ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই ছাত্রীর বাসায় উপস্থিত হলাম। পড়ানোর জন্য একটা আলাদা রুম আছে। অন্যদিনগুলোতে আমি যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাত্রী চলে আসে। আজ কেন জানি দেরি করছে। ভাবলাম কোন কিছু রেডি করতে দেরি হচ্ছে। বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম। গণিতের চাপ্টারটা আজকেই শেষ করতে হবে। কিছুক্ষণ পর ছাত্রীর মা এসে জানালো ছাত্রীর শরীর খারাপ লাগছে তাই আজকে পড়তে পারবে না। মেজাজ কিছুটা খারাপ হলো। কষ্ট করে পড়াতে আসলাম আর উনার শরীর খারাপ বলে পড়বে না। অবশ্য মেজাজ খারাপ টিকলো খুব অল্প সময়। পরক্ষণই চিন্তা করলাম কারো শরীর খারাপ হতেই পারে। শরীর খারাপ নিয়ে পড়তে কারইবা ভালো লাগে! উঠে চলে আসবো এমন সময় ছাত্রীর মা বললো-
তুমি একটু বসো। গতকাল তোমার ছাত্রীর জন্মদিন ছিল। কেক আনা হয়েছিল সে উপলক্ষ্যে। কেক খেয়ে যাও।
ওহ! তাই নাকি! কালকে তার জন্মদিন ছিল! আমিতো জানতাম না।
তবে সে নিজে বাসায় কেক কাটে নি। কার উপরে রাগ করে কেক কাটেনি কে জানে। কেক ফ্রিজে তুলে রাখা হয়েছে। তুমি বসো, তোমার জন্য নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ বসার পর কেক আসলো। ছাত্রীর মার কাছে ছাত্রীর জন্মদিন শুনেই চমকে উঠে আমি রিয়েক্ট করলাম। কিন্তু আমিতো আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। ছাত্রী আমাকে বার্থ ডে এর কথা জিজ্ঞেস করলো, রুটিনে নেই এমন একটা দিনে যেতে বললো। তখনই ধারণা করছিলাম দিনটা হয়তো ছাত্রীর জন্মদিন। তাহলে কি ছাত্রীর মায়ের সামনে ওই রিয়েক্ট এক ধরনের অভিনয়! নিজের ভিতরেই প্যারাডক্স নিয়ে বেড়াচ্ছি। এই বিষয়ক ভাবনাটাকে বাড়তে না দিয়ে কেক খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ফেরার পথে অবন্তীদের বাসার সামনের রাস্তাটায় আসতেই ইচ্ছা হলো তার সাথে দেখা করে যাই। ভিতর বাড়িতে গিয়ে দেখি অবন্তী বাগানে বসে বই পড়ছে। কাছে গিয়ে দাড়াতেই বললো-
আমি জানতাম আপনি আজকে আসবেন।
আশ্চর্য! আপনি আসবো আপনি জানতেন কিভাবে? আমি আপনাকে আগে বলিনি। তাছাড়া আমার আজকের আসার ব্যাপারে প্ল্যান ছিল না। হুট করে চলে আসলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম।মনে মনে ভাবলাম চাপাবাজির আর জায়গা পাওনি। আমি আসলাম আর ভাব নিয়ে বলে দিলে- আমি জানতাম আপনি আজকে আসবেন!
আমার মনে হচ্ছিল আপনি আসবেন, তাই বললাম। কিন্তু আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। ঠিক তাহলে দেখেন এই ঘড়িটা।বলেই অবন্তী পাশের টেবিল থেকে সুন্দর একটা হাতঘড়ি বের করলো।
এই ঘড়ি কি প্রমাণ করে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আপনাকে দিব বলেই গতকাল ঘড়িটা কিনেছিলাম। মনে হচ্ছিল আপনি আজকে আসবেন, তাই ঘড়িটি নিয়ে বসে ছিলাম।
এবার বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম অবন্তীর অনুমানকে। গতকাল আমাকে এক জায়গায় দাড় করিয়ে রেখে অবন্তী কয়েকটা দোকান ঘুরে বেড়িয়েছিল। তখনই হয়তো ঘড়িটা কিনেছে।আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবন্তী বললো-
নেন জনাব, ঘড়িটা পড়ে নেন। আপনিতো বিজি মানুষ। তাই হাতঘড়ি বেশ কাজে লাগবে।
অবন্তীর খোঁচা দেওয়া কথাটা শোনার পরও ঘড়িটা হতে নিলাম। মনের ভিতর তখন অন্য ভাবনা। মেয়েটা চাইলেই গতকাল ঘড়িটা দিতো পারতো। তা না করে আজকে দিল। এইটা কেমন ধরনের সাইকোলজি। মেয়েদের সাইকোলজি বুঝা একজীবনে সম্ভব না। এই উপলব্ধি আরেকটু গাঢ় হলো। সিগমন্ড ফ্রয়েডতো সাইকোলজি, ইড, ইগো, সুপারইগো নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেছেন। মেয়েদের মনের সাইকোলজি নিয়ে তার কোন কথাবার্তা আছে কি,মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
পরের দিন পড়াতে গিয়েও জানলাম ছাত্রী পড়বে না। ঘরে নাকি একলা বসে আছে। মন খারাপ, তাই পড়বে না। এদের যে কতো ধরনের যুক্তি! ছাত্রীর মা বললো, স্যরি তোমাকে পরপর দুইদিন এসে ফিরে যেতো হলো।
আন্টি, আপনি স্যরি হচ্ছেন কেন?। ইট’স ওকে।
তোমার কোন জরুরী কাজ না থাকলে বসো। অনেকদিনইতো হয়ে গেল তুমি পড়াচ্ছো, কিন্তু তোমার বিষয়ে কেমন জানা হলো না।
আপনি জানতে চাননি বলেই বলা হয়ে উঠে নি। আমি বললাম।
তুমি বসো, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি। বলেই ভিতর রুমে চলে গেল ছাত্রীর মা।
বসে বসে ভাবতে লাগলাম হঠাৎ করে ছাত্রীর মা আমার সমন্ধে জানতে চাচ্ছে কেন! একবছর হয়ে গেল ছাত্রীকে পড়াচ্ছি। এতোদিন জানতে চায় নি। চায়ের সঙ্গে বিকালের নাস্তা নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন ছাত্রীর মা। টেবিলে রেখেই জিজ্ঞেস করলো-
এইবার বলো ঢাকায় তোমার কে কে থাকে?
ঢাকায় আমি একলাই থাকি। দুইজন মিলে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। সেখানেই থাকা হয়।
ওহ! তোমার বাবা মা তাহলে কোথায় থাকে? আর কে কে আছে তোমার?
আব্বু- আম্মু গ্রামে থাকে। ছোট ভাইবোন আছে দু্ইজন। তারা গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করছে।
তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে? খরচ কে দেয়? ছাত্রীর মা উত্তর শেষ না হতেই নতুন নতুন প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।
লেখাপড়া ভালো বলছে। খরচ আমিই যোগাড় করি। এখন আর বাড়ি থেকে পড়ালেখার খরচ আনতে ভালো লাগে না। বলতে পারেন এটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের এক ধরনের সেন্টিমেন্ট।
আরো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েই তবে যে যাত্রা ছাড়া পেলাম।
বাসায় এসে হাতঘড়িটা উল্টে পাল্টে দেখছি। কিছুক্ষণ পরপরই সময়ের কথা তুলছি। যেমন- রাত সাড়ে ৮ টা বেজে গেছে এখনো বুয়া রান্না করতে আসলো না! ১০ টা বাজে খেয়ে নেই। খাইছে! রাতে সাড়ে ১২টা বেজে গেছে এখনো কিছুই পড়া হয়নি।
এতোবার সময় বলার বিষয়টা মনে হয় রুমমেটের কানে লাগলো। তাকিয়ে দেখে আমার হাতে নতুন ঘড়ি। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
নতুন ঘড়ি কিনছো নাকি? কতো নিল?
আমি জবাবে কিছু না কেবল মুচকি হাসলাম।
পরবর্তী কয়েকদিন ছাত্রীকে পড়াতে গেলাম না। কিছুদিন বিরতির পর ছাত্রীকে পড়াতে গেলাম। পড়ানোর রুমে বসার কিছুক্ষণ পরে ছাত্রী আসলো। দেখে বিমর্ষ মনে হলো, আগের মতো চঞ্চলতা নেই। মনে মনে একটা ভয় কাজ করছিল। সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করে বসে কিনা। যদি জিজ্ঞেস করে সেদিন আপনার সঙ্গে কে ছিল, তাহলে আপনি কি উত্তর দিব তাই ভাবছিলাম। খাতা টেনে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম।
কি ব্যাপার! পড়াতে আসলে পড়ো না। কি হইছে তোমার?
ভালো লাগছিলো না তাই পড়িনি।
এটা কেমন কথা? তোমার পড়া তোমাকেই পড়তে হবে। এটাতো আর অন্য কেউ পড়ে দিবে না। মন খারাপ করে আছো কেন? আমি বললাম।
সেটা আপনাকে বলতে হবে কেন? আমার কেন মন খারাপ আপনার তা জানতে হবে না। গম্ভীর হয়ে জানানো ছাত্রী।
একটু চমকে গেলাম তার গম্ভীরতায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে পড়তে বসো। ছাত্রী কথা না বাড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমিও কিছু বললাম না বিষয়টা সম্পর্কে। কিছুক্ষণ পর ছাত্রী বললো,
স্যার আপনাকে ছোট একটা গল্প বলি?
না বলতে গিয়েও বলে ফেললাম, হ্যা বলো। সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রী বলা শুরু করলো।
একটা প্রজাপতির স্বপ্ন ছিল উড়ে বেড়াবে মনের আনন্দ নিয়ে। ফুলের রং দেখবে, আকাশের বিশালতা উপলব্ধি করবে,রংধনুর রংয়ের সাথে নিজের পাখনার রং মিলাবে। কখনোবা উড়তে উড়তে সাগরের কাছে চলে যাবে। প্রজাপতির স্বপ্ন প্রিয় কারো সাথে একসাথে উড়ে বেড়াবে। কিন্তু প্রজাপতিটা যাকে প্রিয় ভাবে, সে তাকে পাত্তাই দেয় না। তবুএ প্রজাপতি আশা ছাড়ে না। উড়তে শিখতে চায়। একদিন উড়তে শিখতে গিয়ে খেই হারিয়ে প্রজাপতিটি ছোট্র গাছের পাতার উপর পড়ে গেল। আকড়ে ধরতে চেয়েছিল সেই পাতাকে। কিন্তু তা হলো না। নিচে পড়ে গিয়ে প্রজাপতিটা পাখনা হারিয়ে ফেলে। আপনিই বলেন স্যার, যে প্রজাপতি পাখনা হারিয়ে ফেলে সে কি আর উড়তে পারে, নাকি উড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে?
কিছু বলার সাহস পেলাম না। চুপ করে বসে থাকলাম আমি।
(চলবে......)
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:৫২