ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আল ছিলেন সৌদি আরবের একজন বাদশাহ । ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বপালন করেন । বাদশাহ হিসেবে তিনি দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও আধুনিকীকরণ এবং সংস্কারে সফল হয়েছেন । তার বৈদেশিক নীতির মূল দিক ছিল প্যান ইসলামিজম ও কমিউনিজম বিরোধীতা এবং ফিলিস্তিনি দাবির সমর্থন । তিনি দেশের আমলাতন্ত্রকে সফলভাবে সংহত করেন । তিনি সৌদি আরবের জনতার মধ্যে তার শাসন জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ।
১৯০৬ সালে ১৪ই এপ্রিল ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ জন্মগ্রহণ করেন । এবং ১৯৭৫ সালে তার ভাইপো ফয়সাল বিন মুসাইদের হাতে তার মৃত্যুর ঘটনা ঘটে । তিনি ছিলেন তার বাবার তৃতীয় সন্তান । তার মা তারফা বিনতে আবদুল্লাহ বিন আবদুল লতিফ আল শাইখ । ১৯০২ সালে রিয়াদ জয়ের পর আবদুল আজিজ তাকে বিয়ে করেন । ফয়সালের মা ছিলেন আল আশ শাইখ পরিবারের সদস্য যা ছিল মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের বংশধর । ফয়সালের নানা আবদুল্লাহ বিন আবদুল লতিফ ছিলেন আবদুল আজিজের অন্যতম ধর্মীয় শিক্ষক এবং উপদেষ্টা ।
১৯১২ সালে ফয়সালের মা মারা যান । তারপর তিনি তার নানার কাছে প্রতিপালিত হন । নানার কাছে তিনি কুরআন এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি শিক্ষা নেন । এই শিক্ষা তাকে আজীবন প্রভাবিত করে । ফয়সালের একমাত্র বোন নুরাহর সাথে তার এক চাচাত ভাই খালিদ বিন মুহাম্মদের বিয়ে দেওয়া হয় ।সাহসিকতাকে প্রচুর মূল্য এবং সম্মান দেওয়া হয় এমন এক পরিবেশে ফয়সাল বেড়ে উঠেন । অন্যান্য সৎভাইদের তুলনায় এ দিক থেকে তিনি ব্যতিক্রমও ছিলেন । তার মায়ের কাছ থেকে তিনি গোত্রীয় নেতৃত্ব বিকাশের উৎসাহ পান । ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার বাদশাহ আবদুল আজিজকে লন্ডন আমন্ত্রণ জানান । তিনি যেতে না পারার কারনে তিনি ১৪ বছর বয়সী ফয়সালকে পাঠান । যুক্তরাজ্য ভ্রমণে যাওয়া তিনি প্রথম সৌদি রাজকীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন । তিনি সেখানে পাঁচ মাস অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন । একই সময়ে তিনি ফ্রান্স সহ সফর করেন । রাষ্ট্রীয় সফরে ফ্রান্সে আসা সৌদি রাজকীয় ব্যক্তি হিসেবেও তিনিই সর্বপ্রথম ছিলেন ।
বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের জ্যেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম হওয়ায় ফয়সাল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করেন । হাইল বিজয় এবং আসিরের উপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণের পর ১৯২২ সালে তাকে ছয় হাজার যোদ্ধার সাথে এই সকল প্রদেশে পাঠানো হয়েছিল । বছরের শেষনাগাদ তিনি আসিরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন । ১৯২৫ সালে ফয়সাল হেজাজে বিজয় অর্জন করেছিলেন । পরে তাকে এবং মুহাম্মদ বিন আবদুল আজিজকে ইখওয়ানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । ১৯২৬ সালে ফয়সাল হেজাজের শাসক নিয়োগ হন । তখন শাসনামলে তিনি প্রায়ই স্থানীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করতেন । ১৯৩০ সালে ফয়সাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন । এবং বাদশাহ হওয়ার পরও এই দায়িত্ব পালন করেন । সেসময় তিনি কয়েকবার ইউরোপ সফর করেন । ১৯৩২ সালে তিনি পোল্যান্ড এবং ১৯৩৩ সালে রাশিয়া সফর করেন ।
ফয়সালের বড় ভাই সৌদি বিন আবদুল আজিজ বাদশাহ হওয়ার পর ফয়সালকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন । বাদশাহ সৌদি ব্যয়বহুল কাজে হাত দিয়েছিলেন যার মধ্যে ছিল রাজধানী রিয়াদে প্রান্তে বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা । মিশরের দিক থেকেও সৌদি হুমকি অনুভব করছিলেন । জামাল আবদেল নাসের ১৯৫২ সালে মিশরের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন । মিশরে পালিয়ে যাওয়া তালাল বিন আবদুল আজিজ এবং তালালের প্রভাবিত প্রিন্সদেরকে নাসের ব্যবহার করতে সক্ষম ছিলেন । সৌদের ব্যয়বহুল নীতির কারণে এবং বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে তার অসফলতার জন্য রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্য এবং উলামারা ফয়সালকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য সৌদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন । এই নতুন অবস্থানে ফয়সাল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যয় কমিয়ে আনেন । অর্থনীতিতে তার এই পদক্ষেপ তার আমলের গুরুত্বপূর্ণ ছাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি করে তুলেছিল । বাদশাহ সৌদি এবং যুবরাজ ফয়সালের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় । ১৯৬০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ফয়সাল প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগ করেন। বাদশাহ সৌদ ফয়সালের নির্বাহী ক্ষমতা ফিরিয়ে নেন এবং প্রিন্স তালালকে মিশর থেকে ফিরিয়ে এনে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । ১৯৬২ সালে ফয়সাল রাজপরিবারের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন এবং দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হলেন ।এসময় যুবরাজ ফয়সাল সংস্কার এবং আধুনিকীকরণকারী হিসেবে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । রক্ষণশীল মহলের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও তিনি নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে ছিলেন । সমস্যা সৃষ্টি না হওয়ার জন্য তিনি ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে নারী শিক্ষার কারিকুলাম লিপিবদ্ধ ও তদারক করান । এবং এই নীতি তার মৃত্যুর অনেক পরও পর্যন্ত টিকে ছিল । ১৯৬৩ সালে যুবরাজ ফয়সাল দেশে প্রথমবারের মত টেলিভিশন স্টেশন স্থাপন করেছিন । তবে মূল প্রচার শুরু হতে আরো দুই বছর সময় লেগে যায় । আর অন্যান্য অনেক নীতির মত দেশের ধর্মীয় এবং রক্ষণশীল অংশ এর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল । ফয়সাল তাদের নিশ্চিত করেন যে ইসলামের নৈতিকতার মাপকাঠি কঠোরভাবে মেনে চলা হবে এবং বেশি মাত্রায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে । যুবরাজ ফয়সাল ১৯৬১ সালে মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন । ১৯৬২ সালে তিনি মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন । এটি একটি বৈশ্বিক দাতব্য সংস্থা ছিল । সৌদি রাজপরিবার এতে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দান করেছেন বলে ধারণা করা হয় ।
তথ্য নেট
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:১০