কোথায় যাবে তুমি? নিজেরে ছায়ারা প্রশ্ন করে। এদের ঠেকিয়ে রাখা সহজ নয়, যতটানা সহজ প্রিয়জনদের। শূণ্যতারা যখন মগ্ন নিজেতে তখন নির্জনে খুব কাছের বন্ধু এসে শুধায়, সত্যি তুই হারাবি? আমি মুচকি হাসি। প্রতিনিয়তই ঠকাচ্ছি নিজেকে, হয়তোবা মানুষকেও। অথচ এটুকুই আমার প্রাপ্তির সীমানা। ২৩টা বছর... ২৩টা বছর... পার করে দিলাম ছেলেমানুষীতে। অবুঝ স্বপ্নেরা আমার, খুব বেশি সরল ছিলো। সবুজ ছিলো। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে ঠিক ঠিক নিয়ে যেতো কোনো ধূলো উড়ানো বিস্তৃর্ন খোলঅ প্রান্তরে। কুসুম রঙের সূর্য্যকে পেছনে ফেলে একটা ছোট্ট দুষ্ট ছেলে বাড়ি ফিরছে। হয়তো সমবয়সী কাউকে তাড়া করছে... হয়তো খিলখিল হাসতে হাসতে সবুজ ফসলের আল ধরে ছুটছে, হয়তোবা বালিহাঁস ধরার জেত ধরে ডুবছে দিঘীর ঘন কালো জলে...। বাচ্চাটা একটু স্বপ্নিল ছিলো। কখনো কখনো দুষ্টুমী ছেড়েছুঁড়ে অনেক দূরের রেললাইনটায় এসে চুপচাপ বসে থাকতো, একমনে কিসব ভাবতো। কখনো রেল লাইনে কান ঠেকিয়ে কিযেন শুনার অপেক্ষায় থাকতো, কখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে সীমানার ওপারের অদ্ভুত কিছু দেখার প্রতীক্ষা করতো। স্বপ্নিল সেই ছেলেটা আজ এসিড নগরীতে এসে বদলে গেছে খুব। সবুজের বন্ধুরা বলে, তুই বড় বদলে গেছিস। তোর বুকের ভেতরের খিলখিল শব্দেরা এখন আর হাসে না!
এতোগুলো বছর পর আজ ছোট্ট পাহাড়ি ছরাটার কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে থাকি স্তব্ধ হয়ে। পানির স্বচ্ছতা... গভিরতা... স্রোত... গন্ধ... আবেগ... কুলকুল ধ্বনি সেই আগের মতোই আছে। আছে আগের সেই বন্য পাহাড়ি ছায়ানীল আমেজ, আছে নানা রঙের বোনো ফুল আর পাখির সাতরঙি গান, আছে মাটির মানুষগুলোর মুখোরিত পথচলা। খেয়াল করে দেখি... সেই সবুজ আটপোড়ে আমিটা নেই। এখন হু হা করে ভাবের টলমলে জলে জোয়ার ওঠে না, ভাটা পড়ে না, ইচ্ছেমতো স্বপ্নেরা উড়ায় না রঙিন ফানুস। অধরে কেবল টুকরো তৃক্ত যাযাবর হাসি, মুছে দিচ্ছে সুখস্মৃতি, ধীরে ধীরে...।
এক বুড়ো 'ডেফোডিল' পড়াতে পড়াতে কেবলই চারটা লাইন রিপিট করতো...
I gazed and gazed but little thought
What wealth the show to me had brought:
কেনো 'ডেফোডিল' বুড়োটা বার বার পড়াতো তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। বুড়োটা হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। মানুষ হারায়, ছায়া হারায় না। বুড়োটাকে মনে পড়ে খুব। মনে পড়ে যাদের হারিয়েছি, একে একে। বুড়োকে যেমন ভালোবেসেছি তেমনই ভালো অন্যদেরও বেসেছি। এখানে এই মেঠো পথে এলে মাথার ভেতরে ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ তুলে স্মৃতিরা বিস্মৃতির আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে, লাগামহীন। সামনেই ছায়াঘেরা সেই মেঠো পথ। আমার প্রথম ভালোবাসা। পথের পাশে জাম গাছের আড়ালে একটা শ্যামল মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত আবেশ চোখেতে নিয়ে। সময় থমকে দাঁড়ায় দ্রুত। বুকের ভেতরের ঢ্রিম ঢ্রিম শব্দের মাতনে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। আমি এগিয়ে যেতে থাকি বিস্ময় সাথে নিয়ে। মাথার ভেতরে আবার বিস্মৃতির খেলা। নেমে আসে ঝিরঝিরে অন্ধকার। মাথা ঝাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই। মনে পড়ে রিনিঝিনি নুপুরের কথা। মনে পড়ে বাতাবি নেবুর কথা। মনে পড়ে শুকনো রক্তের কথা, জমে ছিলো আধ-ময়লা কোনো কাগজের ভাঁজে। মাঝে মাঝে বয়সটাকে অভিশপ্ত মনে হয়। মনে হয় অভিশপ্ত ঘাড়ে চেপে বসা দায়িত্বটাকেও। কখনো কখনো বুকের ভেতর চেপে বসা গভীর ঘন দীর্ঘশ্বাসটাকে মুক্তি দিয়ে দেশান্তরী হতে ইচ্ছে করে, খুব। পারিনা। একজনের স্বপ্ন পাঁচজনের চেয়ে অনেক কমজোরি আর কম দামি। তাই হেরে যাই প্রায়শই। খুব খুব ঈশ্বরকে ডাকতে ইচ্ছে হয় তখন। অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে অনিশ্চিত এই স্রষ্টার নিকট, হায় ঈশ্বর, আমার প্রচুর ঈর্ষা আর প্রচুর আত্ম-সম্মানবোধ। এ দুটোকে ধ্বংস করে দাও! এ দুটো থাকলে আমি কখনোই উঠতে পারবো না...!
জীবনটা গন্ধহীন শুকনো ঝরাপাতা। প্রয়োজন ফুরালে তুমি মূল্যহীন। কিংবা এমনো হতে পারে প্রয়োজনেই তুমি মূল্যহীন! প্রয়োজন তোমাকে মূল্যহীন করেছে। বসে ভাবি নির্জনে, অনেক হয়েছে, এবার সময় হয়েছে হারিয়ে যাবার। আবার সেই ঝাপসা ঝিরঝিরে একরঙি সংঘর্ষ, চোখের পর নেমে আসে রাঙা আঁধার হয়ে। গুটগুট অন্ধকার, চারপাশে। কিছু দেখি না মনে... চোখে... কেবল রিনিঝিনি সুর লাহরী। ভেসে যাচ্ছে নোনা জল হয়ে। আমি মৌন হয়ে শুনতে থাকি, নির্লজ্জ্ব প্রতীক্ষায়... শেষ বারের মতো তাকে দেখবো বলে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০০৭ বিকাল ৪:৫৮