ব্লগে কমিউনিটি তৈরি হয়েছে কখন? নানাভাবেই ব্লগ কর্তৃপক্ষ ব্লগের সাথে কমিউনিটি শব্দটি জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু শুরুতেই কি কমিউনিটির যাত্রা হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর না। শুরতে ব্লগ কমিউনিটি আকারে ছিল না। তবে ব্লগে কমিউনিটি তৈরি হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এর কমন হোমপেজ। সামহ্যোয়ারইন ব্লগ তৈরি করার পর আইটিমনস্ক লোকজনের কাছে তার লিংক পাঠায় ডেভলাপাররা। ১৫ ডিসেম্বর নানা জনের কাছে ইমেইলে ব্লগ লেখার আমন্ত্রন পাঠানোর কথাও জানা যায়। তার ফলে দেখা গেছে বাংলা ব্লগের একদম শুরুরদিকেই প্রায় সব ব্লগারই আইটিসংশ্লিষ্ট বা আইটিমনস্ক। শুরুর দিকে ব্লগ লেখাও কঠিন ছিল। তুলনামূলক কঠিন টাইপিং পদ্ধতি এর কারণ। আজকের মতো তখন ফোনেটিকে লেখার সহজ সুবিধা ছিল না। ফলে আম জনতার কাছে শুরুতে ব্লগ জনপ্রিয়তা পায়নি। তাছাড়া বর্তমান সময়ে ব্লগ জনপ্রিয় তার তড়িৎ মিথস্ক্রিয়ার জন্য। এ ব্যাপারটিও শুরুর দিকে ছিল। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করা যাক।
সামহ্যোয়ারইন ব্লগে প্রথম পোস্ট দেওয়া হয় ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ২টা ২৬ মিনিটে। পোস্টের শিরোনাম ‘ইমরান ব্লগ স্রষ্টা’। পোস্টটি দেন দেবরা। উল্লেখ্য এই পোস্টটি ব্লগ টেস্ট করার জন্য দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া প্রথম ব্লগ লেখিয়ে ব্লগার সামহ্যোয়ারইন ব্লগে কর্মরত ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর ব্লগটি লেখা হলেও প্রথম মন্তব্য আসে ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই। তার মানে দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস বাংলা ব্লগের প্রথম পোস্টে কোন মন্তব্য পড়েনি। এখন অবশ্য নতুন ব্লগারদের অনেকেই সেই পোস্টে মন্তব্য করে ‘ইতিহাসের অংশীদার’ হতে চান। সামহ্যোয়ারইন ব্লগের দ্বিতীয় পোস্টটিও দেন দেবরা। ১৬ ডিসেম্বর রাত ১২টা ৫ মিনিটে দেওয়া সেই পোস্টটির শিরোনাম- ‘বিজয় দিবস’। এই পোস্টে প্রথম মন্তব্য আসে ২২ শে মার্চ ২০০৭। তৃতীয় পোস্টটির ব্লগারও দেবরা। ‘জীবন যেখানে যেমন’ শিরোনামের পোস্টটি প্রকাশ করা হয় ১৬ ডিসেম্বর রাত ১২ টা ৫৭ মিনিটে। এতে প্রথম মন্তব্য আসে ২০০৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫ রাত ১ টা ৩১ মিনিটে ব্লগের চতুর্থ পোস্ট দেন ব্লগার ‘সমকালের গান’। উল্লেখ্য তিনিও সামহ্যোয়ানইনে কর্মরত ছিলেন। ‘আমার অভিবাদন’ নামের সেই পোস্টটিতে বিজয় নামের একজন ব্লগার টেস্ট মন্তব্য করেন। তবে সেই টেস্ট মন্তব্যের সময়ক্ষণ বর্তমানে ভুল দেখাচ্ছে (১৫ ডিসেম্বর ২০০৫, দুপুর ১২ টা ৪৬ মিনিট)। মন্তব্যে লেখা হয়- ‘এটা একটি টেস্ট মন্তব্য’। এই টেস্ট মন্তব্যটিই কমিউনিটি বাংলা ব্লগের প্রথম মন্তব্য। টেস্ট মন্তব্যটিকে বাদ দিলে ব্লগের তৃতীয় পোস্টটিতে প্রথম মন্তব্য আসে ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই। ব্লগের পঞ্চম পোস্টটি দেন একই ব্লগার আড্ডাবাজ। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫ রাত ৮টা ৬ মিনিটে প্রকাশিত সেই লেখার শিরোনাম ‘আড্ডা এবার বাংলায়!!’। তাতে প্রথম মন্তব্য আসে ২১ ডিসেম্বর। ৬ষ্ঠ পোস্টটিও দেন সমকালের গান যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ সবার সেরা!!’। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ এই লেখায় প্রথম মন্তব্য আসে। ব্লগের সপ্তম পোস্ট দেন হাসিন। তিনি ব্লগ ডেভলাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘আমি এবং আমরা’ শিরোনামের পোস্টটি তিনি প্রকাশ করেন ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫ রাত ৮টা ১৪ মিনিটে। তাতেও কিছু টেস্ট মন্তব্য আসে। সেগুলো বাদ দিলে পোস্টতে ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম মন্তব্য আসে। বাংলা ভাষার প্রথম কমিউনিটি ব্লগের প্রথম সাতটি পোস্ট বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি তথ্য বের হয়ে আসে। প্রথমত, শুরুর দিকে সামহ্যোয়ারইনে কর্মরতরাই ব্লগিং করেছেন। দ্বিতীয়ত, ব্লগে মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যের ব্যাপারটি ব্লগে তখন ছিল না। ফলে এটি সহজেই অনুমেয় যে শুরুর দিকে বাংলা ব্লগ তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তাহলে জনপ্রিয়তা পর্ব শুরু হলো কখন?
২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করার পর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সামহ্যোয়ারইন ব্লগে মোট ১০৩ টি পোস্ট আসে। তবে মোট ব্লগারের সংখ্যা ১০-১২ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই ১০৩ টি পোস্টের বেশিরভাগেরই গড় মন্তব্যের সংখ্যা ১-২। ২০০৬ সালের জানুয়ারি বেশ কয়েকজন নতুন ব্লগার যুক্ত হন ব্লগের সাথে। ব্লগের পোস্ট বাড়লেও পোস্টের মন্তব্য সংখ্যা বাড়েনি তখনও। জানুয়ারিতে ব্লগার শোহেইল মতাহির চৌধুরী, অপ বাক, হাবিব মহাজন ও মঈন বেশি পোস্ট দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে আরও কিছু ব্লগার যুক্ত হন ব্লগের সাথে। ২০০৬ সালের মার্চে আইটি সংশ্লিষ্ট, আইটিমনস্ক লোকদের বাইরে বেশ কয়েকজন সাহিত্যমনস্ক লোক ব্লগার হিসেবে যুক্ত হন। মার্চে ব্লগারের সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। পাশাপাশি পোস্টে মন্তব্যের সংখ্যাও বাড়ে। বাংলা ব্লগের কমিউনিটি উদ্ভবের সময়কাল হিসেবে ২০০৬ সালের মার্চকে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলা ব্লগ কমিউনিটির ভার্চূয়াল রূপ বাস্তবে পদার্পন করে ২০০৬ সালের মে মাসে। প্রাপ্তির চিকিৎসা কেন্দ্রিক এক উদ্যোগের কারণেই ব্লগাররা তখন একত্রিত হয়েছিলেন। ব্লগারদের মধ্যে কমিউনিটি গড়ার ক্ষুধা সবসময়ই ছিল। কেন এই ক্ষুধা? এর বিশ্লেষণ নানাভাবে করা যায়। একটি বিশ্লেষণ হলো- প্রথম দিককার অনেক ব্লগার ব্লগে এসেছেন ‘চ্যাট করার অভিজ্ঞতা’ নিয়ে। ফলে এই চ্যাটিং অভিজ্ঞতাকে তারা ব্লগের সাথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। চ্যাটিং ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ভর। এই অভিজ্ঞতার ব্লগীয় রূপ হয়ে ওঠলো ব্যক্তিগত যোগাযোগ নির্ভর। এই আন্তঃযোগাযোগ কমিউনিটি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে মতামত আদান প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া হয়ে উঠে ব্লগের অন্যতম প্রধান চরিত্র। এই চরিত্রকে ভর করেই বাংলা ব্লগ বিকশিত হয়। পরবর্তী সময়ের ব্লগাররা এই চরিত্রকেই ব্লগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য মেনেছেন। এটি বর্তমান সময়ের নতুন ব্লগাররাও ভাবছেন। ফলে এখনও ব্লগের জনপ্রিয়তা বিচার করা হয় মিথস্ক্রিয়ার নিরিখে।
কমিউনিটির ধারণা বাংলা ব্লগে শক্তিশালী রূপ নিয়েছে কেন? বাংলা ব্লগে কমিউনিটি শক্তিশালী রূপ নিয়েছে কয়েটি কারণে। এগুলো হলো- মানবিক উদ্যোগ, ব্লগাড্ডা, ব্লগ ক্যাম্পেইন ইত্যাদি। ব্লগের প্রথম দিকের মানবিক উদ্যোগ প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে। প্রাপ্তি নামের এক অসুস্থ শিশু ব্লগারদের ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার থেকে বাস্তব জগতে হাজির করে । ২০০৬ সালের মে মাসে প্রাপ্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন প্রথমবারের মতো কিছু ব্লগার একত্রিত হয়েছিলেন প্রাপ্তিকে সাহায্য করার জন্য। পরবর্তীতে ২০০৭ এর জুনে চট্টগ্রামের পাহাড়ধ্বসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করতে ব্লগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেসময় কয়েকজন ব্লগার চট্টগ্রামে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাশ্বত সত্যকে বাঁচাতে ২০০৮ সালে মে মাসে ব্লগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগ অনেক ব্লগারকে একত্রিত করে। ব্লগ কেন্দ্রিক ক্যাম্পেইনের কথা বললে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্পেইনের প্রসঙ্গ শুরুতেই আসবে। প্রথমটি সিআরপির ভেলরি টেইলরকেন্দ্রিক। এটি ২০০৭ মাসে মে মাসের দিকে ব্লগে তুমুল আলোড়ন তৈরি করে। ব্লগার আরিফ জেবতিক সেই ক্যাম্পেইনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরের ক্যাম্পেইনটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এটি ২০০৯ এর জানুয়ারিতে পূর্ণ রূপ লাভ করে। এই ক্যাম্পেইনগুলোতে ব্লগারদের একত্রিত হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। একত্রিত করার ব্যাপারগুলোই কমিউনিটির বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। ব্লগের প্রথম আনুষ্ঠানিক আড্ডা হয় ২০০৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তখন প্রায় ১ শত ব্লগার চারুকলার ব্লগ আড্ডায় একত্রিত হন (আয়োজকদের ঘোষণা অনুযায়ী ব্লগ সম্মেলন)। পরবর্তীতে ব্লগ আড্ডা ব্লগারদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। একসময় নামটিই সংক্ষিপ্ত হয়ে হয় ‘ব্লগাড্ডা’। সামাজিকতা কিংবা কমিউনিটি বৈশিষ্টকে জোরদার করতেই বুঝি ২০০৮ সালে প্রথম বারের মতো ব্লগাররা পিকনিকেও যায়। ব্লগাড্ডার এই বৈশিষ্ট্য সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, সচলায়তন, আমার ব্লগ, প্রথম আলো ব্লগ, আমরা বন্ধু ব্লগেও দেখা গেছে। তবে হাল আমলে ব্লগাড্ডার পরিমান কমে গেছে। কমিউনিটির দ্রুত ভাঙা গড়াই হয়তো এর জন্য দায়ী।
ব্লগীয় উদ্যোগের সঙ্গে ব্লগ কমিউনিটির বিকাশের সম্পর্ক নিয়ে ব্লগার কালপুরুষ লেখেছেন,“একটা বিষয় নিয়ে গর্ব করতে পারি তা হলো ‘প্রাপ্তি’ নামের এক অসুস্থ শিশু আমাদের অনেক ‘ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার’কে বাস্তবে মিলিত হবার একটা বিরাট সুযোগ করে দিয়েছিল। আর নিকের আড়ালে থাকা ব্লগারদের সম্মিলিত শক্তি যে কোন মানবিক কাজে কত বেশী আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে সেটা আমরা দেখেছি। আর সেই উদ্দ্যোগের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে আরো এমন মানবিক কাজ এই ব্লগের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। এটা ব্লগ ও ব্লগারদের একটা বিরাট অর্জন। এরপর সিডর, ঘুর্নিঝড়, রাহেলা, ভেলরি, শাশ্বত, উপমা ইস্যু ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী ও আরও অনেক বিষয় নিয়েই ব্লগাররা স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। ব্লগিং-এর নেশা থেকে এবং ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়েও একটা কমিউনিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে এসব কাজ করা সম্ভব সেটা ব্লগার না হলে কখোনই জানতাম না। একজন ব্লগার হিসেবে এটা একধরণের বড় প্রাপ্তি বলেই মনে করি আর তা সম্ভব হয়েছে বাংলা ব্লগিং-এর এমন একটা সাইট খোলা হয়েছে বলেই। সামহয়্যারইন বাংলা ব্লগিং-এর মাইল ফলক হিসেবেই থাকবে আর এই ব্লগিং শক্তিকে আরো বেশী কার্যকর,আরও বেশী গতিশীল,আরও বেশী ঐক্যবদ্ধ ও করার নেপথ্যে এগিয়ে নেবার জন্যে সাথে থাকবে সচলায়তন,আমারব্লগ ও প্রথমআলো ব্লগ।” (কালপুরুষ, সামহ্যোয়ারইনব্লগ, মার্চ ২০০৯ )
বাংলা ব্লগ কমিউনিটির বিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে ব্লগাররা বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে ব্লগে পোস্ট দিয়েছেন। এসব পোস্টে আলোচনার নানা দিক উঠে এসেছে। ব্লগার কৌশিক আহমেদ ‘ভার্চুয়াল ও ননভার্চুয়াল ক্ষেত্র থেকে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষের ব্লগ রূপরেখা এবং এর ব্লগ, ব্লগার ও ক্রমঃবিবর্তিত পরিচালন পদ্ধতি’ শিরোনামের একটি ব্লগ পোস্টে সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ক্রম বিবর্তিত রূপরেখার একটি বয়ান হাজির করেছেন। বাংলা ব্লগ কমিউনিটি যেহেতু সামহ্যোয়ারইন ব্লগের মাধ্যমে শুরু হয়েছে তাই বাংলা কমিউনিটি ব্লগের ক্রম বিবর্তনকে বুঝতে হলে সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ক্রমবিবর্তন শুরুতেই বিবেচনায় নিতে হবে। কৌশিক আহমেদ তার লেখায় সামহ্যোয়ারইন ব্লগের সময়কালকে তিনটি কালে বিভক্ত করেছেন। কালগুলো হচ্ছে- ক. প্রাক-সচলায়তন খ. সচলায়তন কাল এবং গ. আমার ব্লগ কাল। তিনি প্রাক-সচলায়নকালকে আবার কয়েকটা সময়কালে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে একটা প্রাক-প্রাপ্তি কাল। কৌশিক আহমেদের মতে, “প্রাক-প্রাপ্তিকালের বৈশিষ্ট্য হলো এই সময়টাতে প্রথম একক কমিউনিটি তৈরী হয়েছিল এবং কমিউনিটি ভেঙে গিয়েছিল। তবে এর পুরোটাই ভার্চুয়াল। এটার ব্যাপ্তিকাল সামহ্যোয়ারের আত্মপ্রকাশ থেকে প্রাপ্তি বিষয়ক অমি রহমান পিয়ালের প্রথম পোস্ট পর্যন্ত। এই সময়ে যত ধরণের বিষয় নিয়ে ব্লগাররা আলোচনা করেছেন ও যত ধর্মী ব্লগারের উপস্থিতি সন্নিবেশিত হয়েছিল সেগুলো কিছু মোটা দাগে চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন, ব্লগারদের প্রথম ওয়েবে যারা এসেছিলেন তারা কনটেমপরারি বিষয় নিয়ে লিখতেন, ব্লগারদের পারস্পরিক জানা-পরিচয় নিয়ে লেখার চর্চা তখনও অনুপস্থিত। এসময়টাতে কর্তৃপক্ষ যেমনটা চেয়েছিলেন তেমন ব্লগারদেরই তারা দেখলেন তাদের ঘাটে নাও ভিড়াতে। কেউ রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখছে, সরকারকে সমালোচনা করে, কেউ সমর্থন করে। কেউ ধর্ম নিয়ে পড়েছে, এর ব্যবচ্ছেদ করে শেষ,কেউ আবার শুরু করেছে ওয়াজ-মাহফিল। এই বিভিন্ন কিসিমের ব্লগাররা আবার তাদের পারস্পরিক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থাকা সত্ত্বেও আলোচনামূলক সম্পর্ক বিনিময় করছে। যুক্তি দিয়ে কখনও আবেগ দিয়ে তার মন্তব্য সেধিয়ে দিচ্ছে। প্রি-প্রাপ্তিকালের প্রথমভাগে কর্তৃপক্ষের ব্লগের রূপরেখার পূর্ব-পরিকল্পিত অবস্থানের পুরোপুরি বাস্তবায়ন দেখা যায়। সেই রূপরেখা তখন পর্যন্ত আমি যা জানি তা হলো যে কেউ এখানে যা কিছু লিখতে পারে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করাটাকেই কমিউনিটি ভাঙা কাল বলে চিন্থিত করতে পারি।” এই কাল বিভাজনের কারণ কী? এই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কৌশিক আহমেদ। তার মতে, “আমার প্রদত্ত কাল-বিভাজনটার কারণ উল্লেখ্যযোগ্য টার্নিং পয়েন্ট। যেমন সচলায়তন তৈরী হবার পূর্ব পর্যন্ত সব ব্লগার এই একটা প্লাটফর্মে লিখতো। ব্রডস্কেলে এই সময়টা "অবিভাজিত ব্লগ কমিউনিটির কাল" হিসাবেও চিহ্নিত করাও সম্ভব। অবিভক্ত বাংলার মত অবিভক্ত ব্লগ। এর ডিউরেশন সেই অর্থে সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ এবং স্বল্পস্থায়ী। এই সময়ে প্রথম ব্লগাররা ভার্চুয়াল অস্তিত্ব ছেড়ে বাস্তবে পরিচিত হতে শুরু করেন। সেজন্য এর ভেতর থেকে এবসলিউট ভার্চুয়াল কাল ও বাস্তবে দেখাসাক্ষাৎ শুরু হবার দুটো পিরিয়ডকে আলাদা করতে পারি। প্রাপ্তি ইস্যু ব্লগে পদার্পনের পূর্ব পর্যন্ত ব্লগাররা সম্পূর্ণ রূপেই আলাদা, বিচ্ছিন্ন, স্বল্প মাত্রায় সংগঠিত ভার্চুয়াল অস্তিত্বময় ছিল।” (কৌশিক আহমেদ, ভার্চুয়াল ও ননভার্চুয়াল ক্ষেত্র থেকে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষের ব্লগ রূপরেখা এবং এর ব্লগ, ব্লগার ও ক্রমঃবিবর্তিত পরিচালন পদ্ধতি, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, ২৫ মার্চ ২০০৯)।
অন্যদিকে ব্লগার জামাল ভাস্কর ভিন্ন আঙিক থেকে কমিউনিটি তৈরি ও ভাঙা-গড়ার বিষয়টিকে ব্যাখা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “শুরুতে সকলেই এই ব্লগেই লিখছে...যার যার ইচ্ছামতোন লেখা হইছে...প্রো-লিবারেশনরা যেমন লিখছে, এন্টি লিবারেশনরাও লিখছে সমানে। সাহিত্য আর ভাষা নিয়া লিখছে উত্তরাধুনিকেরা, তাগো অবস্থানরে ব্যঙ্গ কইরা আধুনিকতাবাদীরাও লিখছে। সবাই লিখতো মনের আনন্দে। একে অপররে গালাগালি হইতো যারা যার রুচিবোধ মাফিক। কিন্তু সকলেই ভার্চুয়াল ছিলো বা থাকতেই পছন্দ করতো। একটা সময় আইলো যখন বুঝা গেলো এন্টি লিবারেটরা সংঘবদ্ধ লিখে...তার প্যা রালালি প্রো লিবাশনের সমর্থকেরাও ধীরে ধীরে গ্রুপ গঠনের দিকে গেলো। এই গ্রুপগুলি কতোটা সংঘবদ্ধ ছিলো সেইটা অবশ্য এক্কেরেই প্রশ্নহীন না...কিন্তু ব্লগ কর্তৃপক্ষের প্রথম দিককার একটা সিদ্ধান্ত প্রো-লিবারেশনপন্থীগো এক কইরা ফেললো বইলা আমার ধারনা। মাসুদা ভাট্টি'র একটা ধারাবাহিক উপন্যাসের সম্ভবতঃ দ্বিতীয় পর্ব তারা মুইছা ফেলে ব্লগ পোস্ট হিসাবে। এর প্রতিবাদে হয় ব্লগে প্রথম ঘোষণা দিয়া ব্লগ বিরতি। এই বিরতি ব্লগের নিয়মিত চরিত্র পাল্টাইয়া ফেললো...।” (জামাল ভাস্কর, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, মার্চ ২০০৯)
ব্লগ কমিউনিটি ও ব্লগ মডারেশন পদ্ধতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা উঠে এসেছে ব্লগার আজাদ মাস্টারের একটি ব্লগ পোস্টে। তিনি লেখেছেন, “বাংলা ব্লগ দুনিয়াতেও হয়েছে অনেক উথাল পাতাল, সামু ব্লগকে বাংলা কমিউনিটি ব্লগের ধারনা দাতা বা পাওনিয়ার বলা যায় সেখানে জমা হতো ডান বাম আস্তিক নাস্তিক মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার নানা কিসিমের মানুষ জন। তবে তাদের এই মনোপলি বেশিদিন থাকেনি বলা যায় কারন মডারেশন নিয়ে তাদের অস্বচ্ছ নীতি অনেক ব্লগারকেই ক্ষুব্ধ করে। ফলে ২০০৭ সালে সচলায়তন ব্লগ চালু হয়। এই ব্লগের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্লগারগণ স্বচ্ছ কিন্তু কঠোর মডারেশনের উপর জোর দেন এবং সদস্য ভুক্তির ব্যাপারে নেন কঠোর নিরক্ষনের রাস্তা। এর ভালো মন্দ দুইটা দিকই আছে। ভালো দিক, যারা লেখালিখি করতে চান বিশেষ করে কবিতা ,গল্প তাদের জন্য পরিচ্ছন্ন একটা প্লাটফর্ম হয়ে যায় সচলায়তন। বাংলা ব্লগের ভালো লেখাগুলোর বেশিরভাগ সচলায়তনে পাওয়া যায়। তবে এই কঠোর মডারেশনের খারাপ দিকগুলো হচ্ছে সচলায়তনে নতুন ব্লগারেরা আগ্রহ পায় না ব্লগের জটিল মডারেশনের কারনে। আরেকটা যে বিষয় লক্ষ্য করছি সেইটা হচ্ছে, সচলায়তনে প্রবাসী ব্লগারদের আধিক্য, বেশি বিশেষ করে আমেরিকা ,কানাডা সহ উন্নত পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কিংবা চাকুরীরত। বাংলাদেশ হতে ব্লগকরনেওয়ালা ভালো ব্লগারের সংখ্যা সেখানে কম সংখ্যায়। তবে যাই হোক স্বাধীনতা বিরোধীদের নানা কুযুক্তির বুদ্ধিভিত্তিক জবাব দেওয়ার জন্য এই ব্লগের ব্লগারেরা অগ্রগামী । ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা আরম্ভ হয় আমার ব্লগের । সচলায়তন যেখানে কঠোর মডারেশনের জন্য পরিচিত সেখানে আমার ব্লগ পরিচিত তার নো মডারেশনের নীতিমালার জন্য। এই নীতিমালার ভালো দিকগুলা হচ্ছে এতে নতুন ব্লগারেরা নিজেদের সহজেই মনোভাব প্রকাশ করার একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছে আর ইন্টার্যাগকশনের জন্যেও আমার ব্লগের মডারেশন খুবই বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবে এই ধরনের রিলাক্স মডারেশন পলিসির খারাপ দিকও কম না। প্রথমত আমার ব্লগে ভুয়া নিক পয়দা করে প্রতিপক্ষের সাথে রনে লিপ্ত হয়ে ব্লগের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে ফেলাটা অপেক্ষাকৃত সহজ যা অন্য ব্লগে সহজে করা সম্ভব হয় না। ফলশ্রুতিতে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লগের প্রক্সিওয়ারের তীর্থভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে আমার ব্লগ।” (আজাদ মাস্টার, বাংলা ব্লগগুলির ক্রম বিবর্তন, আমার ব্লগ, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১)।
নতুন নতুন ব্লগ সাইট তৈরি হওয়ার সঙ্গে কমিউনিটি ভাঙা-গড়ার সম্পর্ক রয়েছে। ব্লগার কমিউনিটির প্রথম দৃশ্যমান ভাঙন হয় মডারেশন পদ্ধতিতে কেন্দ্র করে। মাসুদা ভাট্টির একটি পোস্ট ‘ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে’ যুক্তিতে ব্লগ থেকে মুছে ফেলা হয়। উল্লেখ্য তখনও ব্লগে লিখিত কোন নীতিমালা ছিল না।এক ধরনের অলিখিত নিয়মনীতির মাধ্যমে ব্লগ মডারেশন চলতো। তবে ব্লগারদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্লগীয় নিয়ম-নীতির উন্নয়ন হয়। মাসুদা ভাট্টির পোস্ট মুছে ফেলার ঘটনা ব্লগারদের মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলে। সেই সময় কিছু কিছু ব্লগারের পক্ষ থেকে ব্লগ বিরতির ঘোষণাও আসে। সেই সময়কার বিরোধ বাংলা ব্লগের অবিভাজিত কমিউনিটিকে ভেঙে দেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে ২০০৭-এর ১ জুলাই কমিউনিটি বাংলা ব্লগিংয়ের দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সচলায়তনের যাত্রা শুরু হয়। সচলায়তনের পর সামহ্যোয়ারইন ব্লগের একদল ব্লগার ২০০৮ সালের এপ্রিলে আমার ব্লগ নামে নতুন আরেকটি ব্লগের সূচনা করেন। সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ব্লগাররাই পরবর্তীতে আমরা বন্ধু, চতুর্মাত্রিক, সরবের মতো নতুন নতুন ব্লগ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এসবের মাধ্যমে ব্লগ মালিকানার গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বাংলা কমিউনিটি ব্লগ শুরু হয়েছে সামহ্যোয়ারইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ব্লগ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরেও সামহ্যোয়ারইনের ব্যবসায়িক পরিচয় রয়েছে। ফলে সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ক্ষেত্রে ব্লগের মালিকানা এটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছিল। সচলায়তন, আমার ব্লগ, আমরা বন্ধু, চতুমাত্রিক ইত্যাদি ব্লগগুলোতে মালিকানার রূপ পরিবর্তিত হয়ে ব্লগারদের কাছে চলে যায়। অবশ্য ব্লগ কমিউনিটির ভাঙা গড়ার পেছনে এই মালিকানার ধারণা হয়তো খুব বেশি কাজে লাগেনি। তবে একই ঘরাণার লোকদের জন্য একটি ব্লগ, এমন চিন্তা হয়তো কোন কোন ব্লগার-গোষ্ঠী করেছেন। ব্লগ ভাঙা গড়ার ক্ষেত্রে কেবল সামহ্যোয়ারইন ব্লগের কমিউনিটিই ভাঙেনি, প্রথম আলো ব্লগের একদল ব্লগার আলাদা হয়ে মুক্তব্লগ নামে একটি ব্লগ তৈরি করেছেন। মডারেশন পদ্ধতি, পারস্পরিক মতবিরোধ, ব্লগীয় পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণে ব্লগ কমিউনিটির ভাঙন দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যাওয়া কমিউনিটির কয়েকজন ব্লগার মিলে নতুন ব্লগ তৈরি করেছেন। দ্রুপাল, ওয়ার্ডপ্রেস, জুমলার মতো সিএমএস উন্নয়নের ফলে কমিউনিটির ব্লগ তৈরি এখন তুলনামূলক সহজ।
একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, কমিউনিটি ব্লগগুলোকে বর্তমানে অনেক আলোচনায় সামাজিক ব্লগ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগসাইটগুলোর জনপ্রিয়তাকেই এই নতুন নামকরণের কারণ হিসেবে চিহিৃত করা যায়। কমিউনিটি ব্লগ কিংবা সামাজিক ব্লগের চরিত্রগত খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুই শ্রেণীর ব্লগেই ব্লগারদের সামাজিকতার উপস্থিতি রয়েছে। যে বিবেচনায় বাংলা ব্লগকে কমিউনিটি ব্লগ বলা হয় তা মূলত ব্লগার কমিউনিটির জন্য। এখানে ব্লগের পরিমাপ কেবল ব্যক্তির নিরিখে বিবেচিত হয় না। ব্লগ কেন্দ্রিক আলোচনা ওঠলে ব্লগার কমিউনিটির প্রসঙ্গ চলে আছে। কমিউনিটি ব্লগিংয়ের জন্যই ব্লগের কমন হোমপেজের এতো গুরুত্ব। কেউ ব্লগীয় কোন অপরাধ করলে তাকে কমন হোমপেজে পোস্ট করতে দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই সে নিজের পেজে ব্লগ পোস্ট করতে পারে। অন্যদিকে কোন পোস্টে আপত্তিকর কিছু থাকলে অনেক সময় তা কেবল কমন হোমপেজ থেকে মডারেশন করে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই কমন হোমপেজের ধারণাগত ও ব্যবহারিক জনপ্রিয়তা মূলত ব্লগ কমিউনিটির জন্য। এখানে ব্লগাররা পোস্ট লেখেন তার কমিউনিটির অন্যান্য ব্লগারদের কথা মাথায় রেখে, মন্তব্যও করেন সেই একই কমিউনিটির কথা মাথায় রেখে। অন্যদিকে, একত্রে অনেক ব্লগার ব্লগিং করছেন, মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখছেন, পাশাপাশি পারস্পরিক সামাজিক যোগাযোগও রাখছেন এই বিবেচনায় কিছু বাংলা ব্লগসাইটকে সামাজিক ব্লগ সাইট হিসেবে চিহিৃত করা যায়। তবে হাল আমলে কেউ কেউ ব্লগে সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তবে তা সামাজিক ব্লগের চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে তা নিরুপন করা কঠিন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




