসহায়ত্বের বর্ণনা আর আহাজারি? সাহায্যের আকূল আহবান? জানার আগে একটু হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অতীতের খোঁজ নিই?
আরব উপদ্বীপের তায়েফ উপত্যকা; বনু সাকাফ গোত্রে জন্মেছিলেন ইউসুফের পূত্র হাজ্জাজ (৬৬১-৭১৪ খৃ.)। শিশুদের কুরআন শিক্ষা দেবার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। সে সময়ে এ পেশায় অনেক সম্মান থাকলেও পারিশ্রমিক ছিল নামমাত্র। উচ্চাভিলাষী হাজ্জাজের এত মন বসল না। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের বাহিনীতে ছোট্ট পদে যোগ দিয়ে চলে গেলেন দামেশক। অল্প দিনেই উমাইয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্য এবং এ পরিবারের বিরোধীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা তাঁকে খলিফার কাছাকাছি নিয়ে এল।
উমাইয়াদের ক্রমবর্ধমান অপশাসন ও ইসলামের মৌলনীতির প্রতি অবজ্ঞা মক্কায় সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরকে(রা) বাধ্য করল বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করতে(৬৯২ খৃ.)। আর সকলে যখন এ সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারনে অক্ষমতা প্রকাশ করল তখন একা হাজ্জাজ এগিয়ে গেলেন। প্রবলবেগে মক্কা অবরোধ আবরোধ করলেন। ভীষনভাবে পাথর নিক্ষিপ্ত হতে লাগল মক্কার লোকালয়ে, ভেঙ্গে পড়ল পবিত্র ক্বাবার একপাশের দেয়াল! অবশেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল, যুবাইর ইবন আওয়াম(রা)ও আসমা বিনতে আবুবকরের(রা) পুত্র আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরকে(রা)। কর্তিত মস্তক পাঠানো হল আবদুল মালিকের দরবারে!
উমাইয়া রাজতন্ত্রের পথে একটা বড় বাধা দূর হল আর বিনিময়ে হাজ্জাজ পেলেন সালতানাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অশান্ত প্রদেশ ইরাকের শাসনভার। এখানেও হাজ্জাজের নির্মমতা জারি থাকল। কথার যাদুকর ছিলেন হাজ্জাজ। অশান্ত ইরাকবাসীকে শান্ত করতে তাঁর কথাগুলো ছিল এমন- “আমি দেখতে পাচ্ছি, চোখের দৃষ্টি উপরের দিকে উঠছে, মাথাগুলো সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইছে, মাথার ফসল যেন পেকে উঠেছে আর কেটে ফেলবার সময়ও উপস্থিত হয়েছে! আমার দৃষ্টি সেই বস্তু দেখছে যা পাগড়ী আর দাঁড়ির মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত হবে!”।
কবরস্থানের শান্তি চেয়েছিলেন তিনি! বলা হয়ে থাকে, তাঁর দুই দশকের (৬৯৪-৭১৪ খৃ.)শাসনামলে নূন্যতম সোয়া লক্ষ নিরপরাধের জীবন গিয়েছে আর আশি হাজারের উপরে নিরপরাধ অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে নির্যাতিত হয়েছে। এভাবে, উমাইয়া শাসনের ভীত মজবুত করতে অসামান্য অবদান রাখেন হাজ্জাজ। মূমুর্ষূ আবদুল মালিক(৬৮৫-৭০৫ খৃ.) তাই স্বীয় পুত্র এবং উত্তরাধিকারী ওয়ালিদকে অন্তিম নসিহতকালে এ অবদান স্মরণে রেখে হাজ্জাজের কদর করতে বলে যান।
ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫ খৃ.) পিতার নসিহত ভোলেন নি। তবে, হাজ্জাজকে তিনি ব্যবহার করলেন পূর্ব-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ইসলামের বিজয় পথকে নিষ্কন্টক করবার কাজে! দস্যূর হাতে পড়ে যে অস্ত্র এতদিন প্রানহরণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে অবলীলায়, এবার বৈদ্যের হাতে এসে রূপান্তরিত হল অমূল্য প্রানদায়িনী শক্তিতে।
অনারবদের কুরআনের পঠনে সুবিধা করে দিতে হাজ্জাজ আরবীতে স্বরবর্ণের (যের-জবর-পেশ)ব্যবহার আবিষ্কার করলেন। উত্তর আফ্রিকা, স্পেন আর তুর্কিস্তানের জনপদগুলোতে হাজার বছর ধরে নিষ্পেষিত জনতার ফরিয়াদ শুনতে পেয়ে তাদের মুক্তির দিশা দিতে ছুটে যেতে শুরু করল তাঁর সেনাবাহিনী। তাঁরই নিয়োজিত সেনাপতিদের মধ্যে মূসা ইবন নুসাইর উত্তর আফ্রিকায়, তারিক বিন যিয়াদ স্পেনে আর কুতায়বা বিন মুসিলম তুর্কিস্তানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করলেন।
আমাদের আলোচিত সেই চিঠি এমনি সময় হাজ্জাজের হাতে এল। দাহিরের হাতে আরবীয় নারী-শিশুর বন্দীত্বের কথা তিনি শুনেছিলেন আগেই। কিন্তু, পূর্ব আর উত্তরে সমস্ত সৈন্যবাহিনী ব্যতিব্যস্ত থাকায় কিছুই করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু, আক্ষরিক অর্থেই রক্তের অক্ষরে লেখা সে চিঠি আগুন ধরিয়ে দিল তার মনে। চিঠির ভাষ্য ছিল অনেকটা এরকম।
“হাজ্জাজের রক্ত যদি শীতল হয়ে গিয়ে থাকে তবে এ পত্রও বিফল প্রমানিত হবে। যে জাতির যুবকেরা ঝড়-ঝঞ্ঝার বেগে তুর্কিস্তান আর আফ্রিকার উপকূলে ঘা দিয়ে যাচ্ছে, তা কি স্বজাতির অসহায় নারী-শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পায় না? এ কী করে সম্ভব যে, যে জাতির তলোয়ারের সামনে একদিন কায়সার ও কিসরা মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছিল, আজ অত্যাচারী সিন্ধু রাজের সামনে তা ভোঁতা প্রমানিত হবে?”
দুই দশক পূর্বে আবুবকরের(রা) নাতির খন্ডিত মস্তক নিয়ে উল্লাস করতে যে হাজ্জাজের হৃদয় কাঁপে নি, সেই হাজ্জাজের চোখে আজ অশ্রুর বন্যা নেমে এল! খোদার খেলা বোঝা ভার!
খলিফা ওয়ালিদের কাছ হতে জিহাদের অনুমতি নিতে দেরী হল না হাজ্জাজের। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকেরা যোগ দিতে লাগল। ভাবতে অবাক লাগে, কী উঁচুমানের আদর্শ আর কর্তব্যবোধের অধিকারী ছিলেন সে সময়ের জনগণ! পরিবার-পরিজনের অনেকেই হয়তো হাজ্জাজের নির্যাতনের শিকার , কেউ কেউ হয়তো তখনো বন্দীশালায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে! তা সত্ত্বেও আফ্রিকা-তূর্কিস্তানে যেমনি করে তাঁরা সব ভুলে দলে দলে যোগ দিয়েছেন, তেমনি করে সিন্ধু অভিযানেও পিছ পা হলেন না। হাজ্জাজের ভ্রাতুষ্পুত্র ও একইসাথে জামাতা সতের বছরের মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে অনুর্ধ্ব দশ হাজারের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দাহিরের লক্ষাধিক সৈন্যের মোকাবিলায়। অত্যাচারী রাজার সৈন্যের সংখ্যাধিক্য আর সিন্ধু নদের উত্তাল তরঙ্গ কিছুই রুখতে পারল না তাঁদের। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সিন্দু আর মুলতানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হল। ঐ ক’জন আরবীয় বন্দীর সাথে সাথে মুক্তি পেল সেই সব অসহায় জনগণ জন্মগত উচ্চ-নীচের বিধান যাদের এতদিন অত্যাচারীর পায়ের নীচে পিষ্ট করে দিচ্ছিল।
আজ তাই, বলতে দ্বিধা নেই, এই অনন্য বিজয়গাঁথা যা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামের সাথে যুক্ত করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে সেইসব আপামর জনসাধারণের বিজয় যাঁরা নিজেদের ঘৃনা আর ব্যক্তিগত ক্ষোভকে পাশে রেখে জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন। ইসলাম ও মানবতার প্রতি তাঁদের ভালবাসা ও আন্তরিকতাই এইসব বিজয়ের ভীত গড়ে দিয়েছে। হাজ্জাজ সেই পথে ব্যবহৃত হয়েছেন মাত্র।
তথ্যসূত্রঃ
১. হাজ্জাজ বিন ইউসুফ- উইকিপিডিয়া
২. খেলাফত ও রাজতন্ত্র- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
৩. জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ- মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
৪. মুহাম্মাদ বিন কাসিম- নসীম হিজাযী
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:১৭