মাঘের শীতে নাকি বাঘে কাপে। কথাটা কে বলেছিলেন তা হাসান জানে না। তবে কথা মনে হয় সত্যি। শীত যেন গরম কাপড় ভেদ করে হাড়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। জঙ্গলের ভেতর শীত যেন আরও বেশি। প্রচণ্ড কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে পুরো জঙ্গল। যদিও গভীর কোন জঙ্গল নয়, নামের জঙ্গল। জঙ্গলে বাঘ, সিংহ কিছুই নেই। খুব সম্ভবত শিয়ালও নেই।
হাসানের মনে পরে গেল কেন সে এই জঙ্গলে। সে এসেছে সারপ্রাইজ দিতে। তার বন্ধু হিমেল গ্রামে থাকে। গ্রামের নাম টিও খুব সুন্দর। মাধবীলতা। অনেক দিন ধরে হিমেল তাকে যেতে বলছিল। কিন্তু সময় করে আর যাওয়া হয় নি। এবার হঠাৎ ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেলে তার মাথায় এ প্লান আসে। ঠিকানা জানা ছিল। তারপর ট্রেনে চেপে বসা। কিন্তু বাংলাদেশের ট্রেনের মতিগতি সম্পর্কে হাসানের ধারনা খুব একটা ছিল না। তাই বিকেলে পৌছার কথা থাকলেও ট্রেন রাতে এসে পৌঁছেছে। এবং অদ্ভুত ব্যাপার এত রাতে কোন রিকশা চলে না। তাই পায়ে হাটা একমাত্র উপায়।
তবে station মাস্টার যা জানাল তাতে তার গন্তব্য ৫ মাইল। আর শীতের রাত হলেও হাঁটলে মন্দ লাগবে না। তাই গন্তব্যের উদ্দেশে হাটা ধরল হাসান।
পথ যেন আর শেষ হয় না। ৫ মাইল কে মনে হচ্ছে ৫০ মাইল।
এই যে শুনছেন? হাসান ডাক শুনে একটু ভয় পেয়ে যায়। ভুত টুত নাত। না ভুত না, তবে যা দেখল তা ভুত দেখলেও সম্ভবত এত চমকাত না। কারণ এত রাতে এই জঙ্গলে তাকে একটি মেয়ে ডাকছে।
হা, একটি মেয়েই তো। লম্বা, পড়নে একটি লাল শাড়ি। দেখতে সুন্দরী, খুবই সুন্দরী।
“ এই যে শুনছেন?”
“আমাকে বলছেন” হাসান কিছুটা ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বলল হাসান।
“হা, আপনাকেই বলছি। আসলে আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আমার বাড়ি মাধবীলতা গ্রামে। এত রাতে একা যেতে ভয় পাচ্ছি। আপনি মনে হয় সেদিকেই যাচ্ছেন। আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি?”
হতভম্ব হাসান কি বলবে বুঝতে পারছিল না। এত রাতে একটি একা মেয়ে তার সাহায্য চেয়েছে । তাকে সাহায্য করা তার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এজন্য তাকে যদি কোন ঝামেলার মধ্যে পরতে হয়??
“হা, আমি সেদিকেই যাচ্ছি। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন”। দুইজন হাঁটলে লাগল।
“তা আপনি কি করেন? প্রথমে হাসান জানতে চাইল”?
“ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে পড়ি। আপনি?”
আমি একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে লেকচারার হিসেবে জয়েন্ট করেছি। তা এত রাতে আপনি একা এলেন, আপনার ভয় করে না।
“না, মানুষকে আমি বিশ্বাস করি। মানুষ হয়ে যদি মানুষকেই বিশ্বাস না করলাম তাহলে মানুষ হিসেবে সার্থকতা কি?”
“হা, আপনার সাথে আমি একমত। তবে অতিরিক্ত বিশ্বাস কিন্তু ভাল নয়। আপনি হয়ত কাওকে বিশ্বাস করলেন এবং সে আপনার এ বিশ্বাস এর সুযোগ নিয়ে আপনার সাথে প্রতারণা করল এবং আপনার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিল”।
“কিন্তু আমি ত আপনাকে বিশ্বাস করলাম। আপনি কি আমারা বিশ্বাস ভেঙ্গে দিবেন?”
“ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন। আমি কারও বিশ্বাস কখনো ভাঙ্গি নাই। ভাঙবও না”।
“ আচ্ছা, বলতে পারেন, পুরুষরা এমন কেন? তারা কেন আমাদের নিয়ে কাচের পুতুলের মত খেলে। আমাদের বিশ্বাস নিয়ে খেলে? কেন আমাদের তারা খেলার পুতুল মনে করে। আমাদের শারীরিক অস্তিত্ব ছাড়া কোন অস্তিত্ব তাদের কাছে ধরা পরে না। আমারা তাদের উপর একটু নির্ভর করতে চাই। আর সে সুযোগে...............।
“কি? সে সুযোগে কি????”
“ আমি প্রথমে আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আমি পুরুষদের একটুকুও বিশ্বাস করি না। কোন মেয়েই হয়ত পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমি করতাম। কিন্তু সে বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু আপনার জন্য আমরা আবার সে বিশ্বাস ফিরে এসেছে। আমি এখন বাড়ি যাব, আমার আসল বাড়িতে।ওই দিকে মাধবীলতা গ্রাম। খুব সুন্দর গ্রাম। আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি এখন যাই। আমাকে যেতে হবে।
বলেই হাঁটতে লাগল, অন্ধকারের দিকে। হাসান ডাকতে লাগল। কিন্তু একবারের জন্য ফিরে তাকালনা। হাসান স্থির দাড়িয়ে রইল।
দরজা খুলে হিমেল বোকার মত তাকিয়ে রইল।
“কি, ঢুকতে দিবি না”। হাসান হেসে বলল।
তুই, এত রাতে।
হা, তোকে surprise দেবার প্লান ছিল। তাই এই ভাবে আসা। আর তোদের ট্রেন। বিকেলের ট্রেন আসে রাতে। তবে ভাগ্য ভাল। একজন মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। আরে আশ্চর্য, মেয়েটার নাম তা জানা হল না।
মেয়েটার পড়নে কি লাল শাড়ি ছিল।
হা।
মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর আর নিস্পাপ, তাই না।
হা, কিন্তু তা তুই জানলি কি করে?
ওর নাম আমাদের গ্রামের নামে, মাধবীলতা। ওই ত দেয়ালে ওর ছবি।
হাসান বোকার মত দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটিই তো ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তারপর হঠাৎ করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
ও আমার বোন। বড় আদরের বোন। সবাইকে বিশ্বাস করত। সবাইকে ভালবাসত। সে বিশ্বাসই তার জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। ইউনিভার্সিটি ছুটির পর কাওকে কিছু না বলে বাড়ি উঠার ট্রেন ধরে। আমাদের সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু জীবন তার জন্য সব থেক বড় সারপ্রাইজ নিয়ে আসে। ট্রেন থেকে নেমে একা পথ ধরে আসতে থাকে, শীতের রাতে। কিন্তু সে বাড়িতে আসতে পারেনি। মানুষরূপী কিছু হায়েনা তাকে বাড়ি পৌছার কথা বলে। আমার সরল বোনটি ওদের বিশ্বাস করে। কিন্তু ওরা মাধবীলতাকে কে বাড়িতে আসতে দেয়নি। পরদিন মাধবীলতার লাশ নদীর ধারে পাওয়া যায়। পড়নে লাল শাড়ি।
সেই থেকে মাধবীলতাকে শীতের রাতে দেখা যায়। সে বাড়িতে ফিরতে চায়। একটু নিরাপদে। এই এলাকার কেও এখন রাতের বেলায় ওই পথ দিয়ে যায় না। সম্ভবত তুই ওকে প্রথম নিরাপদে বাড়ি নিয়ে এসেছিস। তুই কি ওর কবর তা একটু দেখবি।
নদীর পাড়েই মাধবীলতার কবর।
মাধবীলতা ঘুমিয়ে আছে। নিশ্চিন্তে, নিরাপদে। যেখানে কোন হায়েনা তার নোংরা হাত তার দিকে বাড়াতে পারবে না।
উৎসর্গঃ সকল নারী ব্লগার দের যারা শুধুমাত্র নারী হবার অপরাধে(?) ব্লগে নোংরা মন্তব্যের শিকার হন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




