
পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব পাস ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলি খানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া কাদের মোল্লাই একাত্তরের সেই কসাই কাদের। যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী এবং কাদের মোল্লা নিজেই বলে যাচ্ছিলেন তিনি মিরপুরের কসাই কাদের নন। এদিকে কাদের মোল্লার পক্ষে সাফাই গেয়ে পাক পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাসের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ সরকার গতকাল তাত্ক্ষণিক তলব করে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহেদি হাশমি কোরেশিকে।
ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে গতকাল সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তান চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার পক্ষে সাফাই গেয়ে সংসদে প্রস্তাব পাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে তলবের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আধঘণ্টা বসিয়ে রেখে পরে আধঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ক সচিব মুস্তাফা কামাল। এ সময় হাইকমিশনারের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে কড়া ভাষার প্রতিবাদপত্র (এইডে মেমোয়ার) হস্তান্তর করা হয়।
কাদের মোল্লার পক্ষে সাফাই গেয়ে পাকিস্তান সংসদের প্রস্তাব ও দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি এবং পাকিস্তান জামাত, সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দলসহ সে দেশের আরও কয়েকটি দলের বিবৃতি এটাই প্রমাণ করে দেয় ফাঁসি হওয়া কাদের মোল্লাই ছিল ১৯৭১ সালের কসাই কাদের। যদিও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনির কাছে কথিত এক চিঠিতে কসাই কাদের দাবি করেছিলেন, ‘আমি কাদের ও ১৯৭১ সালের রাজাকার কাদের এক নই।’ পাকিস্তানের এই আস্ফাালন অবশ্য রনির কাছে লেখা কাদের মোল্লার সেই চিঠিকে ভিত্তিহীন করে দিয়ে প্রমাণ করল এই কাদেরই সেই কাদের।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর নিয়ে পাকিস্তান একেবারেই শোরগোল শুরু করে দেয়। দেশটির জাতীয় পরিষদে কসাই কাদেরের পক্ষে সোমবার একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়। অবশ্য এর আগে গত শুক্রবার থেকেই পাকিস্তানে বিভিন্নভাবে ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছিল। সর্বশেষ সোমবার প্রস্তাব পাস হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। এ নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দার ঝড় উঠলে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। গতকাল দুপুরেই তাকে তলবের কথা জানিয়ে বিকাল পাঁচটার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়।
হাইকমিশনার মেহেদি হাশমি বিকাল পাঁচটার কিছু আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। তার সঙ্গে হাইকমিশনের দুজন কর্মকর্তা ছিলেন। গাড়ি থেকে নামার পর তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিচতলার অতিথি কক্ষে বসতে বলা হয়। সেখানে প্রায় আধঘণ্টা সময় তাকে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর পাঁচটা ২৫ মিনিটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দুই তলায় পররাষ্ট্র সচিব (বহুপক্ষীয়) মুস্তাফা কামালের কক্ষে। সেখানে মুস্তাফা কামাল বাংলাদেশের অবস্থানপত্র তার হাতে তুলে দেন এবং এটি পাঠ করে শোনান। এই প্রতিবাদপত্র (এইডে মেমোয়ার) পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়ার জন্যও তাকে বলে দেয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ওই পত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এবং কাদের মোল্লার আইনি লড়াইয়ের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই বিচার প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের জন্যও প্রয়োজনীয় বলে এতে বলা হয়।
গত সোমবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাংসদ শের আকবর খান এই প্রস্তাব উত্থাপন করলে তাতে সমর্থন জানায় সরকারি দল মুসলিম লীগ। এ ছাড়া ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়েদে আযম) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আনা এই প্রস্তাবে অবশ্য সমর্থন দেয়নি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)। পিপিপির সাংসদ আবদুল সাত্তার বাচানি পরিষদকে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পুরো বিষয়টিই বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের উচিত হবে না একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব পাস করা।’
পাক সংসদের প্রস্তাবটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত হবে না ৪২ বছর আগের পুরনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা। এতে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত সব ধরনের মামলা ‘পারস্পরিক সমঝোতা’র ভিত্তিতে প্রত্যাহার করে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাক পার্লামেন্টের ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে শহীদদের ব্যাপারে কোনো শোক বা দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু ফাঁসি হওয়া কাদের মোল্লার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়। শুধু তাই নয়, ফাঁসি দেয়ার ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করা হয়। কাদেরের ফাঁসি হওয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিও সমবেদনা জানায় পাক সংসদ।
কসাই কাদেরই যে কাদের মোল্লা তার প্রমাণ আরও দিয়েছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান। চৌধুরী নিসার আলী খান রবিবার পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে বলেন, কাদের মোল্লর ফাঁসি পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত মর্মান্তিক পদক্ষেপ। মোল্লাকে ফাঁসি দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের পুরনো ক্ষতে আঘাত করেছে মন্তব্য করে নিসার আলী আরও বলেন, ১৯৭১ সালে কাদের মোল্লা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানের মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও দুঃখভারাক্রান্ত। তিনি বলেছেন, ফাঁসি হওয়া কাদের মোল্লা পাকিস্তানের মানুষ এবং অখণ্ড পাকিস্তানের পুরনো বন্ধু।
এদিকে একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা নির্দোষ ছিলেন বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে রাজনৈতিক নেতা ইমরান খান। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভে সুর মিলিয়ে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের প্রধান এই দাবি করেছেন বলে পাকিস্তানের দৈনিক দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে। রেডিও পাকিস্তানকে উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমরান এক আইনজীবীকে বলেছেন যে কাদের মোল্লা নির্দোষ ছিলেন এবং যেসব অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে দণ্ডিত করা হয়েছে, তার সঙ্গে জামায়াত নেতার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বর্বরতা চালানোর অন্যতম হোতা আবদুল্লাহ আহমেদ নিয়াজীর স্বজন ইমরান খান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘রিপ্রাইভ’-এর আইনজীবীকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেন বলে রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে যে কয়টি মানবাধিকার সংগঠন কথা বলে আসছে, তার মধ্যে রিপ্রাইভ একটি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর নিন্দায় ফেটে পড়ে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী। পরদিন জুমার নামাজের পর পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেয় দলটি। পাকিস্তান জামায়াতের মতে, কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে হত্যা করা হয়েছে। কাদের মোল্লাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান জামায়াত জানায়, তাদের বাংলাদেশ শাখার একজন মহান নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিও দলটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় নীরব ভূমিকার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে পাকিস্তান জামায়াত।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাব পাসসহ বিভিন্ন নেতৃস্থানীয়ের বক্তব্য-বিবৃতির নিন্দা জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মঙ্গলবার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, পাকিস্তান ’৭১-এর নীতি থেকে সরে আসেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ’৭১-এর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। এর আগে গত বছর নভেম্বরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার ঢাকা সফরে এলে সে সময় ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি আবারও উঠে আসে। তবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি সরকারকে ভবিষ্যত্মুখী রাজনীতির পরামর্শ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন।
সুত্র

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



