somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘমালাঃ পর্ব-৩

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্বঃ১- Click This Link , পর্বঃ ২- Click This Link

সকাল থেকেই রমানাথের পেটে ব্যথা করছিল। ওষুধ খেয়েও কাজ হয়নি। ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে সে বলল,
-ও ভগমান, এর থেইকা দুই বেলা জ্বর হওনই তো ভালা আছিল।
দুপুরের দিকে তার পেট ব্যথা সেরে গেল। কিন্তু ভগবান মনে হয় তার প্রার্থনা কবুল করে ফেলেছেন ততোক্ষণে। কারন-দুপুরের পর থেকে তার মাথা ব্যথা শুরু হল। সেই সাথে জ্বর। রমানাথ বুঝল, তার প্রার্থনা ঠিক হয় নি। তার বলা উচিত ছিল অসুখ ভালো করে দেবার কথা। কিন্তু তা না করে সে অন্য একটা অসুখের নাম করেছে। সে তখন মনে মনে ‘হরি’ নাম জপ করতে শুরু করল। আবার হাসান সাহেবের আসার কথা যত বার মনে হচ্ছিল ততবার তার বুকের ধড়ফড়ানিটাও বেড়ে যাচ্ছিল। একই সাথে ভয় এবং আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল তার। সাহেব গ্রামে আসবেন বলেছিলেন, কিন্তু কেন আসবেন সে কথা তো বলেন নি। সাহেবের আসার কারন বের করতে না পেরেই ভয়টা হচ্ছিল। আবার মেয়েটাকে দেখতে পাবে এই আনন্দে ভয়টা কেটে কেটে যাচ্ছিল। সাহেব বিদেশ থেকে আসার পর ছয় বছর হয়ে গেছে। এই ছয় বছরে তনয়া মেয়েটাকে সে একবারও সরাসরি দেখেনি। কারন- হাসান সাহেবের বাসায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না তার। সে যতবারই ঢাকায় গিয়েছে, সাহেবের অফিস পর্যন্তই গিয়েছে। কখনো থাকার দরকার হলে সাহেবের অফিসে বা হোটেলে থেকেছে। তবু হাসান সাহেব তাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যান নি। তনয়ার অনেকগুলো ছবি আছে তার কাছে। মেয়েটাকে সে কেবল ছবিতেই দেখেছে। সরাসরি দেখতে কেমন লাগবে তাকে, ছবির চেয়ে কম সুন্দর লাগবে, নাকি বেশি সুন্দর লাগবে; এইসব কিছু ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে ছাড়া ছাড়া স্বপ্নও দেখল। কোন মাথা-মুন্ডু নেই সেসব স্বপ্নের। যেমন- একটা স্বপ্নে সে দেখল, ঘরে চোর ঢুকেছে। চোর তার সামনে থেকে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু চোরকে সে কিছুই বলছে না। তার বৌ খুকু রানী তখন চিৎকার করে বলল, ‘ধরেন ব্যাটারে’। রমানাথ চোরের লুঙ্গি চেপে ধরল। কিন্তু চোরটা লুঙ্গি রেখেই পগার পার হয়ে গেল। রমানাথ তখন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, হাতে লুঙ্গির বদলে আস্ত একটা কুমড়া। রমানাথের ঘুম ভাঙল রিক্সার ক্রিং ক্রিং ঘণ্টা শুনে। জেগে দেখে, সারা শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। জ্বর ছেড়ে গেছে।
তার বুকে আবার ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে লাফিয়ে যেন গলার কাছে চলে আসছে। কিন্তু এখন আর তার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, সাহেব না এলেই ভালো হত। সে বাচ্চা ছেলের মতো আপাদমস্তক লেপে মুড়িয়ে শুয়ে থাকল। ভাবল, ছটফটানিটা কমুক।

উঠানে পা দিয়েই রাতের অদ্ভূত দৃশ্যে চোখ আটকে গেল তনয়ার। গাছের নিচে নিচে হাজার হাজার জ্বোনাক এখানেও জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে, এটা যেন কোন বিয়ে বাড়ি। চারদিকে যেন তারাবাতি জ্বলছে। সে একই কবিতার আরও চারটা লাইন বিড়বিড় করে বলল,
“কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
জ্বোনাক কোথা হয় শুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক-ঠিকানা
চোখ যে আলা, রতন উঁছে।”
জয়ন্ত ব্যাগগুলো টেনে টেনে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বাবা-মেয়ে একসাথে হাঁটছিল, আর সে সামান্য আগে আগে। তনয়া তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
-বাবা, এই লাইনগুলো কোথায় আছে? আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না এটা কোন কবিতা।
-কোন লাইনগুলো রে, মা।
তনয়া শব্দ করে তাল রেখে লাইনগুলো আবৃত্তি করল। হাসান সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি আবৃত্তি ভালো বোঝেন না, কখনো শোনেনও না। কিন্তু মেয়ে আবৃত্তি করলেই তাঁর মনে হয়- বাহ, ভালো আবৃত্তি শিখেছে তো মেয়েটা! লাইনগুলো জয়ন্তের কানে গিয়েছে। সে হাঁটতে হাঁটতেই পেছনে তাকিয়ে বলল,
-এটা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, দিদিমণি। কবিতার নাম- ‘দূরের পাল্লা’।
হাসান সাহেব আরেকবার চমৎকৃত হলেন। উত্তর দিয়েই জয়ন্ত আবার আগের মতো হাঁটতে শুরু করেছে। তনয়া সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।

দোতলায় একটা ঘরের তালা খুলে ব্যাগ দুটি নিয়ে ভেতরে ঢুকল জয়ন্ত। হাসান সাহেব এবং তনয়া বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। ভেতরে ঢুকে একটা চার্জ লাইট জ্বালিয়ে দিল সে। তখন বাবা-মেয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘরের এক কোনায় ব্যাগ রেখে হাসানুল হকের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল,
-কাকু, আপনারা আরাম করুন। বাবা মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
হাসান সাহেব ঘরটার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন,
-বিদ্যুতের লাইন কি নেই?
জয়ন্ত একটু হেসে বলল,
-থাকবে না কেন, আছে। তবে বিদ্যুতের খুব সমস্যা এখানে।
-ওহ।
জয়ন্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এই প্রথম তনয়া ওকে ভালো করে দেখল।

জয়ন্ত এসে বাবার পিঠে ধাক্কা দিল।
-বাবু, ও বাবু।
রমানাথ কচ্ছপের মতো মাথা বের করে জয়ন্তের দিকে তাকাল। জয়ন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
-বাবু, শরীল কি বেশি খারাপ নি?
রমানাথ কিছু বলল না। তার বুকের ছটফটানি কমে নি। বরং আরও বেড়ে গেছে। জয়ন্ত বাবার কপালে হাত রাখল। শরীর ঠান্ডা। সে জিজ্ঞেস করল,
-বাবু, পেডে ব্যাথা কইমছে নি?
রমানাথ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। জয়ন্ত বলল,
-সাহেব আই পড়ছে। উডি যাও।
রমানাথ উঠে নলকূপে গেল। জয়ন্তও বাবার পেছন পেছন গেল। কল চেপে পানি তুলে দিল। রমানাথ হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে এল। ছেলের সাথে একটা কথাও সে বলল না। জয়ন্ত আগের মতোই বাবার পেছন পেছন গেল। খুকু রানী চিৎকার করছে। কেন চিৎকার করছে সেটা দেখা দরকার। জয়ন্ত মায়ের কাছে গেল। যাওয়ার আগে বাবাকে বলে গেল,
-বাবু, তুঁই সাহেবের লগে দেখা করি আইয়ো। আমি মা’র লগে আছি।

খুকু রানীর দুই পা অচল হয়ে গেছে কিন্তু হাত দুটা এখনো ঠিক আছে। সে দুই হাতে জয়ন্তকে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে লাগল। জয়ন্ত মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। খুকু রানী কথা বলতে পারছে না। শুধু আউ আউ করছে। জয়ন্ত বলল,
-মা, কী অইছে? ডরাইছ? ডরাইছ নি?
-আঁ আঁ আঁ...
-কী অইছে? ডরাইছ? কী দেইখা ডরাইছ?
খুকু হাত দিয়ে ঘরের ছাদের দিকে কী দেখায়, জয়ন্ত বুঝতে পারে না।

(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

Testimony of Sixty- By Edward Kennedy বাংলাদেশের রক্তাক্ত সত্যের এক আন্তর্জাতিক স্বীকারোক্তি

লিখেছেন কিরকুট, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৩




১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর বৈপরীত্যের বছর। এটি যেমন ছিল অন্ধকার ও রক্তাক্ত, তেমনি ছিল সত্যের প্রতি অবিচল এক সময়কাল। এই বছরের গণহত্যা, শরণার্থী স্রোত ও মানবিক বিপর্যয়ের বিবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×