somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইয়ারমুকের যুদ্ধের ইতিহাস ৩য় পর্ব

১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এটি ইয়ারমুকের যুদ্ধক্ষেত্রের বিস্তারিত মানচিত্রের একটি চিত্র
ইয়ারমুকের যুদ্ধের ইতিহাস ২য় পর্ব
ইয়ারমুকের যুদ্ধের ইতিহাস ( প্রথম পর্ব)
ইয়ারমুকের যুদ্ধক্ষেত্র
যুদ্ধক্ষেত্রটি বর্তমানে গোলান মালভূমির দক্ষিণপূর্বে সিরিয়ার হাওরান অঞ্চলে অবস্থিত। এই উচ্চভূমি অঞ্চলটি গ্যালিলি সাগরের পূর্ব দিকে সিরিয়া, জর্ডান এবং ইসরায়েলের সীমান্তে রয়েছে। ইয়ারমুক নদীর উত্তরদিকে সমতল ভূমিতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এর পশ্চিম অংশ ওয়াদি উর রুক্কাদ নামক গভীর গিরিসংকট দেওয়া ঘেরা। এই জলধারার তীর খাড়া পাড় বেষ্টিত যার উচ্চতা ৩০ মি ৯৮ ফু–২০০ মি ৬৬০ ফু। উত্তরে জাবিয়া সড়ক এবং পূর্বে আজরা পাহাড় অবস্থিত। তবে এই পাহাড়গুলো মূল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে রয়েছে। কৌশলগতভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ১০০ মি ৩৩০ ফু উচু তেল আল জুমা একমাত্র লক্ষণীয় স্থান। মুসলিমরা সেখানে জড়ো হয়। সেখান থেকে ইয়ারমুক সমভূমির দৃশ্য ভালভাবে দেখা যেত। ৬৩৬ সালে যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চিমের গিরিখাত মাত্র কয়েকটি স্থান দিয়ে প্রবেশযোগ্য ছিল। সেখানে পারাপারের জন্য আইন দাকারের কাছে রোমান সেতু ছিল। ইয়ারমুকের সমতল ভূমিতে দুই বাহিনীর টিকে থাকার মত পানির সরবরাহ যথেষ্ট ছিল। অশ্বারোহীদের জন্য স্থানটি উৎকৃষ্ট ছিল ।
যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা কেমন ছিল ?
রাথমিক সূত্রগুলোতে মুসলিম সৈনিকের সংখ্যা ২৪,০০০ থেকে ৪০,০০০ এবং বাইজেন্টাইন সৈনিকের সংখ্যা ১,০০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ এর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে। আধুনিক হিসাবে এই সংখ্যার তারতম্য ঘটে। বেশিরভাগ হিসাব মতে বাইজেন্টাইন বাহিনীতে ৮০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ সৈনিক ছিল। তবে কিছু হিসাবে তা ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ দেখানো হয়েছে।আর অন্যদিকের হিসাব অনুযায়ী রাশিদুন সেনাবাহিনীর সৈনিক সংখ্যা ২৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ এর মধ্যে ছিল। মূল হিসাব প্রধানত আরব সূত্রগুলোতে পাওয়া যায়। বাইজেন্টাইন এবং তার মিত্রদের সৈন্য সংখ্যা মুসলিমদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এই ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। এ বিষয়ে একমাত্র বাইজটাইন সূত্র হলে থিওফানস। তিনি এক শতাব্দী পরে এ বিষয়ে লিখেছেন। কিছু বিবরণে যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল একদিন এবং কিছু বিবরণে কয়েকদিন বলে উল্লেখ রয়েছে।

রাশিদুন সেনাবাহিনী
যুদ্ধসভার সময় মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ খালিদ বিন ওয়ালিদকে কমান্ড প্রদান করেন। তারপর খালিদ সেনাবাহিনীকে ৩৬টি পদাতিক রেজিমেন্ট এবং ৪টি অশ্বারোহী রেজিমেন্টে বিভক্ত করেন ও তার মোবাইল গার্ড বাহিনীকে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। বাহিনীকে তাবিয়া ফর্মে‌শনে সংগঠিত করা হয়। এটি ছিল একটি প্রতিরক্ষামূলক পদাতিক ফর্মে‌শন। বাহিনীর সামনের অংশ পশ্চিমমুখী হয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার ৭.৫ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এর বাম অংশ দক্ষিণে ইয়ারমুক নদীর দিকে ছিল। এই স্থান ছিল ওয়াদি আল শুরু হওয়ার এক মাইল আগে। ডান অংশ ছিল উত্তরে জাবিয়া সড়কের তেল আল জুমার দিকে। সামনে থাকা বাইজেন্টাইনদের ১৩ কিলোমিটার ৮.১ সারির সাথে মিল হওয়ার জন্য অংশগুলোর মধ্যবর্তী ফাকা স্থান। বাহিনীর কেন্দ্রভাগ আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এবং শুরাহবিল ইবনে হাসানার অধীনে ছিল। বাম অংশ ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান এবং ডান অংশ আমর ইবনুল আসের অধীনে রাখা হয়। মধ্য ও বাম এবং ডান অংশকে অশ্বারোহী বাহিনী প্রদান করা হয় যাতে বাইজেন্টাইনরা তাদের পিছু হটালে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মধ্যভাগের পেছনে খালিদের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে মোবাইল গার্ড অবস্থান নেয়। যদি খালিদ বাকি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন তবে সেক্ষেত্রে দিরার ইবনুল আজওয়ার মোবাইল গার্ডের পাওয়ার কথা ছিল। যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে খালিদ তার এই অশ্বারোহী বাহিনীর সফল ব্যবহার করেছেন। বাইজেন্টাইনদের পরযবেক্ষণের জন্য খালিদ বেশ কিছু গুপ্তচর নিয়োগ করেন। ৬৩৬ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে ভাহান জাবালার মাধ্যমে তার খ্রিষ্টান আরব বাহিনীকে আক্রমণের জন্য পাঠিয়েছিলেন তবে মোবাইল গার্ড বাহিনী তাদের প্রতিহত করে। তারপর এক মাস ধরে কোনো সংঘর্ষ হয়নি
অস্ত্র
ব্যবহৃত হেলমেটের মধ্যে সাসানীয় সাম্রাজ্যের রৌপ্য হেলমেটের মত গিল্ড করা হেলমেট ছিল। মুখ ও ঘাড় এবং গলা ধাতব আচ্ছাদনে আবৃত থাকত। ভারী চামড়ার জুতা এবং পাশাপাশি রোমান ধাচের বুট মুসলিম বাহিনীতে ব্যবহৃত হত। বর্মে‌র মধ্যে ছিল চামড়া বা ধাতব বর্ম। পদাতিক সৈনিকরা অশ্বারোহীদের তুলনায় ভারী বর্ম ব্যবহার করত। বড় কাঠের ঢাল ব্যবহৃত হত। পদাতিক সৈনিকদের বর্শা ২.৫ মি ৮.২ ফু দীর্ঘ এবং অশ্বারোহীদের বর্শা ৫.৫ মি ১৮ ফু দীর্ঘ হত। রোমান ক্ষুদ্র গ্লাডিয়াস এবং সাসানীয় দীর্ঘ তলোয়ার উভয় প্রকার তলোয়ার ব্যবহৃত হয়। সাধারণত অশ্বারোহীরা দীর্ঘ তলোয়ার ব্যবহার করত। তলোয়ারের খাপ কাধে ঝোলানো বেল্টে যুক্ত থাকত। ধনুক স্বাভাবিক অবস্থায় ২ মিটার ৬.৬ ফু দীর্ঘ হত যা ইংলিশ লংবোর অনুরূপ। প্রথাগত আরব ধনুকের সর্বো‌চ্চ কার্যকরী পাল্লা ছিল প্রায় ১৫০ মি ৪৯০ ফু। প্রথম যুগের মুসলিম তীরন্দাজরা মূলত পদাতিক হিসেবে কাজ করত। তারা হালকা এবং বর্ম‌হীন অশ্বারোহী আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিলেন।

বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী
মুসলিমরা ইয়ারমুকের সমতল ভূমিতে ক্যাম্প করার কিছু দিন পরে বাইজেন্টাইন বাহিনী এবং হালকাভাবে সজ্জিত অগ্রবর্তী গাসানিরা অগ্রসর হয়ে ওয়াদি উর রুক্কাদের উত্তরে উত্তম প্রতিরক্ষা সম্বলিত ক্যাম্প স্থাপন করেন। বাইজেন্টাইন বাহিনীর ডান অংশ সমভূমির দক্ষিণ প্রান্তে ইয়ারমুক নদীর নিকটে এবং ওয়াদি আল আলান শুরু হওয়ার এক মাইল আগে অবস্থান করছিল। বাম অংশ ছিল উত্তরে জাবিয়া পাহাড় শুরু হওয়ার কিছু দূরত্ব আগে এবং তারা তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান ছিল। ভাহান রাজকীয় বাহিনীকে পূর্ব‌মুখী করে অবস্থান করান এবং তার সামনের অংশ প্রায় ১৩ কিলোমিটার ৮.১ দীর্ঘ ছিল। তিনি দক্ষিণে ইয়ারমুকের গিরিসংকট থেকে উত্তরে মিশরের রোমান পথের মধ্যবর্তী এলাকা সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন খালি স্থানগুলো বিভিন্ন বাইজেন্টাইন ডিভিশনগুলোর মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। ডান অংশ গ্রেগরি ও বাম অংশ কানাটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মধ্যভাগ দাইরজান ও ভাহানের আর্মেনীয় বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল এবং দাইরজান এর সার্বিক নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। রোমান নিয়মিত ভারি অশ্বারোহী, বর্মাচ্ছাদিত ভারী অশ্বারোহীদেরকে চারটি বাহিনীর মধ্যে সমভাবে বন্টন করে দেওয়া হয়। প্রত্যেক বাহিনীতে পদাতিকদের সামনের দিকে এবং অশ্বারোহীদের পেছনের দিকে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। ভাহান ঘোড়া এবং উষ্ট্রারোহী জাবালার খ্রিষ্টান আরবদেরকে লড়াইয়ে পাঠান যাতে মূল বাহিনী আসার আগ পর্যন্ত তাদেরকে আড়াল করে রাখা যায়। প্রথম যুগের মুসলিম সূত্রগুলো অনুযায়ী গ্রেগরির বাহিনীতে পদাতিক সৈনিকদের শেকল দিয়ে যুক্ত করে দেওয়া হয় এবং তারা মৃত্যুর শপথ নেয়। শেকলগুলো প্রতিপক্ষের অশ্বারোহীদের ঠেকানোর জন্যও ব্যবহার করা যেত। তবে আধুনিক ইতিহাসবিদদের অভিমত হল বাইজেন্টাইনরা গ্রেকো রোমান টেসটুডো ফর্মে‌শন ব্যবহার করেছিল। এতে সৈনিকরা কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়ায় এবং ১০ থেকে ২০ জন সৈনিক আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সবদিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ঢাল দেওয়া ঘেরা থাকে এবং প্রত্যেক সৈনিক তার পাশের সৈনিককে সুরক্ষা প্রদান করে।
যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করতো
বাইজেন্টাইন অশ্বারোহীরা স্পেথিওন নামক দীর্ঘ তলোয়ার ব্যবহার করত। আর এর পাশাপাশি ছিল কোনটারিওন নামক হালকা কাঠের বর্শা, ধনুক, ঘোড়ার জিনে বা বেল্টে ঝোলানো তূণীরের ভেতর চল্লিশটি তীর। স্কুটাটোই বলে পরিচিত ভারী পদাতিকরা ছোট তলোয়ার এবং ছোট বর্শা ব্যবহার করত। হালকাভাবে সজ্জিত সৈনিক ও তীরন্দাজরা ছোট বর্ম কাধ থেকে ঝোলানো ধনুক এবং তীর ভর্তি তূণীর ব্যবহার করত। অশ্বারোহীদের বর্ম এবং হেলমেট থাকত। এই হেলমেটে গলার সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। পদাতিকরাও অনুরূপ বর্ম হেলমেট ও পায়ের বর্ম পরিধান করত। হালকা পাত ও ধাতব টুকরার বর্মও ব্যবহার হত।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:২৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×