কয়েক দিন ধরেই বেশ শোরগোল চারিদিকে। রিজার্ভ গেল রিজার্ভ গেল। চারিদিকে হইহুল্লর, কলরব। তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গভর্নরের পদত্যাগ। বাংলাদেশের প্রথম নারী গভর্নর সহ দুইজন গভর্নরের অপসারন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীহ এবং বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীজীবীদের মধ্যে সততার ক্ষেত্রে যারা অন্যতম দৃষ্টান্ত তাদের বিরুদ্ধে অপমানজনক নানা কথা বলা। শুধু তাই নয় চোর বলে আখ্যায়িত করা।
মজার ব্যাপার হল রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সবাই যত না বেশি চিন্তিত আমার মনে হয় তার চেয়ে বেশি উৎফুল্ল। কারন অনেকদিন ধরেই রাজনীতির মাঠ ঠাণ্ডা। বাংলাদেশের সবার জীবন কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই মানুষ মুখরোচক গল্প থেকে বঞ্চিত। সাংবাদিকরা লেখার মত কোন গরম খবর পাচ্ছে না। কলামিস্টরা গরম কলাম লিখতে পারছে না। সরকারী দলের লোকজন বিরোধী দলের অভাবে বেসাহারা। বিরোধী দল পঙ্গু। গলাবাজি কমে গেছে। হরতাল নেই। পেট্রোল বোমা নাই। চারিদিকে কেমন রসহীন ভাব। এর মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা অন্তত সবার মধ্যে একটা আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। বেশ সাজ সাজ রব চারিদিকে। আবাল, বৃদ্ধ বনিতা সবাই কাছা দিয়ে নেমে ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। ধিক্কার দিচ্ছে, তর্কযুদ্ধ করছে। যেন চাঁদের হাট বসেছে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। রিজার্ভ গেলরে, রিজার্ভ গেল......।
# শুনলাম এক বেসরকারি ব্যাংকের কেউ একজন নাকি বেশ বুক ফুলিয়ে ফেসবুকে লিখেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চোরগুলো এখনও কিভাবে আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘোরাফেরা করে। বেশ সাহসী প্রশ্ন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বেচারা কোন একটা অপরাধের কারনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও কাছে কানমলা খেয়েছে। তার কথা বলে লাভ নেই। বেচারার বাইরে চাকচিক্য থাকলেও জীবন বলে কিছু নেই। বসের খুসিমত চলতে হয়। কাজ করতে হয়। নিজের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। প্রমোশনের জন্য লেজ নাড়াতে হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকুরেরা এসব থেকে মুক্ত। চাকচিক্যের কম জীবন বলে একটা কিছু আছে। রাগ তো একটু হবেই। বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে হলে তাকে পাস নিতে হয়। পাস নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে হয়। ভুলভাল ডকুমেন্ট দেয়ার জন্য কড়া কথা শুনতে হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের তার অফিসে ঢুকতে পাস নিতে হয় না। যেকোন ডকুমেন্ট চাইতে পারে। আবার বিভিন্ন চুরির জন্য রীতিমত কানমলা দেয়। রাগ তো একটু হবেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো করে জনগনের স্বার্থ রক্ষার জন্য। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যও যাতে ভাল থাকে সেজন্য। কারন ব্যাংক এবং ব্যাংকের গ্রাহক একে অপরের পরিপূরক। এগুলো আমাদের করতেই হয়। করতে হয় দায়িত্ববোধ থেকে। মানুষের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে।
# শুনলাম এক সাংবাদিক ভাই নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক এ এসে জোর গলায় বলেছে রিজার্ভ কোথায় রাখছেন আমাদের দেখান। আমাদের দেখাতেই হবে। শুনে একচোট হাসলাম। পরক্ষনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহারে বেচারা! নাদান সাংবাদিক জানেও না রিজার্ভ কিভাবে রাখতে হয়। সাংবাদিক যদি প্রশ্নও করত রিজার্ভ কঠিন, তরল না বায়বীয় তাহলেও আশ্চর্য হতাম না। মজার ব্যাপার হল প্রতিদিন আমরা যারা রিজার্ভ কথাটা পত্রিকায় পরছি তারা অনেকেই জানি না রিজার্ভ কি, কিভাবে সেটা রাখতে হয়। অথচ সবাই চিল্লাচ্ছি রিজার্ভ গেলরে রিজার্ভ গেল।
# আমি বলছি না রিজার্ভের টাকা চুরি হওয়াতে কিছু হয় নি। অবশ্যই হয়েছে। এটা একটা বড় ক্ষতিই শুধু নয় এটা বাংলাদেশ ব্যাংক তথা ব্যাংকিং ব্যাবস্থার জন্য একটা বড় ধরণের হুমকি। এবং এই হুমকি মোকাবেলা করার জন্য আইটি নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে টাকা খোয়া গেছে তার পরিমান ৮০০ কোটি টাকা। আমার বিশ্বাস হ্যাকিং এর মাধ্যমেই বাইরের চোরেরা এই টাকা চুরি করেছে। তার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জড়িত নয়। অবশ্য আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে সত্য মিথ্যা নির্ধারিত হবে না। প্রকৃত সত্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যদি দুএকজন জড়িতও থাকে তবে সে অপরাধ তাদের। এবং সে জন্য পুরো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বাজে কথা বলা কোন সুস্থ চিন্তার পরিচয় নয়। যুগান্তর ১৫ মার্চ ২০১৬ এর সূত্র অনুযায়ী তিতাস গ্যাসের ৩০০০ কোটি টাকার কোন হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা দিয়ে ৩ হাজার ৮ শ ৩৮ কোটি টাকা কে ভাগ দিন। যে রিজার্ভ চুরি গেছে তার প্রায় চার গুন। আমার প্রশ্ন এই টাকা কি জনগনের টাকা নয়। আর এটা যদি জনগনের টাকা হয় তাহলে এটা কেন পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হচ্ছে না। কেন টক শো হচ্ছে না। জনগন নিরব কেন। আসলে জনগন জানেই না তাদের অধিকার কি। আর যারা জানে তাদের লেজেগোবরে অবস্থা । মেরুদণ্ড ক্ষয়ে গেছে। ক্ষয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড দিয়ে হামাগুড়ি দেয়া যায়। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো যায় না।
এরকম প্রতিদিন জনগনের বহু টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। রেলের টাকা চুরি হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি যাচ্ছে, কোটি কোটি টাকা হলমার্কের মত কোম্পানি গাপ করে দিচ্ছে। অথচ কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। বিচার নেই এমনকি মানুষের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। অথচ রিজার্ভ নিয়ে কথা হচ্ছে। আতিউর রহমানকে ভ্রমনপ্রিয়, দায়িত্বহীন, প্রচারসর্বস্ব গভর্নর বলা হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের গালিগালজ করা হচ্ছে।
একটু লক্ষ করুন। আতিউর রহমান ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সহ পুরো ব্যাংকিং ব্যাবস্থা অটোমেটেড হয়েছে। আগে সিআইবি রিপোর্ট পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেত। এখন সে রিপোর্ট কয়েক মিনিটেই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ হয়েছে। আরটিজিএস এর মাধ্যমে হিসাব দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। মানুষের হাতে দ্রুত টাকা চলে যাচ্ছে। কৃষকরা ১০ টাকার হিসাব খুলতে পারছে। গ্রিন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রণোদনা পাচ্ছে। সিএসার এর মাধ্যমে ব্যাংকের লাভের কিছু অংশ দরিদ্র মানুষের সেবায় ব্যয় হচ্ছে। এসএমই এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যাবসাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এসব হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমের প্রেক্ষিতে। সর্বপরি বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বে উন্নয়নমূলক কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে যে বাহবা পেয়েছে তার অন্যতম কারন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানুষের কাছে বিশেষ করে প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রশ্ন হল দেশের জনগন কি এসব জানে, সুশীল সমাজ কি এসব জানে, রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট সাংবাদিক সবার কাছেই জিজ্ঞাসা আপনারা কি এসব জানেন। আমি বলি কি রিজার্ভ চুরির যে দায় প্রমান ছাড়াই আপনারা আমাদের দিচ্ছেন, এই সফলতা গুলোর বাহবাও কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্প। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ত শতভাগ সফল নয় কিন্তু আমরা সফলতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
পরিশেষে বলব বাংলাদেশে যেসব স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি যেমন ব্যাংক ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাজার ব্যাবস্থা নিয়ন্ত্রেনর ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অপিরিসীম। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ৬ মাস অন্তর অন্তর যে মনিটারি পলিসি প্রণয়ন করে তার উপর বাজার ব্যাবস্থার স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। সুতরাং সমালোচনার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকে কিভাবে আরও বেশি শক্তিশালী, স্বাধীন, গতিশীল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রূপ দেয়া যায় সে ধরণের গঠনমূলক আলোচনাও জরুরী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা হিসেবে সে আলোচনাটুকু আশা করতেই পারি।
আর যদি শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় রিজার্ভ চুরির যে ঘটনা ঘটেছে তার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জড়িত না থাকার প্রমান পাওয়া যায় তবে যে অসম্মান বাংলাদেশ ব্যাংককে করা হয়েছে এবং যে সম্মান কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের।
(বিঃ দ্রঃ এই লেখাটি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। চরিত্রগুলোও কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত, সৎ কিংবা অসৎ, পীর ফকির, দরবেশ, বাটপার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, কলামিস্ট কারও সাথে মিলে গেলে তা সম্পূর্ণই কাকতালীয়। এর জন্য লেখকের কোন দায় নাই।)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৩