
‘আমাদের চার কোটি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করার সময় তাদের নেই ভাই, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা বার বার অনুরোধ করেছিলাম পরীক্ষার সময় তারা যেন হরতাল-অবরোধ না দেন।

আমাদের সন্তানরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে-পিঠে প্ল্যাকার্ড নিয়ে আবেদন জানাল। তবু তারা আমাদের সন্তানদের ক্ষতি করল। আজ বিদেশ থেকে কে একজন আসবেন তার জন্য হরতাল পেছাচ্ছেন তারা। দেশের কোটি কোটি সন্তানের চেয়ে একজন বিদেশীর মূল্য তাদের কাছে অনেক বেশি। আমাকে বিরোধীদলীয় নেত্রীর মোবাইল নম্বরটা দেন, আমি তাঁকে একটিবার হলেও বলব- কেন আমাদের নিয়ে তাঁরা এমন করছেন?’
দেশজুড়ে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার মাঝে ১৮ দলের দফায় দফায় হরতাল; আর সেই হরতালে একের পর এক সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ কোটি কোটি অভিভাবক। হরতালের এ রাজনীতির খেলায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ অভিভাবক ফোরাম নেত্রী আবিদা সুলতানা শনিবার সন্ধ্যায় এভাবেই তাঁর ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন। আরেক অভিভাবক নিপা সুলতানা বললেন, আমার সন্তানের জীবনের কথা বিরোধী নেত্রী ভাবলেন না। তাঁর কাছে আমাদের ক্ষোভের কথা জানাতে চাই। আমাদের সন্তানের মূল্য কোথায়? শনিবার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমনের স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত জোট নতুন করে হরতালের সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে দেয়ার ঘটনায় অভিভাবকদের ক্ষোভ যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষোভ যতটা না হরতাল পিছিয়ে দেয়ার জন্য, তার চেয়ে বেশি দেশের চার কোটিরও বেশি অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নেয়ায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ সবাই দলগুলোর দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদেশীদের স্বার্থকে বড় করে দেখার সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলছেন, এবার যেমন কোটি কোটি শিক্ষার্র্থীর জীবন অনিশ্চিত করে একজন বিদেশীর জন্য নেতারা উদার হয়েছেন, তেমনি এক বছর আগে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত হরতালের সময় মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়িতে হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। অথচ দুঃখ প্রকাশ তো পরের কথা, কর্মসূচীর নামে দেশের শত শত গাড়িতে আগুন দেয়া এমনকি অসংখ্য মানুষ হত্যা করেও আজ পর্যন্ত একবার দায়ও স্বীকার করেনি দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি। বিরোধী দলের হরতালের রাজনীতি আর সেই রাজনীতির খেলায় মাত্র একজনের স্বার্থ রক্ষার বিষয় সম্পর্কে জানা গেল, ২০ লাখ পরীক্ষার্র্থীর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার মাঝে ৭ দিনের হরতালের পর আজ থেকে আবার একই কর্মসূচীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আজ থেকে এ সপ্তাহেও টানা হরতাল ডাকার জন্য প্রস্তুতি ছিল বিরোধী দলের। এবার নির্দলীয় সরকারের দাবির সঙ্গে যোগ হয়েছিল দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টি। জোট নেত্রী খালেদা জিয়া সব প্রস্তুতি শেষও করেছিলেন ১৮ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেই। কিন্তু দফায় দফায় হরতাল ডাকা জোট এবার হরতাল ডাকা থেকে পিছিয়ে এসেছে। আর এর একমাত্র কারণ একজন বিদেশিনী। তবে সাধারণ কোন বিদেশিনী নন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। বিএনপির সূত্রগুলো স্পষ্ট করেই বলছে, তার ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করেই বিএনপির হরতাল থেকে পিছিয়ে আসা। সপ্তাহের শেষ দিন আগামী বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বাহিনী দিবসও বিএনপিকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এমন অবস্থা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করা ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ক্ষেত্রেও দেখায়নি প্রধান বিরোধী দল। তারা ভাবেনি দেশের লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীর কথা। এ সব শিক্ষার্থীর পরীক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বার বার অনুরোধ জানিয়েছেন হরতাল প্রত্যাখ্যান করার। কিন্তু সেসব কারণ বা আহ্বানে মন গলেনি বিরোধী দলের। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অটল থেকে তারা টানা চার দিনের হরতাল দিয়েছে।
আগামীকাল নিশা দেশাই দিল্লী সফরে গেলেই আবার হরতালের প্রস্তুতি নিচ্ছে ১৮ দল। সেক্ষেত্রে আবার সঙ্কটে পড়বে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত ৭ নবেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহেই ছুটির দিন ও একটি-দুটি কার্যদিবস বাদে হরতাল কর্মসূচী থাকবে। তফসিল ঘোষণার পর অবরোধসহ আরও কঠোর কর্মসূচীর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে হরতাল হবে না মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকালে। অথচ অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষার ৫০ লাখ ও সব শ্রেণীর আরও অন্তত সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষার কোন মূল্য নেই এবার বিরোধী দলের কাছে। চার কোটি শিক্ষার্থী ও তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের আকুল আবেদন, শিক্ষামন্ত্রী এমনকি দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের অনুরোধ কোন কিছুই স্পর্শ করল না হরতালের পক্ষে থাকা ১৮ দলের নেতা-নেত্রীদের। এক দফার ৬০ ঘণ্টার হরতালে জেএসসি ও জেডিসির ২০ লাখ শিক্ষার্থীর প্রথম দুই পরীক্ষার সঙ্কট কাটতে না কাটতেই আবার টানা ৮৪ ঘণ্টার হরতালে পুরোপুরি অনিশ্চিত পড়েছে এবারের সব পাবলিক পরীক্ষা। দফায় দফায় হরতালে পরীক্ষা পিছিয়ে নেয়ার পথও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অষ্টম শ্রেণীর এ পরীক্ষা কবে হবে কিংবা শেষ করা যাবে কিনা, সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আর এ পরীক্ষা এভাবে স্থগিত হতে থাকায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর আসন্ন প্রাথমিক সমাপনী, সব শ্রেণীর বার্ষিক ও ভর্তিপরীক্ষাসহ সব পরীক্ষাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জীবনের কথা ভেবে দলগুলো কর্মসূচী দেয়নি। অথচ একজনের স্বার্থ ঠিকই দেখেছেন। ‘আমাদের চার কোটি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করার সময় তাদের নেই ভাই, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা বার বার অনুরাধ করেছিলাম পরীক্ষার সময় তারা যেন হরতাল-অবরোধ না দেন কিন্তু লাভ হয়নি।’ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ এমএ সাত্তার হতাশা প্রকাশ করে বলেন, পরীক্ষার কথা চিন্তা করে কর্মসূচী দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল কোটি কোটি অভিভাবক। আমাদের সন্তানরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে-পিঠে প্ল্যাকার্ড নিয়ে আবেদন জানাল। তবু তারা আমাদের সন্তানদের ক্ষতি করল। দেশের কোটি কোটি সন্তানের চেয়ে একজন বিদেশীর মূল্য তাদের কাছে বেশি। আমাদের কোটি কোটি শিক্ষার্থী হরতাল, অবরোধের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীতে উদ্বিগ্ন। বিরোধী দলে থাকলেই যা খুশি তা করা যায় না। দেশের স্বার্থ না দেখলেও বিদেশের স্বার্থ দেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা এই দলগুলো আগেও দেখিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে হরতালের সময় প্রগতি সরণিতে মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ি ভাংচুর ও গাড়িচালক আহত হওয়ার জন্য জামায়াতের দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার খবর এখনও ভুলে যায়নি কেউ। ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সঙ্গে সঙ্গেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুল ইসলাম মাসুদ বিবৃতি দিয়ে ওই হামলার দায় নিয়ে বলেছিলেন, দুঃখজনক এ ঘটনার ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্ত শেষে এর দায়িত্ব আমরা প্রহণ করছি এবং নিন্দা জানাচ্ছি। এ ঘটনার জন্য দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এর ক্ষতিপূরণ দিতে আমরা প্রস্তুত। জামায়াতে ইসলামী মার্কিন দূতাবাসের গাড়ি ভাংচুরের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও বাংলাদেশের মানুষের যে সম্পদ বিনষ্ট করেছে, তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলেনি। তারা একটি গাড়ি ভাংচুরের জন্য মার্কিন দূতাবাসের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু মাসের পর মাস সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা যে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য চালাচ্ছে, পুলিশসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতেই প্রমাণিত হয়, ইসলামের নামধারী মৌলবাদী এই দলটির দায়বদ্ধতা কার কাছে। দেশের মানুষের প্রতি কী তাদের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই?
দেশের সম্পদ বিনষ্ট হওয়ায় তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। তাদের সব দায়বদ্ধতা, সব অনুশোচনা কেবল বিশেষ কারও প্রতি। শনিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াসিম জাফর তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘বিএনপি এক মার্কিনীর স্বার্থ দেখল কিন্তু আমাদের স্বার্থ দেখল না। জামায়াত বিন্দুমাত্র অনুশোচনা না করলেও হরতালে মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়িতে হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে আমরাও প্রস্তুত হচ্ছি। স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর হিসাবের জবাব নেবে এ দেশের নতুন প্রজন্ম।’ শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন পাটোয়ারী বলছিলেন, গোটা দেশ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে হরতাল অবরোধের রাজনীতি। হরতালের দিন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ি ভাংচুর করার জন্য দলের পক্ষ থেকে তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে, ক্ষতিপূরণ দেয়ারও প্রস্তাব করেছে।
অথচ জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দেশে কয়েক শ’ যানবাহনে হামলা করেছে। ভাংচুর ও আগুন দিয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে একবারও স্বীকার করা হয়নি যে, তাদের দলের নেতাকর্মীরা এ সব যানবাহন ভাংচুর ও পোড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দুঃখ প্রকাশ করা তো দূরের বিষয়, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বোধহয় কল্পনারও বাইরের কথা।

সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




