somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আর নয় গ্রন্থসমালোচনার ভয় ! (স্যাম্পল গ্রন্থ সমালোচনাসহ)

২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলা সিলেবাসে নতুন যে ‘আতঙ্ক’ যোগ হয়েছে তার নাম ‘গ্রন্থ সমালোচনা’। একে তো যে বইটার সমালোচনা করতে হবে সেটা পরীক্ষার্থীর পঠিত বইগুলোর মধ্য থেকে কমন পড়বে কিনা তার অগ্রিম টেনশন, তার ওপর বড় একজন লেখকের বিখ্যাত একটি গ্রন্থের ওপর পন্ডিতি ফলাতে হবে ! এ যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা ! তাও আবার পাক্কা পনেরটা নম্বর ! যা কিনা বিসিএস এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ক্যাডার পাওয়া না পাওয়ার মতো ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে । অথচ এটি যদি কেউ সুন্দরভাবে প্রথম দিকেই উত্তর করে ফেলেন তাহলে স্যার তাকে বিশাল সাহিত্যবিশারদ মনে করে আর ঘাঁটানোর সাহস পাবেন না। পরের প্রশ্নগুলোতে বেশি বেশি করে নম্বর দিয়ে নিজেই গর্ববোধ করবেন একজন সাহিত্যরসিককে আবিষ্কার করতে পেরেছেন ভেবে ! যারা এটি নিয়ে মাথা ব্যাথায় ভুগছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থ সমালোচনা একটা মজার খেলা বৈ নয়, যদি কিছু টেকনিক আপনার জানা থাকে। এই টেকনিকগুলো কি কোনো বইয়ে পাওয়া যাবে? না মশায় ! এসব কথা সরাসরি কোনো বইয়ে লেখা থাকবে না ! ছোটবেলা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাহিত্য সমালোচনা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । লক্ষ্য করেছি, সব সমালোচকই গ্রন্থ সমালোচনার সময় কিছু অলিখিত বিধান মেনে চলেন । সেগুলো সচেতনভাবে চিন্তা করে লিপিবদ্ধ করে দেখলাম কিছু নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল যেগুলো মেনে সমালোচনা করলে ভালো নম্বর আশা করা যায় । বাজারে বহুল প্রচলিত বিসিএস গাইডগুলোর গ্রন্থ সমালোচনার বহর দেখে আমার প্রচন্ড কান্না চাপল । বিশ্বাস করুন, সেগুলো গ্রন্থ সমালোচনার বদলে গ্রন্থটীকা বা কাহিনী সংক্ষেপ (Blurb ) হয়েছে । আমি স্যার হলে গ্রন্থসমালোচনার মতো একটা শিল্পের ইজ্জত নষ্ট করার অপরাধে তাদের জিরো দিতাম । যাই হোক, এসব দেখেই লেখাটি লিখতে আগ্রহী হলাম যেন গ্রন্থ সমালোচনাকে ভয় পাওয়া লোকদের ভীতি মন্দীভূত হয় ।
গ্রন্থ সমালোচনা লেখার জন্য প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে, গ্রন্থ সমালোচনা কী? এটি আসলে সাহিত্যের একটি শাখা যেখানে কোনো গ্রন্থের গঠনমূলক আলোচনা (প্রশংসা বা নিন্দা অথবা উভয়টিই) করা হয় এমন কতগুলো যৌক্তিক মানদন্ডের ওপর ভিত্তি করে যেগুলোর দ্বারা একটি সাহিত্যকর্ম কতটা শিল্পরূপ পরিগ্রহ করেছেন তা পরিস্ফূটিত হয় । তাই গ্রন্থ সমালোচনার সময় নিচের টেকনিকগুলো খেয়াল রাখবেনঃ
১। ১৫ নম্বরের জন্য যে সমালোচনাটি লিখবেন তা দুই পাতা অর্থাৎ চার পৃষ্ঠা হলেই এনাফ যদি আপনার প্রতি পেজে ১৩-১৫ টা লাইন থাকে যেখানে প্রতি লাইনে ৭-১০টি শব্দ থাকে।
২। বিখ্যাত সাহিত্যিকদের জন্মসাল- মৃত্যুসাল আপনাকে আগে থেকেই মুখস্থ রাখতে হবে। যেন সর্বপ্রথম যখন সাহিত্যিকের নামটি উল্লেখ করবেন তখন ব্র্যাকেট দিয়ে তাঁর জন্ম-মৃত্যু সালটিও দিয়ে দিতে পারেন। এতে শিক্ষকের সমীহ-দৃষ্টি আপনার ওপর পড়বে ।
৩। আপনার লেখাটি চার ভাগে বিভক্ত হলে ভালো হবে-
i) গ্রন্থ পরিচয়
ii) প্রশংসা
iii) খুঁতপ্রদর্শন এবং
iv) আবারো প্রশংসা ।
নিচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলঃ
i) গ্রন্থ পরিচয়ঃ এক বাক্যে গ্রন্থটি কোন ধরনের (গল্প/উপন্যাস/ কবিতা ইত্যাদি) তা লিখবেন সাহিত্যিকের নামের আগে বিশেষণ যোগ করে । যেমনঃ অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি ।
ii) প্রশংসাঃ প্রশংসা প্রধানত তিন ধরণের হতে পারে-
ক) উচ্ছ্বসিত প্রশংসা
খ) স্বাভাবিক প্রশংসা
গ) গাম্ভীর্যপুর্ণ প্রশংসা
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সাধারণ মানুষ করে। ‘জোস’, ‘অসাম’, ‘ফাটাফাটি’ ইত্যাদি হচ্ছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। কিন্তু সমালোচকগণ শুধু এগুলোই বলেন না, তাঁরা কেন জোস, কেন অসাম , কেন ফাটাফাটি তাও বলে থাকেন । স্বাভাবিক প্রশংসা হচ্ছে আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ভালোকে ভালো বলা। আর গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রশংসা এমন প্রশংসা যেটা পাঠকের কাছে সমালোচকের গ্রাভিটি বাড়িয়ে দেয় । এখানে প্রশংসা এমনভাবে করা হয় যে, মনে হয় সমালোচক আসলে খুবই খুঁতখুতে মেজাজের মানুষ, তার প্রশংসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । কিন্তু লেখক এত ভালো লিখেছেন যে প্রশংসা না করে থাকা গেল না ! এই ধরণের প্রশংসা যিনি করতে জানেন শিক্ষক তাকে ভালো নম্বর দিতে বাধ্য। তাই এই ধরণের প্রশংসা বেশি বেশি করার চেষ্টা করবেন । সব প্রশংসা একবারে করবেন না । শেষে করার জন্য কিছু প্রশংসা বাকি রেখে দেবেন ।
iii) খুঁত প্রদর্শনঃ প্রশংসার প্রথম পর্ব শেষ হলে খুঁত ধরা শুরু করুন । প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে (যেমনঃ মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ) এর মাত্রাটা কড়া না হয়ে বিনয়সূচক হবে। তাদের সাহিত্যকর্মের ত্রুটিগুলোকে সরাসরি ত্রুটি হিসেবে না দেখে ‘সীমাবদ্ধতা’ হিসেবে দেখা ভালো । কিছু না কিছু খুঁত অবশ্যই ধরবেন, নতুবা সমালোচনা স্বার্থক হবে না। আপনি যে একটা হোমরা-চোমরা গোছের সাহিত্যবোদ্ধা সেটা স্যারকে বোঝাতেই আপনাকে এই সমস্ত বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের ত্রুটি ধরতে হবে !!!
iv) প্রশংসাঃ যে প্রশংসাগুলো আগে বাকি রেখে দিয়েছিলেন সেগুলো এ পর্যায়ে করে ফেলতে হবে। শেষ-মেষ উক্ত সাহিত্যিককে কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক কালজয়ী লেখক প্রমাণ করে দিন।
৪। এর মধ্যেই অনেকে হয়তো ভয় পেয়ে গেছেন যে, একজন ছাপোষা সাধারণ মানুষ হয়ে কীভাবে এত বড় একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের প্রশংসা করব বা বিশেষত খুঁত ধরব। ভয়ের কিছু নেই, প্রশংসার বা খুঁতধরার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখলেই চলবে-
i) সাহিত্যকর্মটি কোন যুগের তা নির্ণয় করুন। সেটি যেই যুগেরই হোক দেখুন সেই যুগের সাপেক্ষে কতটা আধুনিক। আর আধুনিক যুগের সাথে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ তারও একটা তুলনা করার চেষ্টা করুন । সেই যুগের অন্যান্য সাহিত্যকর্মের সাথে তার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খুঁজে সেটির সাফল্য-ব্যর্থতা অনুসন্ধান করুন ।
ii) সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সাথে আলোচ্য সাহিত্যিককে তুলনা করুন। এ কাজের জন্য খুবই মুখরোচক একটা পদ্ধতি হচ্ছে- আপনার বিচারে সেই সাহিত্যিক যদি সমসাময়িক সাহিত্যিকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হন তাহলে সমসাময়িক সাহিত্যিকদের কিছুটা নিন্দা করে তাঁর প্রশংসা করুন। অন্যথায় বিপরীতটি করুন (বাঙ্গালীর চোখে কাউকে বড় করতে গেলে অন্যদেরকে ছোট করতে হয়, নয়তো বাঙ্গালী তাঁর বড়ত্ব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না!!!)
iii) বিশ্বসাহিত্যের বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে আপনার সাহিত্যিককে তুলনা করুন । এবং যে কোনো মূল্যে তাঁকে তাঁদের সমপর্যায়ের বানিয়ে দিতে পারলে আপনার সমালোচনা এক বিশেষ রঙ ধারণ করবে । এ কাজের জন্য আপনাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, ফ্যান্টাসি প্রভৃতি প্রত্যেক ধাঁচের দুই একটা করে ক্লাসিক বিদেশী বইয়ের অনুবাদ পড়ে রাখতে হবে। প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার সাথে এটা না করতে পারলে স্যারের বিরক্তির কারণ হবেন। আর করতে পারলে তো আপনার নম্বর এক লাফে বেড়ে যাবে ।
৫। অনেকে প্রশংসার বিশেষ করে খুঁত ধরার পয়েন্ট খুঁজে পাচ্ছেন না। নিচের পয়েন্টগুলো চেক করুন, এগুলোর মাধ্যমে বিচার করতে গেলেই কিছু না কিছু প্রশংসা এমনকি খুঁতও বেরিয়ে আসবেঃ
i) সাহিত্যকর্মটি নিজ যুগের সাথে কতটূকু সাযুজ্যপুর্ণ (পূর্বে আলোচিত) ।
ii) আধুনিক যুগের কী কী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে (পূর্বে আলোচিত) ।
iii) লেখাটি যে ধরণের সেই ধরণটিকে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছে । যেমনঃ রাজনৈতিক একটা উপন্যাসের মধ্যে কতটুকু রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে কতটুকু মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক উপন্যাসে কতটুকু সমাজচিত্র উঠে এসেছে ।
iv) লেখকের সমজাতীয় একাধিক বই থাকলে সেগুলোর তুলনায় আলোচ্য বইটি কেমন ।
v) চরিত্রচিত্রণ । এটি এমন একটি পয়েন্ট যে, যত বাঘা বাঘা লেখকই আসুন না কেন এই পয়েন্টে তাকে ধরা খেতেই হবে। একটি বইয়ে অসংখ্য চরিত্র থাকে। সবগুলো চরিত্রের ওপর সমানভাবে আলো ফেলা যায় না । আর তা করতে গেলে সাহিত্যকর্মটির শিল্পমানও ঠিক বজায় থাকে না। কিন্তু আপনি তো সমালোচক, আপনার কাজ নিন্দা করা, আপনাকে তো তার চেয়ে ভালো একটি গ্রন্থ লিখে দিতে হচ্ছে না। কাজেই, খুঁত ধরার মতো কিছু না পেলে কোনো একটা চরিত্রকে নিয়ে অভিযোগ করুন যে, লেখক এই চরিত্রটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন (অনেক বড় বড় সমালোচকও এরকম বেহুদা অভিযোগ করে থাকেন) । আবার দেখুন, লেখক নায়ক অথবা নায়িকা কাকে বেশি ফোকাস করেছেন। এসব নিয়েও দুই এক লাইন বকবক করুন ।
vi) প্রধান চরিত্রের প্রেম, কাম, হিংসা, মহত্ব, বীরত্ব, ভীরুতা, মানবতা, দ্বিধা, ব্রীড়া (লজ্জা) প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ প্যাঁচাল পাড়ুন ।
vii) লেখার মধ্যে লেখকের কী দর্শন ফুটে উঠেছে তা উল্লেখ করুন ।
viii) লেখকের আলোচ্য গ্রন্থের ওপর অন্যান্য সমালোচকের দুই একটা উদ্ধৃতি দেওয়ার চেষ্টা করুন।
মোটামুটি ওপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখে ৫-৬ টি গ্রন্থ সমালোচনা তৈরি করে রাখুন । তারপর শুধু বেশি বেশি করে গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন। পরীক্ষার হলে যাই আসুক পূর্বপ্রস্তুত ৫-৬টি সমালোচনার ভালো ভালো কিছু বাক্য চয়ন করে নতুনটির সাথে তাল মিলিয়ে জুড়ে দিন, সাথে নতুন কিছু কথা যোগ করুন। ব্যাস আপনার গ্রন্থসমালোচনার রেসিপি তৈরী (গরম গরম পরিবেশন করুন)!!!
কেমন হয়, যদি যে কথাগুলো বলা হল সেগুলোর আলোকে একটি স্যাম্পল গ্রন্থ সমালোচনা করে দেখানো হয়? আপনাদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে আমি সর্বজনপঠিত একটি বইকে বেছে নিলাম সমালোচনা করার জন্য। বইটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ । আমার সমালোচনাটি হয়তো তেমন ভালো হয়নি, কিন্তু উপর্যুক্ত ফর্মুলাগুলো অনুসরণ করলে আপনি যে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গ্রন্থসমালোচনা লিখতে পারবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই ।

গ্রন্থ সমালোচনাঃ পদ্মা নদীর মাঝি
রচয়িতাঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)
জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' বাংলা উপন্যাসের জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এই উপন্যাসে তিনি পরিমিত ও পরিমাপিত বাক্যব্যঞ্জনায় পদ্মাপাড়ের জেলেদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের ছবি অংকন করেছেন। মানিকের লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মেদবাহুল্যতা বর্জন এবং সাংবাদিকসুলভ নির্লিপ্ততা ও নির্বিকারত্ব । সমকালীনদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হলো তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার জুড়ে কোনো চরিত্রের বর্ণনা দিতেন না । তুলির এক আঁচড়েই যেন এঁকে ফেলতে চাইতেন সব । সাহিত্যে তাঁর মিতব্যয়িতা বোঝাতে গিয়ে জনৈক অধ্যাপক বলেছিলেন, 'পদ্মা নদীর মাঝি' শরৎচন্দ্রের হাতে পড়লে চার খন্ডের শ্রীকান্ত হয়ে যেত !' তাঁর এই পরিমিতিবোধের মূল কারণ ছিল তিনি নিছক লেখার উদ্দেশ্যে লিখতেন না, একটি আদর্শকে সামনে রেখে লিখতেন।
ব্যক্তি জীবনে মানিক ছিলেন মার্ক্সবাদী আদর্শের অনুসারী, সেইসঙ্গে তাঁর মনন ছিল ফ্রয়েডীয় চেতনায় লালিত।
তাই আমরা যখন 'পদ্মা নদীর মাঝি'র স্বার্থকতা বিচার করব তখন দেখব এটি লেখকের চিন্তা-আদর্শের ভিত্তিতে কতটুকু স্বার্থক। এক্ষেত্রে, লেখকের আদর্শের সঙ্গে সহমত হওয়াটা জরুরী নয়।
সেই বিচারে 'পদ্মা নদীর মাঝি'র মূল্য বিচার করলে এক বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া যায় । মানিক যেভাবে দারিদ্র- ক্লেষকে এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন তা শরৎ কিংবা বিভূতিভূষণের চেয়ে কোনো অংশে কম করুণ নয়। কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ে চোখে পানি আসলেও সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় উল্লেখ থাকেনা । সেই বিবেচনায় মানিককে ওপরেই রাখতে হয় এজন্য যে, তিনি এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের একটা পথ দেখিয়েছেন। যদিও তাঁর দেখানো পথ নিয়ে বিতর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় । তাঁর মতে, একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রই পারে সমাজের বঞ্চনাপীড়িত মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে । তাই তিনি নিজের চিন্তাকে প্রতিফলিত করেছেন হোসেন মিয়ার চরিত্রে। হোসেন মিয়া কুবের কপিলাকে তার কিনে নেওয়া ময়না দ্বীপে পাঠিয়ে দেয় । ময়না দ্বীপ আসলে একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রেরই প্রতিকী রূপ, লেখকের স্বপ্নের ইউটোপিয়া । এখানে কুবের যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নোবেলজয়ী উপন্যাস 'The Old Man and The Sea' এর সেই বৃদ্ধ মাঝির মতো যে শত প্রতিকূলতার মাঝেও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে । মার্কসবাদের আদর্শ ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' কিংবা ফিওদর দস্তয়ভস্কির 'ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট' উপন্যাসেও আমরা পাই। কিন্তু রাশিয়া মার্কসবাদের জন্মভূমি বলে তাঁদের উপন্যাসে এটির খোলামেলা উপস্থিতি। কিন্তু এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক একটা সূক্ষ্মতা ও দক্ষতার সাথে মার্কসবাদকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, সাহিত্যের মানও ক্ষুণ্ণ হয়নি, মাঝে থেকে একটা ভিনদেশী রাজনৈতিক মতাদর্শকে একটি সামাজিক উপন্যাসে এত শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে মানিকের মুন্সিয়ানা তাকে ম্যাক্সিম গোর্কিদের মতো গ্রেট নভেলিস্টদের কাতারে নিয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না ।
জেলে জীবনের সুখ-দুঃখকে নিঁখুতভাবে রূপায়িত করতে এবং তাদের মুখের আঞ্চলিক ভাষাকে সঠিকভাবে তুলে আনার জন্য লেখক কেতুপুর গ্রামে থেকেছেন, জেলেদের সাথে মিশেছেন। লেখকের এই অকৃত্রিম নিষ্ঠা আমাদেরকে মুগ্ধ করে ।
মানিক সম্ভবত ‘Art for art sake’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁর কাছে বৈধ-অবৈধ কোনো বিষয় নয়, শৈল্পিকতা সৃজন করতে গিয়ে তিনি আদিমতার অন্ধকারে ঢুকে যেতেও কুণ্ঠিত হননি । তাইতো কুবের- কপিলার মতো শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের অবৈধ প্রেমকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন, এমনকি পরিণতিও দিয়েছেন ।
সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ক্ষোভ লুকানোর চেষ্টা করেননি মানিক-‘ ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে । এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না ।’
নারী চরিত্রের রহস্যময়তা লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে স্বার্থকভাবে । পদ্মার মতো রহস্যময়ী কপিলা স্বামীগৃহে ঘোমটা টানা বধু যে কিনা কুবেরের দিকে নুয়ে পড়ে অবাধ্য বাঁশের কঞ্চির মতো । শ্বশুরবাড়িতে কপিলাকে আনতে গেলে বলে, ‘মনডার অসুখ মাঝি, তোমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি ।’ কিন্তু কুবের যখন বলে, ‘তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা’, তখন খোলসের মধ্যে ঢুকে যায় কপিলা- ‘ক্যান মাঝি ক্যান? আমারে ভাব ক্যান? সোয়ামির ঘরে না গেছি আমি? আমারে ভুইলো মাঝি...গাঙ এর জলে নাও ভাসাইয়া দূর দ্যাশে যাইয়ো মাঝি, ভুইলো আমারে ।’ কিন্তু কুবেরকে ভুলতে বলে কপিলা নিজেই ভুলতে দেয় না তাকে । ‘শ্যামাদাস না কুবের অর্থাৎ বৈধ না অবৈধ এই দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ে কপিলা । এবং কী আশ্চর্য! শেষ পর্যন্ত অবৈধটাই বেছে নেয় সে । ‘আমারে নিবা মাঝি লগে’ বলে চিরসঙ্গী হয় কুবেরের ।
তবে এতকিছু সত্ত্বেও নৈতিকতা নিয়ে লেখকের চিন্তাধারা পাঠককে দ্বিধান্বিত করে । শেতলবাবুর মধ্যে লোক ঠকানোর প্রবণতা থাকায় লেখক তাকে ঘৃণিত করে তুলে ধরেছেন । অপরদিকে অবৈধ পন্থায় হোসেন মিয়া আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে তবু তার প্রতি লেখকের কোনো ঘৃণা নেই । বরং নিজেই আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্যে । কারণ একটাই, হোসেন মিয়া মানবপ্রেমী । অর্থাৎ ব্যাপারটা যেন এরকম, ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না, মানবপ্রেম থাকলেই চলবে ।
বাংলা সাহিত্যের সমকালীন লেখকদের মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সুন্দর একটা গল্প বলার । কিন্তু মানিক যেন অনেকগুলো স্ন্যাপশটকে একত্রে জোড়া দিয়েছেন । কাহিনীর মধ্যে যে গতিময়তা, যে ক্লাইম্যাক্স থাকা দরকার তা যেন মানিকের রচনায় কিছুটা বিবর্ণ । তাঁকে কাহিনীর প্লটের চেয়ে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক চিত্রায়ণের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে দেখি । এ কারণে রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎ এর মতো তাঁর গল্পের বুনট সঙ্ঘবদ্ধ মনে হয় না ।
শেষের দিকে এসে মনে হয় তিনি যেন স্বপ্নের ইউটোপিয়া কায়েম করার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছেন । সাতকুড়ি তেরটাকা ভর্তি একটা ঘটি চুরির ঠুনকো অজুহাতে লেখক কুবেরকে চিরদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন ময়নাদ্বীপে । কারাবরণের ভয়ে ঘর সংসার ছেড়ে চিরনির্বাসনে যাওয়াটা কি বাস্তবতার পরিপন্থি নয় ? একটি বাস্তবধর্মী উপন্যাসের ফিনিশিং এমন ফিকশনধর্মী হওয়াটা কিছুটা বেমানানই বলব । তবে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট থেকে সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, পদ্মা নদীর মাঝি একটি নিরীক্ষাধর্মী সামাজিক উপন্যাস- যেখানে সমাজতন্ত্র, মনোসমীক্ষণবাদ ইত্যাদি বহু বিষয়ের মিশেল ঘটেছে যথার্থ অনুপাতে । স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাংলা উপন্যাস নিয়ে এমন দুঃসাহসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা মানিকের ভেতরের ‘ড্যামকেয়ার’ সত্ত্বাটিকে ফুটিয়ে তোলে । আজ উত্তরাধুনিক যুগে এসে ঔপন্যাসিকদের লেখায় যে বিষয়গুলো প্রতিভাত হয় মানিক সেই সময়ই সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করেছেন । সে কারণে এই দাবি করলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, মানিক কালের আগে জন্মেছিলেন ।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৩৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×