somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালনের গানের ছন্দবিচারে ভুলের হদিস

১৯ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লালনের গানের ছন্দবিচারে ভুলের হদিস

আমার লালন-অধ্যয়নের অংশ হিসেবেই সংগ্রহ করি ইমাম আহমেদ নামের এক গবেষকের কথিত গবেষণাগ্রন্থ 'লালনের গান : আধ্যাত্মিকতার স্বরূপ' (২০০৯)। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, ইমাম আহমেদের দাবি মোতাবেক এটি তাঁর এমফিল অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রফেসর রাবেয়া খাতুনের তত্ত্বাবধানে এটি রচিত। বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে গবেষককে 'বাধিত করেছেন' প্রফেসর ডক্টর খালেদ হোসাইন, কবি ও ছড়াকার হিসেবে যিনি আমার অনেক প্রিয়। ওই গ্রন্থের এই গ্রন্থে 'লালনের আধ্যাত্মিক গানের শৈল্পিক উৎকর্ষ' (পৃ. ১৫১-১৬৯) নামের অধ্যায়ে 'আঙ্গিক ও ছন্দবিন্যাস' উপশিরোনামে প্রায় ৮ পৃষ্ঠার আলোচনা রয়েছে। অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আমি ওই অংশে প্রবেশ করেছি। গবেষক যখন লেখেন, 'তিনি (লালন) গতানুগতিকভাবে পয়ার-ত্রিপদী-পাঁচালির একঘেঁয়ে চর্চা না করে আধুনিক বাংলা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।'-- তখন আমার মতো ছন্দানুরাগী পাঠক ওই বিশ্লেষণের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। কিন্তু যতই এগোই, হতাশায় নুয়ে যাই।
গবেষক অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন শুরুতেই। সংজ্ঞার্থ ঠিক আছে। গবেষকের আবিষ্কার--'সাঁইজি তাঁর গানে অক্ষরবৃত্তের অন্তর্গত পয়ার-ছন্দের বৈচিত্র্য সাধন করেন (৮+৮)=১৬ মাত্রায়’ (পৃ. ১৬১)। এরপর নমুনা হিসেবে উদ্ধার করেন লালন-পঙ্ক্তি--
মানুষে মানুষ কামনা /সিদ্ধ কর বর্তমানে॥
খেলছে খেলা
বিনোদ কালা/
এই মানুষের তিন ভুবনে॥
বিশ্লেষকের মন্তব্য হচ্ছে, 'গানের প্রতিটি চরণ দু-পর্বে বিভক্ত এবং প্রতিপর্বের মাত্রা-সংখ্যা ৮'। কিন্তু আমাদের মতে, অক্ষরত্তৃত্ত ছন্দে হিসাব করলে ওই চরণের ছন্দোবিন্যাস দাঁড়ায়Ñ৯/৮/১০/১১। তাহলে গবেষক ‘প্রতিপর্বের মাত্রা-সংখ্যা-৮; পেলেন কীভাবে?’ এরপরে প্রশ্ন জাতে এই চরণগুচ্ছ কি অক্ষরবৃত্তের চাল গ্রহণ করেছে, নাকি স্বরবৃত্তের চাল গ্রহণ করেছে। আমরা জানি যে, আধুনিক বিচারপদ্ধতি লালনের অনায়ত্ত থাকারই কথা। কিন্তু তিনি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন বলেই তাঁর বাণীর বিশ্লেষণে পৌরাণিক-আধুনিক সকল রীতিই প্রয়োগ করা যায়। আমার পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, স্বরবৃত্ত ছন্দে বিশ্লেষণ করা যাক-
মানুষে মা/নুষ কামনা /সিদ্ধ কর/ বর্তমানে॥/ ৪+৪+৪+৪
খেলছে খেলা/ ৪
বিনোদ কালা/ ৪
এই মানুষের/ তিন ভুবনে॥/ ৪+৪
এখন দেখা যাচ্ছে স্বরবৃত্তে চার মাত্রার চালে বিশ্লেষণ করলে লালনের গানে কোনো ছন্দচ্যুতি ঘটে না। অক্ষরবৃত্তে পড়তে গেলে পর্বসাম্য ঠিক থাকে না। ভুলটা কি লালনের, নাকি বিশ্লেষকের? পাঠকই তা বিচার করতে পারবেন। দ্বিতীয় উদাহরণে কবি-ছান্দসিক মোহিতলাল মজুমদারের পয়ার-সম্পর্কিত উদ্ধৃতি টানা হলেও লালনের গানে তার প্রয়োগ-কুশলতা দেখাতে পারেননি। লালনের যে পদ তিনি অক্ষরবৃত্ত-পয়ার ছন্দের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন, আসলে তা অক্ষরবৃত্ত-ই নয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রেও গবেষকের বিশ্লেষণ ব্যাকরণ-সম্মত নয়। স্বরবৃত্তকে মাত্রাবৃত্তের চালে হিসেবে করলে কি লালনের গানের শৈল্পিক উৎকর্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে? এতে যে গবেষক তাঁর অজান্তেই লালনকে খাটো করে তুললেন, তার জবাব কী হতে পারে? স্বরবৃত্ত ছন্দের দ্বিতীয় উদাহরণটিও স্বরবৃত্ত ছন্দের বলে মনে হচ্ছে না। গবেষক হয়তো পার পেয়ে যাবেন এই বলে যে, এটি তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভ, এবং তা অন্তত তিনজন প্রফেসর দেখে দিয়েছেন, তাই ভুলের দায় তাঁর একার নয়। আমাদেরও তেমন মনে হয়! এটি যদি গবেষকের ঐকান্তিক গবেষণা হতো, ধরে নিতাম যে অনিচ্ছাকৃত এই ভুল ঘটে গেছে। কিন্তু এটি তো দীর্ঘদিন ধরে প্রণীত একটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। তত্ত্বাবধায়ক মহোদয় প্রতিটি শব্দ দেখে ডিগ্রি দেয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তার পর আরো নিঃসন্দেহে দুইজন বিজ্ঞ প্রফেসর তা মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরাও এই ভুল বিশ্লেষণ এড়িয়ে গেলেন কীভাবে? আমি তো কেবল ছন্দের অংশ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি। অলঙ্কার প্রয়োগ নিয়ে তিনি যে আলোচনা করেছেন, তার বিপত্তি নিয়ে আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। এইসব যাঁদের দেখার দায়িত্ব পালন করেছেন, দেখার বিনিময়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সম্মানী নিয়েছেন, সেই পরীক্ষক-অধ্যাপকেরাই যখন পার করিয়ে দিয়েছেন, ডিগ্রি দিয়েছেন, আমাদের তাতে করার কিছু নেই। ওটি ছিল পরীক্ষার খাতা। কিন্তু তা যখন মুদ্রিত আকারে জনসমক্ষে এল, তখন পাঠক হিসেবে আমার কথা বলার সুযোগ রয়েছে। আমরা জানি, অনেক অভিসন্দর্ভ ডিগ্রি পেলেও, তা প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয় না। এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল কিনা আমরা জানি না। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পক্ষপাত দেখালে তা অশিক্ষকসুলভ আচরণ হয়, তাহলে ভুল তথ্যে ডিগ্রি দিলে কি অশিক্ষকসুলভ আচরণ হয় না? এতে কি তত্ত্বাবধায়কের অযোগ্যতা প্রমাণিত হয় না? এ বিষয়ে ডিগ্রিদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়ের বক্তব্য উচ্চতর গবেষণার খাতিরেই প্রকাশ করা জরুরি বলে বিবেচনা করি। অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ফলে, অনেক পাঠক যে বিভ্রান্ত হতে পারেন, ভুল তথ্য জানতে পারেন, তার দায় কে নেবে? ভুল বিশ্লেষণের বই পাঠকের হাতে যেতে দেয়া কি ঠিক হচ্ছে? লেখক এবং প্রকাশক র‌্যামন পাবিলার্শ এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। কষ্ট করে ডিগ্রি নিলেন, ভুল বিশ্লেষণ করে বাঘা-বাঘা অধ্যাপকের স্বীকৃতি নিলেন, তাতে আমাদের আপত্তির সুযোগ নেই। কিন্তু ওই অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ও যখন লেখক সচেতন হলেন না, তখন পাঠক হিসেবে আমরা তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করার অধিকার রাখি। বলে রাখা ভালো, লেখকের সঙ্গে আমার ব্যাক্তিগত পরিচয় নেই। তবু সত্যের খাতিরে এই অপ্রিয় কথাগুলো না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না। আশা করি বইটি সংশোধিত আকারে কিংবা ছন্দ-অলঙ্কার অংশ বর্জন করে বাজারে ছাড়া হবে। তাতে পাঠক হিসেবে আমরা বাধিত হবো।
তপন বাগচী
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১:২৬
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×