আফগানিস্তান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুক গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে নিউইয়র্কে এক বৈঠকে সেনা পাঠানোর অনুরোধ জানান।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে ডা. দীপু মনির বৈঠকের কোন পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশন চলাকালে সেখানেই বৈঠকের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়। বলা যায়, ওই বৈঠক ছিল তাৎক্ষণিক ও আকস্মিক। বৈঠককালে রাষ্ট্রদূত হলব্রুক বলেন, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্ধু দেশ এবং আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের মতো বন্ধু দেশের সহায়তা প্রয়োজন। তিনি আফগানিস্তানে ‘কমব্যাট সৈন্য’ প্রেরণ, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহায়তা প্রদান অথবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সহায়তা কামনা করেন।
হলব্রুক পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এদিকে রবিবার বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনে মার্কিন অনুরোধের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। সাইট জানায়, সেনা মোতায়েনে মার্কিন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার জন্য ঢাকার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তালেবানরা নিজস্ব ওয়েবসাইটে আরবি ও পশতুন ভাষায় একটি সংবাদ প্রকাশ করে।
সংবাদে বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আফগানিস্তানে কয়েকশ’ সেনা পাঠিয়ে ইসলাম ও আফগান জনগণের বিরুদ্ধে নিজ দেশের জনগণকে না জড়ানোর ব্যাপারে বাংলাদেশি নেতার ইসলামী জ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা রয়েছে।’
প্রকাশিত সংবাদে আরো বলা হয়, ‘প্রতিবেশী একটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে ইসলামের চিরন্তন শত্রুকে সহায়তার বিষয় সরকারের সিদ্ধান্ত ইসলামের অনুসারী বাংলাদেশী জনগণ সমর্থন করবে না। বাংলাদেশের জনগণ সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ভুল হিসাবে মনে করে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনা পাঠানো অন্যতম একটি দেশ। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ আফগানিস্তানে কোনো সেনা পাঠায়নি।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী যুদ্ধ করছে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ইরাক ছাড়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ আরো দীর্ঘমেয়াদি হবে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা আফগানিস্তান পরিস্থিতি বুঝতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এটা বাংলাদেশের সরকারকে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশের সেনারা আফগানিস্তানে গেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের বড় ধরনের ভুল ও অদক্ষতা প্রমাণিত হবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সেনাদের কমব্যাট ট্রুপস হিসেবে চেয়েছে। অর্থাৎ সেখানে তাদের দিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করানো হবে। কিন্তু এ যুদ্ধ করার জন্য যে পটভূমি থাকা দরকার, তা তো এখানে নেই। আমাদের সেনারা আফগানিস্তানের ভূ-রাজনীতিও তেমন একটা বুঝবে না। কারণ আমরা আফগানিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা সংশ্লিষ্ট নই।
আফগানিস্তান সার্কের সর্বশেষ সদস্য। দেশটির সার্কের সদস্য হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এখন সেনা পাঠানোর বিষয়ে এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে যাতে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশ সাধারণত আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা অবস্থানের সমালোচনা করে থাকে। যদিও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রতি দেশটির সমর্থন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে একটি আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তার প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বর্তমানে আফগানিস্তানে ১ লাখ ৫০ হাজার বিদেশী সেনা মোতায়েন রয়েছে। সশস্ত্র তালেবান বাহিনীর সঙ্গে গত নয় বছরেরও বেশি সময় তাদের যুদ্ধ চলছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল কায়েদার সন্ত্রাসী হামলায় পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী। ২০১১ সালের জুলাই মাসে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তার আগে আফগানদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীকে দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার মতো সক্ষম করে তোলার প্রচারণা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই পরিকল্পনার ছূতোয় আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণে বাংলাদেশী সেনাদের সহায়তা চায় যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের শুরু থেকে গত নয় বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর তালেবানদের হামলায় বহুজাতিক বাহিনীর বিদেশী সেনা নিহতের সংখ্যা বেশি।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ জাতিসংঘের অধীন বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে বড় অংশ গ্রহণকারী দেশ। এর অধীনে বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠালেও আফগানিস্তানে এখনও পর্যন্ত সৈন্য পাঠায়নি বাংলাদেশ। এর আগে ২০০৩ সালে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরাকে সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়। সে সময় সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ নিয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ঢাকা সফর করেছিলেন। কিন্তু নিজ দেশে জনমনে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কায় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার ইরাকে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে।
বিশ্বে শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দারুণ ভূমিকা রয়েছে। তারা তাদের উদ্দেশ্য, সাহসিকতা ও পেশাদারির জন্য বিশ্বে সুপরিচিত। শান্তিরক্ষী বাহিনীকে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র কেন বিশ্বের সর্বত্র ব্যবহার করতে চায়, তা বোঝা কঠিন কোন বিষয় নয়। তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমরা যদি আফগানিস্তানে আমাদের প্রতিপক্ষকে কেবল আমেরিকাবিরোধী হিসেবে না দেখে পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে বুঝতে পারব, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের ভাগ্য একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। আফগানিস্তান আর পাকিস্তান যদি সংকটে পড়ে, তাহলে এর জন্য ভারত, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোকেও ভুগতে হবে।
অধিকন্থ বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিমপ্রধান দেশ, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে আফগানিস্তানে কোয়ালিশন বাহিনীতে সেনা পাঠানো উচিত হবে না।
উল্লেখ্য, ৯/১১ এর পর শুরু হওয়া সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের আওতায় মার্কিন বাহিনী ৭ অক্টোবর, ২০০১ সালে আফগানস্থান আক্রমণ করে। এসময় ব্রিটিশ সেনারাও তাদের সহযোগী হিসেবে সেখানে যোগ দেয়। মার্কিন ও ব্রিটিশ যৌথ বাহিনী, স্থানীয় তালেবান বিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সহায়তায় তালেবানদেরকে কোণঠাসা করে আফগানস্থানের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্টানস ফোর্স (ইসাফ) আফগানস্থানের রাজধানী কাবুলসহ আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বিশ্বের ৪২টি দেশের সৈন্যরা এই ফোর্সে রয়েছে। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ন্যাটো এই ফোর্সের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ বিদেশী সৈন্য সে দেশে রয়েছে।
২০০৬ সালে তালেবানেরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়। সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই আফগানস্থানে বিদেশী সৈন্যদের হতাহতের খবর আসছে। মার্কিন সামরিক রিপোর্ট অনুযায়ী আফগানস্থানে এ পর্যন্ত প্রায় ২১০০ বিদেশী সেনা নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ২০১০ সালেই মারা গেছে ৫৪১ জন, আহত হয়েছে প্রায় ১২৫০০। এছাড়া এ সময়ে আফগান বাহিনীর প্রায় ৭০০০ সেনা প্রাণ হারিয়েছে। (তবে গণমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী হতাহতের এ সংখ্যা আরো বেশি)
এতো গেলো বিদেশেী সৈন্য। আফগানিস্থানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে এসময় জুড়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫০,০০০ নিরীহ মানুষ। গণমাধ্যমে বারবার এসেছে বিদেশী সেনাদের হাতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। সমপ্রতি উইকিলিকস-এর কল্যাণে ফাঁস হওয়া গোপন মার্কিন দলিলপত্রেও বিদেশী সৈন্যদের হাতে পাইকারি হারে নিরীহ আফগান নাগরিক নিহত হবার বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব কারণে সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড- আফগানস্থান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। পোলান্ড এবং কানাডাও সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। গত একমাসে বেশ কিছু অস্ট্রেলীয় সেনা নিহত হবার পর অস্ট্রেলিয়াও সেনা প্রত্যাহারের কথা ভাবছে।
অর্থাৎ তালেবান আক্রমণে পর্যদুস্ত হতে হতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীরও এমন ত্রাহি ত্রাহি তথা ছেড়ে দে মা কাঁদে বাঁচি অবস্থা। যে কোনভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন তারা আফগানস্থান ছাড়তে উৎগ্রীব। এমন মহাসঙ্কটময় অবস্থায় বাংলাদেশী সৈন্যদের সে দেশে পাঠানো কতোটুকু যৌক্তিক?
বলার অপেক্ষা রাখে না, যে বিন লাদেনের আল কায়েদার সাথে তালেবানদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাই মার্কিনীদের সমর্থনে আফগানস্থানে সেনা পাঠানোর অর্থ হলো আল কায়দার টার্গেটে পরিণত হওয়া। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে আল কায়েদার নজরে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন কি আমাদের রয়েছে?
এদিকে ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় অনেক বাংলাদেশি আফগানস্থানে কর্মরত আছেন। এখন বাংলাদেশ সেখানে সৈন্য পাঠালে এইসব সাধারণ বাংলাদেশীরা সহজেই তালেবানদের বন্দুকের লক্ষ্য হবেন। জেনে শুনে বাংলাদেশীদের, জীবণ মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়াটা কতোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



