somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগের সাহিত্য ও ব্লগ সাহিত্য

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১১ ভোর ৬:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্লগ কি সাহিত্য? অর্থাৎ ব্লগে আমরা যেসব গল্প-কবিতা পড়ি সেগুলোকে সাহিত্য বলা যায়? আরও কিছু প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবেই পাশাপাশি চলে আসে। যদি ব্লগের গল্প, কবিতা, উপন্যাসগুলোকে সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী হবে? ব্লগাস্ফিয়ারের বাইরে এদের অবস্থান কেমন হবে? এই প্রশ্নগুলো উঠেছিল ব্লগে কিছু কিছু পোস্টের মাধ্যমে। মোটাদাগে বলতে গেলে এই প্রশ্নগুলো এখন অনেকটাই মীমাংসিত। এপ্রসঙ্গে মনে করে যেতে পারে ২০০৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রথম কোন ব্লগারের লেখা বই প্রকাশিত হয়। ব্লগার শুভ (আলী মাহমেদ) এর লেখা বইটির নাম ‌শুভ’র ব্লগিং। ব্লগার শুভর লেখা ব্লগ পোস্টগুলোই বই আকারে প্রকাশিত হয়। বাংলা কমিউনিটি ব্লগের মাত্র ১ বছর ২ মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব সামনে এনে দেয় এই বইটি। উত্তরটি হলো ব্লগের পোস্টও বই আকারে প্রকাশ হতে পারে। শুভ’র ব্লগিং বইটিতে মূলত ছিল বিভিন্ন ইস্যুতে ব্লগার শুভ’র মতামতর্ধমী ব্লগপোস্ট। সেই অর্থে একটি প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। সেটি হলো ব্লগের গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতা বই আকারে প্রকাশিত হবে কিনা। এই আলোচনাও এরইমধ্যে মীমাংসিত। কারণ ব্লগে প্রকাশিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস এরইমধ্যে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। একটা প্রশ্ন অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবেই করা যায়। এই বইগুলোর সাহিত্যমান কতোটুকু। সাহিত্যের ডিসকোর্সে কতোটা প্রভাব রাখতে পেরেছে ব্লগের কিংবা ব্লগারদের বই। এই আলোচনায় নানামত রয়েছে, বিরোধ রয়েছে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে কিছু কিছু বই সাহিত্যমানের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখার দাবি করতে পারে।

ভিন্ন আঙ্গিকে যদি প্রশ্ন করা, ব্লগ কি সাহিত্য? এই প্রশ্ন পুরো ব্লগের জন্যই। ব্লগে নানা ধরনের লেখালেখি হয়। এরমধ্যে আছে দিনলিপি, স্মৃতিচারণ, চলমান ঘটনার বিশ্লেষণ, মতামত, জার্নাল, সিনেমা ও বই সমালোচনা, ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক লেখা, ছবি ও ছবির আলোচনা, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া ইত্যাদি। এরমধ্য থেকে আলোচনার সুবিধার্থে গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও ছড়াকে শুরুতেই সাহিত্য হিসেবে ধরে নেওয়া যাক। এর বাইরে বাকি যে বিষয়গুলো রয়েছে তা কি সাহিত্য? এই বিতর্কে দুইদিকেই ব্লগারদের অবস্থান রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন- ব্লগ সাহিত্য। এখানে লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস তো অবশ্যই সাহিত্য, এর পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় ব্লগে প্রকাশিত হয় যেগুলোকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবেই মনে হয়। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন- ব্লগ মূলধারার সাহিত্য না, কারণ এতে দিনলিপি ঢুকে যায় অনেকটাই। দিনলিপির সংস্রবটা সমস্যা না। মূলধারার সাহিত্যে সবটা সাহিত্যিক/শৈল্পিক সৃষ্টি খুব গাঢ় হয়, ব্লগে সেটা ছড়িয়ে থাকে হাজারটা ছোট ছোট কথায়।

কোন কোন ব্লগার অবশ্য ব্লগকে লেখালেখি চর্চা করার জায়গা হিসেবে দেখেছেন। তাদের মতে, ব্লগ লেখালেখি মকশো করার জায়গা হিসেবে মন্দ না। এখানে সম্পাদকের শাসন নেই, প্রত্যাখ্যাত হয়ে নবীন লেখকের মুষড়ে পড়ার ভয় নেই। বরং আছে তাৎক্ষণিক মন্তব্যে ভালোমন্দ যাচাইয়ের সুবিধা। অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারলে তা ফল দেবে, কেউ কেউ ভালো লেখকও হয়ে উঠবেন। আবার কোন কোন ব্লগার ব্লগকে লেখকের মার্কেটিংয়ের জায়গা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। বই প্রকাশে এবং প্রচারের সঙ্গে মার্কেটিং জড়িত। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের বর্তমান অবস্থা নীরিক্ষা করলে দেখা যাবে এখানে কয়েকজন লেখকের বই-ই ঘুরে ফিরে বেশি বিক্রি হয়। এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫-২০ জনের বেশি হবে না। বাকি লেখকদের বই বিক্রির পরিমান খুবই কম। এই ‘সর্বোচ্চ ১৫-২০ লেখকই’ ঘুরে ফিরে বছরজুড়ে মূল সাহিত্যালোচনায় থাকছেন, পত্রিকার সাহিত্য পাতায় এদের লেখা কিংবা এদের লেখার সমালোচনা ছাপা হচ্ছে। ফলে পাঠক ঘুরেফিরে তাদের লেখার সাথেই পরিচিত হচ্ছেন এবং তাদের বই কিনছেন। যে আলোচনাটি এখানে প্রাসঙ্গিক তা হলো পাঠক যদি কোন লেখকের লেখার সাথে পরিচিত না থাকেন তাহলে তিনি কেন সেই লেখকের কোন বই কিনবেন? ব্লগ এই বিষয়টির ক্ষেত্রে একটি পর্যবেক্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ব্লগারদের বই ভালো বিক্রি হয়েছে। এর কারণ ব্লগাররা তাদের লেখালেখি প্রকাশের জায়গা পেয়েছেন, পাঠকের কাছে পৌঁছানোর উপায় পেয়েছেন। তাছাড়া ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে ব্লগারদের সার্কেলও হয়ে গেছে। ফলে নতুন লেখকদের সাহিত্য করার জন্য ব্লগ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।

সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ব্লগের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ব্লগার পান্থ রহমান রেজা লেখেছেন, ‘আমার ধারণা, ব্লগ বর্তমানে আমাদের ভুবনে নতুন বিষয় হলেও আগামী দিনে এটাই লেখালেখির (সাহিত্যচর্চার) বড় একটি মাধ্যম হয়ে উঠবে। নতুন ব্লগভিত্তিক সাহিত্যিকগোষ্ঠীর পাশাপাশি মুলধারার লেখকরাও ব্লগ সাহিত্যে আসবেন। নিয়মিত লিখবেন। আর এজন্যই ব্লগের পাঠকদের মেজাজ মর্জির খোঁজখবর রাখা দরকার বলে আমি মনে করি। এটা বরং যারা আগামী দিনে ব্লগ নির্ভর সাহিত্য করবেন, তাদের কাজে দেবে। (পান্থ রহমান রেজা, নতুন দিনের ব্লগ সাহিত্য, একটি অভিমত, সচলায়তন, জুলাই ২০০৮)। ব্লগ ও সাহিত্যের পার্থক্য নিয়ে ব্লগেই বেশকিছু বিতর্ক হয়েছে। সেই বিতর্কে ব্লগারদের নানা মন্তব্য এসেছে। সেইসব মন্তব্য থেকে প্রাসঙ্গিক দুইটি মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। ব্লগার ইশতিয়াক রউফ লেখেছেন, “সাহিত্যরস উপলব্ধির জন্য অনেক সময় দরকার, স্থির চিত্ত দরকার। সাহিত্য সময় লিখিত, পঠিত। ব্লগ সেই তুলনায় অনেকটাই ‘দৌঁড়ের উপর’ লেখা। এই গতিই ব্লগকে আলাদা করে দেয় অন্য যেকোন মাধ্যম থেকে। গতির কারণেই লেখার আকার সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে ব্লগে। সময়ের স্বল্পতার কারণেই সময়ের সাথে সাথে আরো গতিশীল মাধ্যম আসবে।” (ইশতিয়াক রউফ, সচলায়তন, ২০০৮)। ইশতিয়াক রউফ ব্লগের গতির কথা বলেছেন। এই কথার সত্যতা মেলে ব্লগের পোস্ট ও মন্তব্যগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে। পোস্ট খুব বড় হলে সহব্লগারদের কাছ থেকে অনুযোগ লক্ষ্য করা যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্লগের গতির চর্চা রয়েছে। তবে সময় নিয়ে ব্লগ লিখে তা প্রকাশ করার প্রবণতাও বেড়েছে। ব্লগার রণদীপম বসু মন্তব্যে লেখেছেন, “ব্লগ আর সাহিত্য, দুটোকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা কি ঠিক? সাহিত্য যদি হয় সংযোগ বা সমন্বয়সূত্র, অতীতের সাথে বর্তমানের, লেখকের সাথে পাঠকের, পাঠকের সাথে পাঠকের, যাপিত জীবনের বাস্তবতার সাথে মানবমনের উপলব্ধির, ব্লগ কি এর বাইরে? এই যে আমরা ব্লগরব্লগর করছি, এটা সাহিত্য নয় কে বললো? সাহিত্য তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আনা কোন আচানক জিনিস নয়। যদি আসেও, পৃথিবীর সংশ্লেষণে তাও তো সাহিত্যের অংশ হয়ে যাচ্ছে। ব্লগে যিনি কবিতা লিখছেন, যিনি ছড়া লিখছেন, যিনি ভ্রমন কাহিনী লিখছেন, যিনি আজাইরা প্যাঁচালের নামে তাৎক্ষণিক অনুভূতি প্রকাশ করছেন, যিনি প্রবন্ধ নিবন্ধের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ ঘটাচ্ছেন, কোনটা সাহিত্য নয় ? শুধু গল্প কবিতা উপন্যাস বা প্রবন্ধ নিবন্ধকেই সাহিত্য নাম দিয়ে যারা সাহিত্যকে জানতে অজান্তে গন্ডিবদ্ধ করে ফেলছেন, তারা মূলত ব্লগ নামের দ্রুত কার্যকর ও বিশাল সম্ভাবনাময় একটা মাধ্যমকে খন্ডিত দৃষ্টিতে দেখছেন বলে আমার বিশ্বাস। ব্লগে যিনি কেবল মাত্র মন্তব্য করছেন, তিনিও সাহিত্যস্রোতের বাইরে নন। ব্লগার মানেই হচ্ছে সময়ের অগ্রবর্তী সাহিত্যিক সত্ত্বা।” (রণদীপম বসু, সচলায়তন, ২০০৮)

ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে কি তাহলে লেখক তৈরি হচ্ছে? বাংলা ব্লগিংয়ের সঙ্গে যারা জড়িত তারা এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিবেন বলেই মনে হয়। ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে ‘মূলধারার সাহিত্য পাতার’ লেখক হয়ে উঠেছেন। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ব্লগারের গল্প, কবিতা মূলধারার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, ‘মূলধারার সাহিত্য পাতায়’ লেখা প্রকাশিত হলেই তাকে লেখক বলা যাবে কিনা সেই বিতর্কে এখানে যেতে চাচ্ছি না। ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে লেখক তৈরি হওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক লেখেছেন, “ব্লগে লিখে লিখেই অনেক শক্তিশালী লেখকের সৃষ্টি হয়েছে। ব্লগ কমিউনিটি তাদের লেখালেখির সুযোগ করে না দিলে হয়তো সংবাদপত্র-লিটল ম্যাগাজিনের মতো দ্বাররক্ষক-নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমে লেখালেখি করে লেখক হয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। কেবল সামহ্যোয়ার ব্লগে লিখেই আবির্ভাব ঘটেছে (অ)গাণিতিক (তানভীরুল ইসলাম), আকাশচুরি (তারিক স্বপন), মোস্তাফিজ রিপনের মতো গল্পকারের। ২০০৯ সালে সামহ্যোয়ার-এর ব্লগারদের বাৎসরিক প্রকাশনা ‘অপরবাস্তব ৩’-এ এরকম বেশ কয়েকজন শক্তিশালী নতুন গল্পকারের গল্প প্রকাশিত হয়েছে। আবার সাইবারমাধ্যমে লিখতে লিখতে মুদ্রণমাধ্যমে গ্রন্থপ্রকাশে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন অনেকেই এবং এর সংখ্যা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে।” (ফাহমিদুল হক, বাংলা ব্লগ কমিউনিটি : মতপ্রকাশ, ভার্চুয়াল প্রতিরোধ অথবা বিচ্ছিন্ন মানুষের কমিউনিটি গড়ার ক্ষুধা, যোগাযোগ, ডিসেম্বর ২০১০)। অন্যদিকে কথাসাহিত্যিক ও ব্লগার আহমাদ মোস্তফা কামাল এ সম্পর্কে লেখেছেন, “ব্লগের ক্রমবর্ধমান বিকাশ দেখে মনে হচ্ছে, ক্রমশই এই বিষয়টি তরুণ সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। যারা কোনোদিন লেখার কথা ভাবেনও নি, তারাও হয়তো লিখতে শুরু করেছেন। লিখতে লিখতেই শিখে গেছেন, আলোচনা সমালোচনা উপদেশ পরামর্শ তাদেরকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে। আর এখানেই ব্লগ অন্যান্য যে কোনো মাধ্যমের থেকে আলাদা ও অধিকতর আকর্ষণীয়। সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এখানে একজন লেখকের গড়ে ওঠার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়।” (আহমাদ মোস্তফা কামাল, অপরবাস্তব:সাহিত্যচর্চার নতুন ধরন, বইয়ের জগৎ, ২০০৯)

সমকালীন বাংলা কমিউনিটি ব্লগ শিরোনামের একটি লেখায় ব্লগার শেখ আমিনুল ইসলাম লেখেছেন, সবুজপত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে যে রেঁনেসার সূত্রপাত হয়েছিল, একটি অমিত সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল, যারা আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনেক উঁচুতে। বর্তমানে বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলোকে কেন্দ্র করে তেমনই রেঁনেসা শুরু হয়ে গেছে। ব্লগগুলো থেকে তৈরি হচ্ছেন অনেক প্রতিভাশীল ও অমিত সম্ভাবনাময় কবি ও সাহিত্যিক। বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী ও সাহিত্যে নব-সংযোজন লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা চলছে। এখান থেকেও বের হয়ে আসবে অনেক প্রতিভাশালী লেখক, কবি ও সাহিত্যিক। প্রতি বছর অমর একুশে বই মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলোতে পড়ে যায় সাঁজ সাঁজ রব। বিভিন্ন ব্লগ কর্তৃপক্ষ ও ব্লগারদের ব্যাক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ব্লগারদের কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের বই। এ সব পদক্ষেপই আমাদের বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যাবে অনেক দূর ও অনেক উচ্চতায়। (শেখ আমিনুল ইসলাম, সমকালীন বাংলা কমিউনিটি ব্লগ ভাবনা, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, এপ্রিল ২০১০)

ব্লগের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমাদ মোস্তফা কামাল লেখেছেন, “গত এক দশকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার একটি হল-ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে লেখালেখির চর্চার উদ্ভব হওয়া। অন্যান্য ভাষায় ব্যাপারটি অনেক আগেই শুরু হলেও বাংলাভাষায় এবং বাংলাদেশে এর উদ্বোধন হয় ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে সামহোয়ারইন ব্লগ-এর মাধ্যমে। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ঘটনাটি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন বলে মূলধারার সাহিত্যজগতে এটি এখনো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব তৈরি করতে পারে নি বটে, বা মূলধারার সাহিত্য-আলোচনায় অনলাইন লেখকদের কথা উল্লেখিত হয় না বটে, তবে আগামী দশকের শেষে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে-এটি বিকল্প গণমাধ্যমের এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে উঠেছে, এবং হয়তো সেদিন সাহিত্য-আলোচনায় এই লেখালেখিকে আর অস্বীকার করার উপায় থাকবে না।” (আহমাদ মোস্তফা কামাল, অপরবাস্তব:সাহিত্যচর্চার নতুন ধরন, বইয়ের জগৎ, ২০০৯)।তিনি ছাপা মাধ্যমে লেখালেখির সঙ্গে ব্লগের মতো অনলাইন মাধ্যমের লেখালেখির কিছু পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো এক. এখানে কোনো সম্পাদকীয় শাসন-অনুশাসন নেই, ফলে যে কেউ যে কোনো ধরনের লেখা প্রকাশ করার অধিকার রাখেন। সেই অর্থে এটি অনেক মুক্ত ও স্বাধীন মাধ্যম। দুই. এই মাধ্যমে লেখক-পাঠকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত চমৎকার। লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকরা তাদের মতামত জানাতে থাকেন, কোনো প্রশ্ন থাকলে প্রশ্ন করেন, কোনো পরামর্শ থাকলে সেটিও লেখককে জানিয়ে দেন। লেখকও এইসব প্রশ্নের উত্তর দেন, মতামতের ব্যাপারে তার নিজস্ব অবস্থানটি পরিষ্কার করেন। একটি লেখা এইসব বিবিধ মতামত নিয়েই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে এবং অধিকতর আকর্ষণীয় রূপে পাঠকদের কাছে হাজির হয়। তিন. এখানে লেখক-পাঠকদের সম্পর্ক এক তরফা নয়! একজন লেখক একইসঙ্গে পাঠকও, বা একজন পাঠক একসঙ্গে একজন লেখকও। ফলে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করার একটি চমৎকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এটি। চার. লেখাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত থাকে এবং পৃথিবীর যে-কোনো স্থান থেকে যে কেউ যে কোনো সময় সেগুলো পড়বার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। অর্থাৎ ছাপা-বইয়ের যেমন দুষ্প্রাপ্যতার একটা ব্যাপার আছে, চাইলেই যে কোনো সময় যে কোনো পাঠক সেটি পড়তে পারেন না, অনলাইনে সেই দুষ্প্রাপ্যতা নেই।

কেউ কেউ বলে থাকেন ব্লগ লেখে কেবল ব্লগারই হওয়া সম্ভব হয়, ব্লগ লেখে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। এ ব্যাপারে ব্লগার নীড় সন্ধানী লেখেছেন, “নিন্দুকেরা কিংবা ঈর্ষাবায়ুগ্রস্তরা যাই বলুক, এই তরুণ ব্লগারদের কেউ কেউ একদিন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হবেন। প্রকাশকেরা তখন আগাম পয়সা দিয়ে তাঁদের বুকিং দিয়ে রাখবেন, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকেরা ঈদসংখ্যার পৃষ্ঠা পূরণ করতে এঁদের শরণাপন্ন হবেন। কিন্তু তখন তাঁর প্রতিষ্ঠার কাল, উপার্জনের কাল, খ্যাতির কাল। উন্মেষের কাল তিনি পেরিয়ে এসেছেন ব্লগেই। জীবনের সেরা লেখাগুলোও রেখে এসেছেন ব্লগে। সবচেয়ে ভালো লেখাগুলো লেখার সময় তিনি সাহিত্যিক স্বীকৃত নন, প্রকাশকের আবদারে গার্বেজ লেখার সময়েই তিনি সাহিত্যিক। (নীড় সন্ধানী, ব্লগ লিখে ব্লগারই হয়, ব্লগ লিখে সাহিত্যক নয়, নির্মান ব্লগ, এপ্রিল ২০১১)

প্রাসঙ্গিক একটি আলোচনা এখানে যুক্ত করা যেতে পারে। বেশ কয়েকজন লেখক তাদের সাহিত্যিক পরিচয় নিয়েই ব্লগে লেখালেখি করতে এসেছেন। অনেকেই ব্লগিংয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। তবে পর্যবেক্ষণ হলো ব্লগে যে চলমান মিথস্ক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার সাথে অনেক সাহিত্যিকই মানিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে অনেক ‘মুদ্রন-লেখক’ কিছু দিন ব্লগে লেখে ব্লগ ছেড়ে দিয়েছেন। এই শ্রেণীর কেউ কেউ পরোক্ষভাবে ব্লগে অসংযত মাধ্যম হিসেবেও অভিহিত করেছেন। অবশ্য কিছু কিছু লেখক ব্লগের মিথস্ক্রিয়ার চ্যালেঞ্জটি (লেখক-পাঠকের মুখোমুখি অবস্থান) মোকাবেলা করেই ব্লগে নিয়মিত লেখে যাচ্ছেন।
২৬টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×