somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নকলের জমানায় কাঞ্চনমালারাই আসল! - বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকের ৩১ ডিসেম্বর সংখ্যায় '৭১-এর বিজয়িনী, তিন পাকসেনা খতম করলাম, স্বামী তাড়িয়ে দিল নির্যাতিতা বলে_ কাঞ্চনমালা শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে উল্লেখ করে যে বয়ান করা হয়েছে তা এতই বিভ্রান্তিকর, দৃষ্টিকটু ও অসংলগ্ন যা বলার মতো নয়। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মহিমাকে তুলে ধরার বর্তমান প্রয়াস একদিকে যেমন খুবই প্রশংসার তেমনি তা মুক্তিযুদ্ধকে ম্লান করার অপচেষ্টা হিসেবে পর্যবসিত হয়। পাঠকরাই বিচার করবেন। কাঞ্চনমালার বাপের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ দেশের মধ্যস্থলে হলেও নেত্রকোনা দুর্গাপুর একেবারে উত্তর সীমান্তে। কাঞ্চনমালা শুরুতেই লিখেছেন বা বলেছেন, "তাড়াহুড়া করে লঞ্চ রিজার্ভ করে রাতেই মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হই। ফিরে দেখি পরিস্থিতি আসলে কোথাও ভালো নয়। চারদিকে গুজব, পাকিস্তানিরা আক্রমণ করবে। সেদিন ছিল ২৫ মার্চ। বিকেলে প্রায় ৩টার মতো। আমরা খেতে বসেছি। জা বলল, রান্নাঘর থেকে ডালের ডেকচিটা নিয়ে এসো। ডেকচি আনতে যেতেই বড় জা'র চিৎকার, ওই বাড়িতে মিলিটারি আসছে। পালা, পালা...। মুহূর্তের মধ্যে যে যার মতো পালিয়ে গেল। আমি পারলাম না। আমি এক দৌড়ে বড় ভাসুরের কক্ষে লুকাই। দেখি আমাদের বাড়িতে ঢুকে ওরা বলছে, এই বাড়ির পুরুষ লোক কোথায়? মনে মনে ভাবলাম আমাকে তো নিয়ে যাবে। তখন তো মরব। তাই খেজুর গাছ কাটার দা'টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা যখন ঘরে ঢুকে উঁকি দিচ্ছে তখন গর্দানে কোপ দিলাম। এভাবে তিনজনকে ফেলার পর মেজর এসে দেখল। বলল, তোরা সর, যা গা। এরপর সে আমার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরি ক্যাম্পে। একটি কক্ষে আটকে রেখে তালা দিয়ে চলে গেল। ভয়ে আধমরা হয়ে যাই। কক্ষের ভেতরে সুন্দর একটি খাট, সেখানে ওই মেজর থাকত। তার নাম জাহিদ, ব্যাজ দেখে বুঝলাম।'

আপাতত এটুকু নিয়েই আলোচনা করি। নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চনমালা লঞ্চ রিজার্ভ করে মুন্সীগঞ্জে গেলেন। কোথা থেকে গেলেন? তার শ্বশুর বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। মুন্সীগঞ্জ যেমন ঢাকার দক্ষিণে, দুর্গাপুর তেমনি ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার উত্তরে। কথাটা এখনকার নয়। আজ থেকে ৪০ বছর আগের। তখন তেমন কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। দুর্গাপুর থেকে জারিয়া-জাঙ্গাইল, সেখান থেকে নেত্রকোনা তারপর ময়মনসিংহ, তারপর ঢাকা। ট্রেনে এলে আড়াইশ' কিলোমিটার। আর নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা এলে ৪০০ কিলোমিটার। কারণ তখন ঢাকা-ময়মনসিংহ রাস্তা ছিল না। ঢাকা-ময়মনসিংহের রাস্তা হয়েছে ১৯৮৬ সালে। কাঞ্চনমালার ঘটনা হচ্ছে ২৫ মার্চ দুপুরের। উনি খুব সম্ভব ২৪ মার্চ রাতে মুন্সীগঞ্জ পেঁৗছেন। কোথা থেকে, ঢাকা থেকে না দুর্গাপুর থেকে? ঢাকা থেকে তখন লঞ্চ চলত। কিন্তু দুর্গাপুর থেকে কোনোদিনই লঞ্চ চলে না। সেই '৭১-এও না, এখনো না। পাহাড়ি ঢল ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। সে যাই হোক। সবসময়ই গাজার নৌকা পাহাড় দিয়েই চলে। এ ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে।

১। উনি উপরে যা বলেছেন তা ২৫ মার্চ বেলা ৩টার ঘটনা। তারা খেতে বসেছিলেন, ওই সময় মুন্সীগঞ্জের বাড়িতে মিলিটারিরা আসে। উনি গিয়ে ভাসুরের ঘরে লুকান। তার ভাসুরের ঘরতো মুন্সীগঞ্জ হওয়ার কথা নয়। কারণ ওটাতো বাপের বাড়ি। সেখানে ভাইয়ের ঘর হতে পারে। কোনো বোনজামাই যদি শ্বশুর বাড়ি ঘরজামাই থাকে তাহলে সেটা বোনজামাই'র ঘর হতে পারে। ভাসুরের ঘরতো হবে শ্বশুর বাড়িতে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। তাহলে ওটা সঠিক নয়, শুরুটাই বিভ্রান্তিকর।

২। ২৫ মার্চ বেলা ৩টায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর গণহত্যায় জড়িত হওয়ার সুযোগ ছিল না। মুন্সীগঞ্জ তো দূরের কথা ঢাকা শহরেও হানাদার বাহিনী বেরুতে পারেনি বা বের হয়নি। হানাদাররা ঢাকা শহরের রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি- এসবের উপরে আক্রমণ চালিয়েছে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর। মুন্সীগঞ্জের উনি এত সৌভাগ্যবান যে, ২৫ মার্চ দুপুরে উনার বাড়িতে আক্রমণ হলো? এটি কেমন কথা? সারা দুনিয়ার দলিল-দস্তাবেজ দেখলে তো এর কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ ২৫ মার্চের পরও অনেক দিন পর্যন্ত জলে ডোবা মুন্সীগঞ্জে পাকিস্তান হানাদাররা যায়নি বা যেতে সাহস করেনি। ৩ এপ্রিল শুধু বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় কয়েক হাজার মানুষকে গুলি করে এবং পুড়িয়ে মেরেছিল। এতো দেখছি কাঞ্চনমালা এখানে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

৩। এবার আসুন তিনি ছুটে গিয়ে ভাসুরের ঘরে লুকালেন। তার মনে হলো তাকে ধরে নিয়ে যাবে এবং তাকে মেরে ফেলবে। তাই মরার আগে মারা দরকার। উনি খেজুর গাছ কাটা দা দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালেন। পাকিস্তানি হানাদাররা যখন ঘরে উঁকি দিল একজনের গর্দান কেটে ফেললেন। তারপর আরেকজন, এমনি করে তিনজন। পরে মেজর এসে দেখল। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি তাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নেত্রকোনার বিরিশিরি ক্যাম্পে নিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখলেন। ভয়ে তিনি আধমরা। কক্ষের ভেতরে একটি সুন্দর খাট। ২৫ মার্চ দুপুর ৩টায় উনি দা-এর কোপে তিনজন আর্মির গর্দান কেটেছিলেন মুন্সীগঞ্জে। আর মেজর তাকে নিয়ে গেল নেত্রকোনার বিরিশিরি ক্যাম্পে। ঘটনা ঘটল মুন্সীগঞ্জ, নিয়ে গেল নেত্রকোনা। মুন্সীগঞ্জ থেকে বিরিশিরি প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে। কি তেলেসমাতি কারবার, সিনেমার মতো, ছিলেন মুন্সীগঞ্জ গেলেন বিরিশিরি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসই রণাঙ্গনে ছিলাম। তিনটা আর্মিকে দায়ের কোপে গর্দান কাটা যায়_ যা জীবনে কল্পনাও করতে পারিনি। যাত্রার মঞ্চে অভিনয়ে ওরকম গর্দান কাটা সম্ভব হলেও মিলিটারিদের গর্দান কাটা অত সহজ ছিল না। যাক সে কথা। উনি না হয় গর্দান কাটলেন। কিন্তু উনাকে মুন্সীগঞ্জ থেকে বিরিশিরি নিলেন কিভাবে? তাও আবার ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি হানাদারদের যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে বেরুবার কোনো পথই ছিল না।

৪। নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি জারিয়া-জাঞ্জাইল নদীর উত্তর পাড়ে। স্বাধীনতার আগে কখনো সেখানে কোনো জিপ গাড়ি যায়নি। স্বাধীনতার পরেও ৩-৪ বছর গাড়ি চলাচলের কোনো রাস্তা ছিল না। আর সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জারিয়া-জাঞ্জাইল-বিরিশিরি-দুর্গাপুর পর্যন্ত এক-দুইবার যাও গেছে তাও সেই জুলাই-আগস্টের পরে। উনি ২৫ মার্চ কিভাবে বিরিশিরিতে পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্প বানালেন? বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার! আর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মেজর ৫টায় আমের হালির মতো অথবা আগেকার দিনে কোনো কোনো সময় বিল-বাদাড়ে যেমন মাছ গাবায় তেমনি পাকিস্তানি মেজর গাবানোর উপায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি যতটা জানি তাতে পাকিস্তানি কোনো মেজর, কর্নেল এমনকি ক্যাপ্টেনরা সীমান্তের অতটা কাছাকাছি কখনো যায়নি বা যাওয়ার সাহস করেনি। রেকর্ড দেখলে দেখা যাবে বিরিশিরিতে পাকিস্তানি কোনো মেজর কোনো রাতই কাটায়নি।

মেজরকে নিয়ে উনি অনেক কথা বলেছেন। মেজরের ঘরে বাঙালি মেয়ের ছবি দেখেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করেছেন। উনার ইচ্ছা হয়েছে উনি করেছেন। আমার তাতে বলার কী আছে। আমার কাছে মান-ইজ্জতের মূল্য অন্যরকম। আমি ওভাবে কোনো জিনিসকে কখনো ভাবিনি, এখনো ভাবি না। আমার কাছে মান-সম্মান, ইজ্জত জীবনের চেয়ে প্রিয় বা বড়। মেজরের সঙ্গে খাতির হলে তিনি নাকি বাইরে বেড়াতে যেতে চান। মেজর তাকে সে সুযোগও দেন। উনি বাইরে বেড়াতে গেলে তখন তার পেছনে গার্ড থাকত। একদিন ১০-১২ জন গার্ড দেখে তার মাথায় রাগ উঠে। তার লেখা থেকে 'তৃতীয় দিন বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছি। দেখি ১০-১২ জন আমার পেছনে গার্ড দিচ্ছে। মাথায় রাগ উঠে গেল। বাঁশ দিয়ে একজনকে এমন জোরে বাড়ি মারলাম সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল। মেজর আমাকে ধরে এনে অনেক মারল। এরপর আমার পেটে একটি গুলি করল। মরে গেছি মনে করে ফেলে দিল বিরিশিরি নদীর কাছে। সেখানে অনেক লাশ ছিল। জোয়ার আসার পর সব ভেসে যায়। আমাকে নদীর কিনার থেকে এক হিন্দু বুড়ি উদ্ধার করেন। তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে বুড়িকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল।"

দেখেন কায় কারবার! প্রথমে খেজুর গাছ কাটার দা দিয়ে তিনজনের গর্দান কেটেছেন। এখন বাঁশের লাঠির এক বাড়িতে একজনকে মেরে ফেললেন। গামা পালোয়ানের নাম শুনেছিলাম। তিনিও হয়তো বাঁশের লাঠির এক আঘাতে কাউকে মেরে ফেলতে পারতেন কি না বলতে পারব না। তবে আমার এক পূর্ব পুরুষ গজবল খাঁ তার সেকালের ভারী পিতলের বদনা দিয়ে হাতির মাথায় আঘাত করে হাতির মাথা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিলেন বলে শুনেছিলাম। মেজর তাকে অনেক মারধর করে পেটের মধ্যে একটি গুলি করে। মরে গেছেন ভেবে তাকে নিয়ে বিরিশিরি নদীর কাছে ফেলে রাখে। কোনো মানুষ মরেছে না জীবিত আছে এটা বুঝা কঠিন নয়। আর বিরিশিরি নদীতে জোয়ার-ভাটা আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ পাহাড়ি এলাকার ওই অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার কোনো সুযোগ নেই। তবু তিনি যখন বলেছেন হয়তো তিনি জোয়ার-ভাটা দেখেছেন, তাই বলেছেন। সেখান থেকে এক হিন্দু বুড়ি তাকে উদ্ধার করে। যার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গৃহবন্দি করে রেখেছিল। গৃহবন্দি করে রাখলে তিনি তাকে উদ্ধার করলেন কিভাবে? আর পাকিস্তানিদের কাছে ওই সময় গৃহবন্দি-টন্দির কোনো ব্যাপার ছিল না। কাউকে পেলে একবার গুলি চালিয়ে উড়িয়ে দিত। আর সীমান্ত এলাকায় কোনো হিন্দু ওই সময় বাংলাদেশের সীমানায় ছিল না। আবার তার কথা থেকে বলি,

"তখন আমার সারা শরীরে অত্যাচারের দাগ। অনেকটা আধমরা। ওই বাড়িতে দুইদিন ছিলাম। ওদের সেবায় সুস্থ হলাম। তিনদিন পর রাতে বুড়ির ছেলেকে নিয়ে শিবগঞ্জ বাজারের দিকে লুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভবানীপুর ক্যাম্পে গিয়ে উঠি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে দেখে বলেন, এটা তো বাঁচব না। তারপরও তারা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তাদের বললাম, আমাকে অস্ত্র চালানো শিখান, মুক্তিযুদ্ধে যাব। তারা বললেন, মহিলা মানুষ, কী যুদ্ধ করবেন? আমি বললাম, আমি তো চারটা মাইরাই আইছি। এক যুদ্ধ তো কইরাই আইছি। আপনারা দেইখেন, আমি ট্রেনিং নিয়া যুদ্ধ কইরা আপনাদের সামনে আসব। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় আমি ভারত যাই। সেখানে বাগমারায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কাদের সিদ্দিকীর বোন রহিমা সিদ্দিকীর কাছে প্রশিক্ষণ নেই। তিনি আমাকে এলএমজি ও গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।"

এ কি মারাত্মক মিথ্যা কথা! মাগমারা মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার একটা মহকুমা। মজার ব্যাপার হলো, আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী যেমন আমাদের রাজনৈতিক গুরু তেমন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে আসাম, মেঘালয় হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। '৭৫-এর পর আমি বাগমারা চিনলেও বড় ভাই বর্তমান মাননীয় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এখনো বাগমারা যাননি বা দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধে আমার ভাই-বোনেরা বিশেষ করে রহিমা, শুশুমা, শাহানা, আজাদ, মুরাদ মন্নু বাংলাদেশের সীমানা পার হয়নি। রহিমা কোনোদিন মেঘালয় যায়নি। মেঘালয়ের কথা ছেড়েই দিলাম। রহিমা, শুশুমা কোনো মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একদিনও কাটায়নি। এলএমজি ও গ্রেনেড ছোড়া দূরের কথা সে নিজে কোনো ট্রেনিং নেয়নি, অন্য কাউকেও ট্রেনিং দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যুদ্ধের সময় আমার মা-বাবা, ভাই-বোন যখন আবু সাঈদ চৌধুরীর সখীপুরের শুরীরচালা খামার বাড়িতে ছিল তখন ওরা ওইসব অস্ত্রশস্ত্র হাতাহাতি করেছে। আমার বোনেরা মুক্তিযুযোদ্ধা কিনা একথা কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলব, নিশ্চয়ই ওরা শ্রেষ্ঠ নারী মুক্তিযোদ্ধা। প্রশ্ন আসতে পারে কেন, কিভাবে? সোজা উত্তর- কবি রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, মাহাবুব সাদিক, সাজ্জাদ কাদির, অধ্যাপক আতোয়ার রহমান, ঢাকা কলেজের অধ্যাপক শরীফ আহমেদ, আনোয়ারুল আলম শহীদ, ফারুক আহমেদ, সোহরাব আলী খান আরজু এরা সবাই হেড কোয়ার্টারে ছিল। তারা কেউ কখনো একটা গুলিও ছুড়েনি। রণাঙ্গনে পত্রিকা সম্পাদনা করেছে, লেখালেখি করেছে। কাদেরিয়া বাহিনী পরিচালনায় আমার কাছ থেকে পাওয়া আদেশ-নির্দেশ যথযথভাবে যখন যেখানে পৌঁছানো বা পাঠানোর দায়িত্ব যথাযথ যোগ্যতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছে। রহিমা, শুশুমা রণাঙ্গনের প্রতিটি সংখ্যার জন্য লেখা দিয়েছে। হাতে লিখে যে রণাঙ্গন ছাপা হতো সেই লেখা তৈরি করেছে। প্রচার বিভাগে যখন যে কাজের প্রয়োজন হয়েছে সে কাজ করেছে।

ইদানীং যা দেখে বড় বিস্ময় জাগে। তা হলো_ সব মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে মেশিনগান, রাইফেল, ট্যাংক, কামান চালাতেই হবে। সে নারী-পুরুষ যে-ই হোক না কেন! এ জিনিসটা এখন যারা লেখালেখি করেন তাদেরই কিছুটা সৃষ্টি। আদতে তেমন হওয়ার কথা নয়। সেনাবাহিনীর সবাই যুদ্ধ করে না। তবু তারা যোদ্ধা এবং বড় বড় যুদ্ধে তাদের অনেক অবদানের নজির রয়েছে। সৈন্যদলে গাড়ির চালক থাকে, রান্না করার বাবুর্চি থাকে, কাপড় ধোয়ার ধোপা থাকে, চুল কাটার নাপিত থাকে, চিকিৎসা করার ডাক্তার থাকে, খাট-পালং ঠিক করার সুতার থাকে, অস্ত্রশস্ত্র-যন্ত্রপাতি সারার মেকার থাকে। তারা কেউ যুদ্ধ করে না। যারা ভাত রাঁধে, কাপড় ধোয়, চুল কাটে এরা কোনোদিন গুলিও ছোড়ে না। প্রথম প্রথম ট্রেনিংয়ের সময় হয়তো কোনো ফায়ারিং বা'টে পাঁচ-দশ রাউন্ড গুলি ছুড়ে। একটা যোদ্ধা বাহিনীর জন্য এরা অবশ্যম্ভাবী। সকালে নাস্তা না হলে, দুপুরের খাবার না পেলে যুদ্ধের সাধ একদিনেই মিটে যায়। তাই কাউকে বাদ দিয়ে কেউ নয়। যুদ্ধ বিমানের পাইলট গুলি ছুড়লেও ট্যাংকের চালক গুলি ছুড়ে না। সে ট্যাংক চালায়, আলাদা গানার কামান দাগে, মেশিনগান চালায়। তাই নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেই তাকে ক্যাম্পে থাকতে হবে, গুলি চালাতে হবে, মেশিনগান ব্যবহার করতে হবে এগুলো ভালো কথা নয়। ক্যাম্পে থেকে নারী-মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ করার সামাজিক পরিবেশ '৭১-এ ছিল না। বর্তমানে ডিস এবং চ্যানেলের কল্যাণে সমাজব্যবস্থা প্রায় তছনছ হয়ে গেছে। তারপরও ছেলে-মেয়েরা একত্র থাকলে বাংলাদেশে এখনো কোনো বড় সংগ্রামে সাফল্য সম্ভব নয়। কারণ আমাদের সমাজ, আমাদের আবহাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। এটি ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া কিংবা কিউবাও নয়, চীন তো নয়ই। তাই সব নারীযোদ্ধার হাতে রাইফেল, মেশিনগান না দেওয়াই ভালো। যে মেয়েরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিয়ত ভাত রেঁধে দিয়েছেন, তাতেই তাদের নারীমুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া যেতে পারে এবং তা দেওয়াই উচিত। শ্রদ্ধেয় নেত্রী সাজেদা চৌধুরী, তাকে যদি আজকে কোনো রণাঙ্গনে নিয়ে যুদ্ধ করিয়ে নারীমুক্তিযোদ্ধা বানাতে চান তাহলে সেটি খুবই গর্হিত কাজ হবে। তিনি সপরিবারে মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশ ছেড়েছিলেন। প্রবাসে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, যুদ্ধের জন্য জনমত সৃষ্টি করেছেন। তারপর আর তার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে গ্রেনেড, বোমা মারার প্রয়োজন পড়ে না।

১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার মাকড়াইয়ে আমার হাতে-পায়ে গুলি লেগেছিল, চাম্বলতলা তুলা তালুকদারের বাড়িতে তার যে ভাই বউ শাড়ি ছিঁড়ে আমার ক্ষতস্থান বেঁধেছিল_ সে যদি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করে অস্বীকার করার কোনো পথ আছে? না, নেই। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দিনের পর দিন যারা সেবা করেছে, তারা কি? তারাই তো প্রকৃত নারীযোদ্ধা।

আমি বুঝতে পারলাম না কাঞ্চনমালা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য এসব করতে গেলেন কেন? কাদেরিয়া বাহিনী এবং আমার পরিবার নিয়ে কেন এ টানাটানি? তিনি বলেছেন, "প্রায় দেড় মাস ট্রেনিং নেই। দুই মাস বারো দিন পর দেশে এসে বীর প্রতীক ফজলুল হকের কাছে যাই। তিনি টাংগাইলের ঘাটাইল থানায় কাদেরিয়া বাহিনীর আন্ডারে ছিলেন।" হায় কপাল! বীরপ্রতীক ফজলুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় ছায়ার মতো আমার পাশে ছিলেন। কোনোদিন এক ঘণ্টার জন্য কোথাও যাননি বা যেতে পারেননি। সেই ফজলুর হকের কাছে কবে এলো, কবে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। কোথায় মুন্সীগঞ্জ, কোথায় দুর্গাপুর, কোথায় বাগমারা। এ তো দেখছি তিনি সারা দেশ বাতাসে ঘুরেছেন। তিনি বলেছেন, "প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমার একটা জিদ আসে। অগো মাইরা ফেলতে পারলে দেশটা তাড়াতাড়ি স্বাধীন অইবো। অস্ত্র চালানোর বিষয়ে কাদের ভাই বলতেন, 'ওই ছেরি জোরে চালা।' এতে আমি বেশ সাহস পাইতাম মনে। বেশ কিছু অপারেশনে অংশ নেই। এ সময় আমাদের খাকি প্যান্ট, গেঞ্জি পরতে হতো। তখন ১৫-২০ বার অপারেশন করেছি। অপারেশনে গিয়ে আমাদের লিডার কাদের সিদ্দিকী ও ফজলু ভাইয়ের সাহসের কথা ভুলতে পারিনি।"

অনেকদিন বেঁচে আছি, তাই এই বিড়ম্বনা। না হলে কেন শুনব, 'অস্ত্র চালানোর বিষয় কাদের ভাই বলতেন, ওই ছেরি জোরে চালা।' ছিঃ ছিঃ, একটি জাতীয় পত্রিকায় কোথাকার কি এক মহিলার নাম দিয়ে 'ওই ছেরি জোরে চালা' তাও দেখতে হলো! আমার পরিবারে এরকম অরুচিকর কথা বলার রীতি নেই। আমাদের সামাজিক ও পরিবারিক ঐতিহ্য অমন অরুচিকর নয়। আমার পারিবারিক ঐতিহ্য অমন ভাষা অনুমোদন করে না। এখন মা-বাবা বেঁচে থাকলে লজ্জায় মরে যেতাম। আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে নিদারুণ কষ্টে পড়তে হয়েছে। 'ওই ছেরি জোরে চালা' ছিঃ ছিঃ অমন কথা আমাদের পরিবারের কেউ কখনো বলেছে? না, কখনো না। এমনিতেই আমি ছেলেবেলা থেকে লাজুক। হালকা আলাপ করার জায়গা আমার তখনো ছিল না, এখনো নেই। খাকি প্যান্ট, গেঞ্জি গায়ে পরে আমরা যুদ্ধ করিনি। অপারেশনে গিয়ে সে আমার আর ফজলুর সাহসের কথা ভুলতে পারেননি। এখন যাই হোক- তখন আমার সঙ্গে কাউকে তুলনা করা হতো না। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে একমাত্র হাজেরা সুলতানা ছাড়া সশস্ত্র কোনো নারীযোদ্ধা ছিল না। এ লেখাটি আমার কোনো প্রতিবাদ নয়। এ লেখাটি আমার নিজের উপরেই নিজের ধিক্কার। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এ এক মহা কালিমা নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চনমালার। তার স্বামীর সঙ্গে বনিবনার অভাব নিয়ে কত কথার মালা গেঁথেছেন, জাল বুনেছেন, এক্ষেত্রে কাগজে কোনো জায়গার অভাব হয়নি। তাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে স্বামী মারতে চেয়েছে, ব্লেড দিয়ে কাটতে চেয়েছে, স্বর্ণালংকার কেড়ে নিয়েছে, আওয়ামী লীগ করা ভাসুর সহায়তা করেছে বলে স্বামী তার নামে নিন্দা করেছে, পরিশেষে চার সন্তান ফেলে সে বাপের বাড়ি চলে গেছে। তার আক্ষেপ, দা'য়ের কোপে তিন পাকসেনা খতম করলেও স্বামীর ঘরে ঠাঁই হলো না। তিনি পাকসেনা খতম করতেই পারেন। পাকসেনা আর হানাদার তো এক কথা নয়। আমরা কোনো পাকসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করিনি। আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছি। কাঞ্চনমালার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের গেজেট নম্বর দেওয়া হয়েছে, মুক্তিবার্তা নম্বর দেওয়া হয়েছে। হতেই পারে। আজ আসল আর নকলের এই ছড়াছড়ির জমানায় কাঞ্চনমালারাই আসল। বেঁচে থেকেও আমি হয়তো নকল। কারণ তার কাছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সনদপত্র আছে, যা আমার নেই।
তথ্য সূত্র
_________________________________________________

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৩২
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×