somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে 'হুমায়ুন কবির'-চর্চা ও জন্মশতবর্ষ উদযাপন

১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে ‘হুমায়ুন কবির’-চর্চা ও জন্মশতবর্ষ উদযাপন
তপন বাগচী

বাংলাদেশে হুমায়ুন কবিরের জীবন ও সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নধর্মী চর্চা খুব বেশি হয় নি। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে কেবল দুটি গ্রন্থ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পরিচালিত গবেষণাকর্মের ওপর ভিত্তি করে রচিত একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। ব্যক্তি উদ্যোগে মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহর অবদান এক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদায় উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি হুমায়ুন কবিরের জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে তাঁর সম্পাদিত ‘ঊষালোকে’ পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেন। একটি সংখ্যা ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসকেন্দ্রিক ও আরেকটি সংখ্যা ‘বাংলার কাব্য’ প্রবন্ধকেন্দ্রিক রচনা মূল্যায়ন ও দলিলপত্রাদি নিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে হুমায়ুন কবিরের রচনা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। জন্মশতবর্ষে ফরিদপুর, ঢাকা ও নওগাঁ আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু একথা অক্ত্যুক্তি নয় যে, সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদ হিসেবে হুমায়ুন কবির যে মাপের ব্যক্তিত্ব, সেই তুলনায় তাঁকে ব্যাপক আয়োজনে স্মরণ করে আমরা যোগ্য সম্মান জানাতে পারিনি। তাঁর জন্মস্থান কিংবা জন্মঅঞ্চলে তাঁর কোনো স্মারক প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জাতি হিসেবে এই দৈন্য স্বীকার করেও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ‘হুমায়ুন কবির-চর্চা’র যেটুকু প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, তা একান্তই আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপ্রসূত।

‘হুমায়ুন কবির’-গবেষণা
বাংলদেশে হুমাযুন কবিরকে নিয়ে ব্যাপক কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি। তাঁর সাহিত্য এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বাংলা, ইতিহাস, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ থাকলেও এব্যাপারে কেউ এগিয়ে আসেনি। বাংলা একাডেমী জীবনীগ্রন্থমালা প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত হয়েছে শাহরিয়ার ইকবার রচিত ‘হুমাযুন কবির’ (১৯৮৮) নামের গ্রন্থ। বলাই বাহুল্য এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয়, তাঁর জীবন ও কর্মের রূপরেখা মাত্র। নির্ধারিত ছকের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়েছে বলে এই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিতে হয়। বাংলাদেশেই কেবল নয়, বাংলা ভাষায় প্রথম জীবনী লেখার কৃতিত্ব অবশ্যই শাহরিয়ার ইকবালের। এর আগে হুমায়ুুন কবিরের জীবনী ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন দীপঙ্কর দত্ত। হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘হুমায়ুন কবির : এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ নামের মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় লন্ডনের এশিয়া পাবলিশিং হাউস থেকে। মৃত্যুর ১৮ বছর পরে তাঁর দ্বিতীয় জীবনীগ্রন্থ বেরুল বাংলাভাষায়।
শারিয়ার ইকবালের গ্রন্থে হুমায়ুন জীবন, সাহিত্য ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। তিনি হুমায়ুন কবিরের সান্নিধ্য পেয়েছেন বলে আন্তরিক উচ্চারণে হুমায়ুন কবিরের জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ বিষয়ের অবতারণা করতে পেরেছেন। যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর পাঠগ্রহণপদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন-
প্রতিদিন ক্লাসে অধ্যাপকের বক্তৃতা থেকে তিনি যা লিখে নিতেন সেগুলো সেই রাত্রিতেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নোটে পরিণত করতেন। এ ছিল কবিরের লেখাপড়া পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। ... এই মানুষটিই ক্লাসে অধ্যাপকের বক্তব্য শোনার সময়ে থাকতেন অন্য জগতে, তখন কেবল[মাত্র] অধ্যাপকের বক্তব্য শোনা ও যতটা সম্ভব লেখা ছাড়া কবিরের অন্য কোনো চিন্তা থাকত না। ... এটাই বোধহয় কবিরের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল। (শাহরিয়ার ইকবাল, ‘হুমায়ুন কবির’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ২৪-৫৫)
হুমায়ুন কবির সম্পর্কে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণা করেছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রহমান। ‘হুমায়ুন কবির : জীবন ও সাহিত্য’ নামে তাঁর গবেষণাগ্রন্থটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় তিনি হুমায়ুন কবিরের বিস্তৃত জীবনতথ্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। হুমায়ুন কবিরের কবিতা, প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যচর্চার খতিয়ান দেয়া হয়েছে এ গ্রন্থে। ভিন্ন অধ্যায়ে তিনি মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। শাহরিয়ার ইকবালের ‘জীবনী’গ্রন্থের পরে তিনিই প্রথম হুমায়ুন কবিরের উপর গ্রন্থ রচনা করলেন। তাই ‘হুমায়ুন কবির’-চর্চায় মাসুদ রহমানের অবদান বিশেষ মর্যাদায় আলোচনার দাবি রাখে। হুমায়ুন কবিরের কর্মবহুল জীবনে সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতির প্রতিটি বিষয় নিয়ে এমফিল-পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু হুমায়ুন কবিরের প্রতি গবেষণায় একধরনের অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। মাসুদ রহমানই ব্যতিক্রম, যিনি হুমায়ুন কবিরের সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন।

সাময়িকপত্রে হুমায়ুন কবির সম্পর্কিত বিশেষ সংখ্যা
মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত ঊষালোকে’ পত্রিকার ৫ম বর্ষ ১ম-৪র্থ সংখায় (আগস্ট ১৯৮৭) হুমায়ুন কবির ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। এতে আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘হুমায়ুন কবির’ ও বুদ্ধদেব বসুর ‘হুমায়ুন কবিরের অষ্টাদশী’ নামে দুটি প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়। এছাড়া পুনর্মুদ্রিত হয়েছে হুমায়ুন কবিরের ‘ইকবাল ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ ও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ’ নামের দু’টি প্রবন্ধ তাঁর উপন্যাস ‘পদ্মা’র অংশবিশেষ। ‘পদ্মা’ উপন্যাসটিই পরে ‘নদী ও নারী’ নামে পুনর্বিন্যস্ত হয়। (‘ঊষালোকে’-সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেরউল্লাহর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ২৪.১১.২০০৮)
ষষ্ঠ বর্ষ ১ম-৪র্থ সংখায় (নভেম্বর ১৯৮৮) আবু রুশ্্দ্-এর ‘হুমায়ুন কবির ও তাঁর উপন্যাস নদী ও নারী’ এবং খোন্দকার সিরাজুল হকের ‘হুমায়ুন কবিরের সাহিত্য-চিন্তা’ নামের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এছাড়া হুমায়ুন কবিরের সহোদর আকবর কবিরের একটি চিঠি এবং হুমায়ন কবিরের ‘পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ-তালিকা’ প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে অঙ্গীকার করা হয়Ñ ‘হুমায়ুন কবির বিষয়ক আরো লেখা পেলে, ভবিষ্যতে তা উষালোকে প্রকাশ করতে আমরা আগ্রহী।’ (সম্পাদকীয়, মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত ‘ঊষালোকে’, ঢাকা, ষষ্ঠ বর্ষ ১ম-৪র্থ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৮) এই অঙ্গীকার পালনে সম্পাদক আন্তরিক নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ঊষালোকে’র নবপর্যায়ের প্রথম সংখ্যা (অক্টোবর ২০০১) প্রকাশিত হয় হুমায়ুন কবিরের ‘নদী ও নারী’ সংখ্যা হিসেবে। এতে এই কালজয়ী উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা-মূল্যায়ন ছাড়াও রয়েছে ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসটি মুদ্রিত হয়েছে। পাশাপাশি মূর্তজা বশীর কর্তৃক এর চিত্রনাট্যও এর বাড়তি পাওনা। সংযোজিত হয়েছে ‘নদী ও নারী’ চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে মূর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার এবং চিত্রনাট্য নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের একটি চমৎকার রচনা। ‘নদী ও নারী’ উপন্যাস নিয়ে যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হলেন আবু রুশদ, মহম্মদ মিজানুর রহমান, আহমাদ মাযহার, মাসুদুল হক, অনিরুদ্ধ কাহালি ও জাফর আহমদ রাশেদ।
নব পর্যায়ের দ্বিতীয় সংখ্যায় (জানুয়ারি ২০০২) হুমায়ুন কবিরের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাংলার কাব্য’ সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছেন আনিসুজ্জামান, অমলেন্দু বসু, খন্দকার মুজাম্মিল হক, বিশ্বজিৎ ঘোষ, আহমাদ মাযহার, সরকার আবদুল মান্নান, মাসুদুল হক, অনিরুদ্ধ কাহালি, মোহাম্মদ মোস্তফা, মনি হায়দার ও ওয়ালী নেওয়াজ। এছাড়া এই গ্রন্ধেুর দুটি সংস্করণে আহমদ ছফা ও আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখিত ‘মুখবন্ধ’ মুদ্রিত হয়েছে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়। ‘বাংলার কাব্য’ গ্রন্থের মূল পাঠও এই সংখ্যার অন্যতম আকর। ‘বাংলার কাব্য’ নিয়ে এই আয়োজনের মাধ্যমে মোহাম্মদ শাকেউল্লাহ তাঁর ‘হুমায়ুন কবির’-চর্চায় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করলেন।
‘কালি ও কলম’ পত্রিকা হুমাযুন কবির সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। কবি আবুল হোসেন ও প্রাবন্ধিক স্বপন মজুমদারের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে ‘কালি ও কলম’ হুমায়ুন কবিরের প্রতি জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়েছে।

কোষগ্রন্থে হুমায়ুন কবির
ফরিদপুরের বিভিন্ন আনম আবদুস সোবহান তাঁর ‘ফরিদপুরের কবি-সাহিত্যিক’ (১৯৬৯) ও ‘ফরিদপুরের লেখক অভিধান’ (২০০৭) গ্রন্থে হুমায়ুন কবিরের পরিচিতি হরেদরে প্রকাশ করেছেন। মর্যাদার তুলনায় আরো গুরুত্বের সঙ্গে তিনি উপস্থাপিত হতে পারতেন। তাঁর সম্পর্কিত আরো তথ্য সেখানে সন্নিবেশন করার দাবি রাখে। বানান ভুলের কারণেও কিছু তথ্যের বিকৃত উপস্থাপনা হয়েছে। ‘ফরিদপুরের ইতিহাস’ (১৯৯৪) গ্রন্থে হুমায়ুন কবির সম্পর্কে লেখা হয়েছেÑ
১৯৪৫-৪৬ সালে ফরিদপুরের কবি হুমায়ুন কবির জাতীয় কংগ্রেস দলের তৎকালীন সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আযাদের সেক্রেটারি হিসেবে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। হুমায়ুন কবিরের রাজনৈতিক চিন্তাধারা গঠনে মওলানা আবুল কালাম আযাদের প্রভাব ছিল অতীব গভীর। তিনি এককালে নিখিল ভারত ছাত্রকংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। (আনম আবদুস সোবহান, ‘ফরিদপুরের ইতিহাস’, সূর্যমুখী প্রকাশনী, ফরিদপুর, ১৯৯৪, পৃ. ৭৮)
উল্লেখযোগ্য তথ্য এইটুকুই। কংগ্রেস সভাপতির সচিবের চেয়ে বড় দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। তিনি শেরেবাংলার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। আজাদ যখন শিক্ষামন্ত্রী, তখন হুমাযুন কবির ওই মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এবং একসময়ে পূর্ণ সচিবও হয়েছিলেন। পরে তিনি নিজেও শিক্ষামন্ত্রী এবং আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ফরিদপুরের ইতিহাসে সেই তথ্য থাকলে ভালো হতো।
হুমাযুন কবিরের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় আরো আগে থেকেই। এছাড়া অন্যত্র বলা হয়েছে, হুমায়ুন কবির ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা সমিতির সাংগঠনিক প্রচুর পরিশ্রম করেন এবং মুসলিম লীগের পতাকাতলে কংগ্রেস ও কৃষকপ্রজা পার্টি থেকে দলে দলে সমবেত হলে কৃষক প্রজা সমিতিকে বাঁচিয়ে রাখার ভূমিকায় হুমায়ন কবির ছিলেন। (আনম আবদুস সোবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩) ফরিদপুরের ইতিহাসে হুমায়ুন কবিরের অবদান আরো বিস্তৃত ও তথ্যবহুল হলে ভালো হতো, তাঁর কর্মের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো যেত। হুমায়ুন কবির ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কেবল ‘প্রচার পরিশ্রম’ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। তিনি লেজিলেটিভ এসেম্বলিতে ফরিদপুর আসন থেকে পরাজিত হলেও কৃষকপ্রজা পার্টির পক্ষ থেকে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। একটানা দশ বছর তিনি এই কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন (১৯৩৭-১৯৪৭)। স্থানীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া রেললাইন তুলে নেয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফরিদপুরবাসীও তাঁর অবদানকে যাথাযোগ্য মর্যাদায় তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে, একথা বলতে আর দ্বিধা থাকে না।
অপেক্ষাকৃত পরিমিত তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে সাঈদা জামান ও মহসিন হোসাইন সম্পাদিত ‘চরিতাভিধান : বৃহত্তর ফরিদপুর’ (১৯৯২) গ্রন্থে। সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’ (২য় সং, ১৯৯৭)-এ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা হলেও অনেক ভুল এবং খণ্ডিত তথ্য সেখানে দেয়া হয়েছে। তাঁর স্কুলের নাম ভুল লেখা হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করার কথা উল্লেখ থাকলেও প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্থান লাভের কথা না বলে কেবল প্রথম বিভাগের উত্তীর্ণ হন বলে অপূর্ণ তথ্য প্রচার করা হয়েছে। লেখা হয়েছে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ অনার্স (১৯২৬) ও এমএ (১৯২৮) ডিগ্রি লাভ করেন। (‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’, ২য় সং (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ. ৪৩৯)
কিন্তু তাঁর জীবনীগ্রন্থ পাঠে জানা যায় তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং কলকাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। বলা হয়েছে, ‘অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ (১৯৩১)’ করেন (‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪০)। প্রকৃত পক্ষে অক্সফোর্ড থেকে তাঁর অর্জিত ডিগ্রির নাম ছিল ‘মডার্ন গ্রেটস’। এছাড়া তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কেও ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। জাতির মননের প্রতীক প্রতিষ্ঠানের এধরনের তথ্যবিকৃতি প্রকৃত বিচারে হুমায়ুন কবিরের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশেরই সামিল। ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে’ (১৯৭৭) তাঁকে শরিয়তউল্লাহ, দুদু মিয়া, জসীমউদ্দীনের পরেই স্থান দিয়ে লিখেছে, ‘late Professor Humayun Kabir, a great educationalist and a former Minister of India hailed from faridpur district.’ (নুরুল ইসলাম খান (জেনারেল এডিটর), ‘বাংলাদেশ ডিস্টিক্ট গেজেটিয়ার ফরিদপুর’, সংস্থাপন বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃ. ৭৩) আবার জেলার লেখক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, He had all along briliant academic record. Humayun Kabir was a famous educationist and a literateur too’. (নুরুল ইসলাম খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬) ‘শিশু বিশ্বকোষ’-এ (১৯৯৭) হুমায়ন কবির সম্পর্কে সাদামাটা ভুক্তি স্থান পেয়েছে। বাংলা পিডিয়া (২০০৬) ‘হুমায়ুন কবির’ নামের ভুক্তিতে যে ছবি ছাপা হয়েছে তা হুমায়ুন কবিরের নয়। হুমায়ুন কাদিরের ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে হুমায়ূন কবির হিসেবে। বাংলাপিডিয়ার সম্পাদকরা যে কতটা অসতর্ক, অমনোযোগী ও অশ্রদ্ধাশীল, তা হুমায়ুন কবিরের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া দেখেই অনুমান করা যায়। ভুক্তিটি প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশীর লেখা।

জন্মশতবর্ষ উদযাপন
জাতীয় পর্যায়ে কবি আবুল হোসেনকে সভাপতি ও প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহারকে সম্পাদক করে ‘হুমায়ুন কবির জন্মশতবার্ষিক উদযাপন পরিষদ’ গঠন করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে গঠিত এই পরিষদের সদস্যরা হলেন আবু রুশদ, কবীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সরদার ফজলুল করিম, সালাউহদ্দীন আহমেদ, রশীদ করিম, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হামিদা খানম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, মূর্তজা বশীর, কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান, ওসমান জামাল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হায়াৎ মামুদ, শাহরিয়ার ইকবাল, আবুল হাসনাত, আলমগীর রহমান, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, খুশী কবির, সৈয়দ আজিজুল হক, মাসুদ বিবাগী ও মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ। জাতীয় যাদুঘরে এই পরিষদের উদ্যোগে আলোচনাসভা ও স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। (আহমাদ মাযহার সম্পাদিত স্মরণিকা ‘হুমায়ুন কবির জন্মশতবার্ষিকী (১৯০৬-১৯৬৯)’, হুমায়ুন কবির জন্মশতবার্ষিক উদ্যাপন পরিষদ, ঢাকা, ২০০৬) ‘হুমায়ুন কবির জন্মশতবার্ষিকী (১৯০৬-১৯৬৯)’ শিরোনামে আহমাদ মাযহার সম্পাদিত স্মরণিকায় ‘হুমায়ন কবির : জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ নামে আহমাদ মাযহারের প্রবন্ধ, ‘স্মরণে হুমায়ুন কবির’ নামে রশীদ করিমের স্মৃতিকথা এবং জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি মুদ্রিত হয়েছে। জীবনপঞ্জি প্রণয়ন করেছেন আহমাদ মাযহার এবং গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন করেছেন মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ।
জন্মশতবার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে কবি আবুল হোসেনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেন প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, খুশি কবির, শাহরিয়ার ইকবাল প্রমুখ। (হুমায়ুন কবিরের ভ্রাতুষ্পুত্রী খুশি কবিরের সঙ্গে টেলিসাক্ষাৎকার, ২৫.১১.২০০৮)
ফরিদুপর শহরে কবি হুমায়ুন কবিরের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিবছর হুমায়ুন কবিরের জন্মদিন উদ্যাপিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকে। সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন শিক্ষক আহমেদ জালাল জানান, মূলত শিক্ষার্থীদের মধ্যে হুমায়ুন কবিরের কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার উদ্দেশ্যে এই আয়োজন করে থাকি। একজন শিক্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন, অন্যান্য শিক্ষক আলোচনা করেন। এতে হুমায়ুন কবিরের পরিবারের একজন উপস্থিত থাকেন। আর শিক্ষার্থীরা হুমায়ুন কবিরের কবিতা আবৃত্তি করে।’ (ফরিদপুর সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন শিক্ষক আহমেদ জালালের টেলিসাক্ষাৎকার, ২১.১১.২০০৮) ১৯৮৬ সালে হুমায়ুন কবিরের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। এই অনুষ্ঠানে হুমায়ুন কবিরের জীবনী পাঠ করেন সহ-প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক ৫টি বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। বক্তব্যের বিষয় ও বক্তার নাম এখানে উল্লেখ করা যায়Ñ
১.‘সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির’ : অধ্যাপিকা শামসুননাহার বেগম
২.‘শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির’ : অধ্যক্ষ অপূর্বকৃষ্ণ ঘোষ
৩.‘সমাজ-সংস্কার হুমায়ুন কবির’: সাংবাদিক আশরাফুল আজম আবদুর রব
৪. সাংবাদিক হুমায়ুন কবির’ : সাংবাদিক মুন্সি হারুন-অর রশীদ
৫.‘রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবির’ : এডভোকেট নাসিরউদ্দিন আহমেদ মুসা
২০০৫ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানেই হুমায়ুন কবিরের জন্মশতবর্ষকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। এবছরের আমন্ত্রণপত্রে লেখা হয়--
অধ্যাপক হুমায়ুন কবির এ উপমহাদেশে এক অনন্য প্রতিভার নাম। এ বছরের ২২ ফেব্র“য়ারি তাঁর শততম জন্মদিন। এই কীর্তিমানের নিরানব্বইতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আগামী ২৭ ফেব্র“য়ারি রবিবার সকাল এগারটায় তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কবির বাগ-এ সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।’
‘হুমায়ুন কবির’-চর্চায় এই স্কুলের ভূমিকাকে প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই। হুমায়ুন কবিরকে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে তাঁদের এই বহমান উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ এ-ব্যাপারে ভূমিকা পালন করে। ২০ আগস্ট ২০০৬ সালের রোববার ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের ২৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে হুমায়ুন কবির-এর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এক আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের আমন্ত্রণপত্র এখানে হুবহু উল্লেখ করা যায়--

সুধী,
আগামী ২০ আগস্ট ’০৬ রোববার ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এদিন ফরিদপুরের কৃতি সন্তান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ কবি হুমায়ুন কবির-এর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এক আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শেস সামসের আলী। কবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলেঅচনা করবেন জনাব মো. রেজাউল করিম।
অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি আমাদের প্রাণিত করবে।
শুভেচ্ছান্তে-
সময় : বিকেল ৪.৩০মি. মো. আলতাফ হোসেন
স্থান : সাহিত্য ভবন সম্পাদক
(পৌরসভার পার্শ্বে) ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ


পৌরসভার পাশে সাহিত্যভবনে বিকেল সাড়ে চারটায় এই অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক শেখ সামশের আলী। কবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন মো. রেজাউল করিম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সরকারি ইয়াছিন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক সিরাজুল হক। তাঁর জন্মশতবর্ষের এই সভা ফরিদপুরে তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের সড়কের নাম ‘হুমায়ুন কবির সড়ক’ রাখা এবং ফরিদপুর মিউজিয়ামে হুমায়ন কবিরের সমুদয় লেখা সংগ্রহ করে রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। এই অনুষ্ঠানের বিবরণ জানিয়ে প্রফেসর ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীকে লেখা ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক অধ্যাপক মো. আলতাফ হোসেনের পত্রটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে তুলে ধরা যায়Ñ
প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী
শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আন্তরিক শুভেচ্ছা নেবেন। আশা করি সৃজনশীল লেখা ও মননশীল গ্রন্থপাঠের মাঝে আপনি জীবনের আনন্দময় সময় অতিক্রম করছেন। নিজের ভেতর সৃজনশীলতার দারুণ অভাবের কারণে আপনার মত ব্যক্তিদেও প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করি।
আপনি যখনই হুমাযুন কবির ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলেছেন, আমি সেেঙ্কাচ বোধ করেছি। কারণ এই বিশাল মাপের ব্যক্তির জন্মশতবার্ষিকী যে মহিমায় বিশেষ করে ফরিদপুরে পালন করা সঙ্গত ছিল সেভাবে হয়নি।
আমরা ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ থেকে ছোট অবয়বে জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠঅনটি করেছি ২০০৬ সারের ২০ আগস্ট। তারিখ মনে থাকার কথা নয়। মনে আছে এই জন্য যে, ওই একই দিনে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আমাদের অনুষ্ঠানে রাজেন্দ্র কলেজের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান শেখ সামসের আলী প্রধান অতিথি ছিলেন। রেজাউল ইসলাম নামে বাংলা বিভাগের ছাত্র প্রবন্ধ উপস্থাপন করে।
ফরিদপুরে তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নাম সাজেদা কবিরউদ্দিন পৌর বালিকতা উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলের সামনের রাস্তাটির নাম ‘হুমায়ুন কবির সড়ক হোক এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ফরিদপুর মিউজিয়ামে কবির সমুদয় লেখা সংড়্রগ কওে রাখ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্ভব হলে কবির হাতের লেখা নমুনা বা কোন পাণ্ডুলিপি রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়।
...
এ অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন সরকারি ইয়াছিন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সিরাজুল হক। আলোচনা সভা শেষে ‘শোন মা আমিনা রেখে দে আজ কাজ’ (স্মরণ থেকে উদ্ধৃতি দিলাম, দয়া করে ভুল শুধরে নেবেন) কবিতাটি সুরারোপ করে পরিবেশন করেন সংগূীতশিল্পী জনাব সেলিম মজুমদার। এই মনে আছে, আর কিছু মনে নেই। জানি না- এতটুকুতে আপনার কি কাজ হবে!'

নওগাঁ শহরে হুমাযুন কবিরের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটে। তিনি নওগাঁ আসেন পিতা ডেপুটি ম্যাজস্ট্রেট কবিরউদ্দিন আহমদের চাকরি-সূত্রে। পিতার সাথে নদীয়া কৃষ্ণনগর জিলা স্কুল থেকে এসে ১৮৮৪ সালে স্থাপিত দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা নওগাঁ কেডি স্কুলে ভর্র্তি হন। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন বলে জানিয়েছেন কেডি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খোকন। তিনি বলেছেন, ‘অনেকেই মনে করেন তিনিই প্রথম হয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে কৌশলে দ্বিতীয় করা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে কেডি স্কুলের শতবর্ষ অনুষ্ঠানের স্মারকগ্রন্থ ‘শতাব্দীর সাধনা’য় এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন অনেক লেখক।’ (লেখককের কাছে লেখা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খোকনের বৈদ্যুতিন পত্র, ২২.১১.২০০৮) কিন্ত হুমায়ুন-গবেষক মাসুদ রহমান জানিয়েছেন-
রাজশাহী বিভাগে তাঁর স্থান ছিল প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র মেধা তালিকায় তিনি চতুর্থ স্থান লাভ করলেনÑ তখন অখণ্ড বাংলা ছাড়াও বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। নম্বর পেয়েছিলেন সাতশ’র মধ্যে ছয়শ’ এক। (মাসুদ রহমান, ‘হুমায়ুন কবির : জীবন ও সাহিত্য’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৭-৮)
কেডি স্কুলের প্রায় ৮৬% নম্বর পাওয়া কৃতি ছাত্র হিসেবে তাঁকে এখনো নওগাঁয় স্মরণ করা হয়। ২০০৬ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষে এই স্মরণ আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয়। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে ‘হুমায়ুন কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ’ গঠন করা হয়। নওগাঁর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ১৭ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন নওগাঁ পিএম গার্লস্ স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক, নওগাঁয় ষাটের দশকের ছাত্রনেতা সম্পৃক্ত বিশ্বনাথ দাস এবং সদস্য সচিব ছিলেন সমাজসেবক কাজী জিয়াউর রহমান বাবলু। এ কমিটিতে আরো ছিলেন কেডি স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন, কবি ও অধ্যাপক আতাউল হক সিদ্দিকী, অধ্যাপক তৌহিদ আহমেদ, অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, সাংবাদিক এবিএম রফিকুল ইসলাম, বিন আলী পিন্টু, মিসেস রুবী আসিফ, আলম, জোবায়ের আলম সিন্ধু, মেজবাহ সাকলাইন, মাববুব আলম ফিলিপ, ফায়জানুর রহমান রায়হান, সাবেক এমপি শেখ ওহিদুর রহমান প্রমুখ বিশিষ্টজন।
নওগাঁ শহরের চকদেব জনকল্যাণ পাড়ায় ফাঁকা ক্ষেতের মধ্যে একটি বটগাছ ছিল। এ জায়গাটি ‘হুমায়ুন কবিরের বটতলা’ বলে পরিচিত। যেখানে বসে পড়ালেখাসহ অনেক সময় কাটাতেন তিনি। বর্তমানে সেখানে আর কোন ফাঁকা জায়গা নেই। একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত। প্রায় এক দশক আগে ঘূর্ণিঝড়ে বটগাছটি উপড়ে যায়। হুমায়ুন কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদের আমন্ত্রণে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী খুশী কবির ঐ স্থানেই আরেকটি বটগাছের চারা রোপণ করেন।
জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে, ২০০৬ সালের ১০ মার্চ সকালে একটি র‌্যালি কেডি স্কুল থেকে বেরিয়ে চকদেব জনকল্যাণপাড়া বটতলায় শেষ হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন খুশী কবির। প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুুল জলিলের। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আয়োজকদের জানিয়ে দেন অনিবার্য কারণে তিনি ঢাকা থেকে নওগাঁয় আসতে পারছেন না। অনুষ্ঠান উদ্বোধন শেষে ‘হুমায়ুন কবিরের বটতলা’য় অনুষ্ঠিত হয় শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। বিকেলে শহরের করোনেশন হল সোসাইটির মিলনায়তনে একটি আলোচনাসভা হয়। আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমাদ মাযহার। এরপর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ ও একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
এর কিছুদিন পরে হুমায়ুন কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ থেকে কাজী জিয়াউর রহমান বাবলুকে আহ্বায়ক এবং জাহিদ রাব্বানী রশিদকে সদস্য সচিব করে গড়ে ওঠে ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পরিষদ’। তবে এ পরিষদের তেমন কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেননি। হুমায়ুন কবিরের প্রিয় বটতলাটি প্রায় ২ বিঘার একটি সরকারি সম্পত্তি। এটি একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেখানে বসত গড়ে তুলেছে কিছু ছিন্নমূল-হতদরিদ্র মানুষ। তাদের উঠিয়ে দিতে গেলে প্রয়োজন জেলা প্রশাসনের সহায়তা। হুমায়ুন কবির স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক কাজী জিয়াউর রহমান বাবলুর সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ শফিকুল ইসলাম খোকন জানিয়েছেন, ‘ওই স্থানে একটি স্থায়ী মঞ্চ, একটি পাঠাগার এবং স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।’ (লেখককের কাছে লেখা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খোকনের বৈদ্যুতিন পত্র, ২২.১১.২০০৮)


উপসংহার
বাংলাদেশে ‘হুমায়ুন কবির’-চর্চা তেমন তোড়জোড়ভাবে হয়নি। সরকারি উদ্যোগ একেবারেই নেই। তাঁর জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে হলেও তার পেছনে ছিল খুশি কবির, আহমাদ মাযহার-সহ দু’একজন ব্যক্তির কর্মপ্রয়াস। তবে এ-ক্ষেত্রে না মেনে উপায় নেই যে, হুমায়ুন-চর্চায় মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, বাংলাদেশে হুমায়ন কবির-চর্চায় তিনিই পথিকৃৎ। পরবর্তীকালে আরো অনেকের অংশগ্রহণে এই ধারা বেগবান হয়েছে। এবং হুমায়ুন কবির সম্পর্কে অকর্ষিত অনেক বিষয়ে এখনো তথ্য-উদ্ধার ও আলোচনা-গবেষণার সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতের কোনো গবেষক এসে সেই কাজ সম্পন্ন করবেন, সেই প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:২২
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×