মাতৃবিয়োগ
মাজেদুল মূর্শেদ
এই কারনেই ডাক্তার হবার কোন ইচ্ছায় তার ছিল না। আজ আবার এই কথাটা ভাবলেন হবু ডাক্তার ইনছান। ছোট বেলা থেকেই ইনছান লেখা-পড়াতে ছিলেন চৌকশ, মানে সকল বিষয়ে সমান পারদর্শী। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় জীবনে প্রথম জীবনের লক্ষ রচনাটা পড়তে গিয়ে বইয়ে জীবনের লক্ষ ডাক্তার লেখা দেখে- তার বেশ রাগ হয়েছিল। কিন্তু, তার কোন বইয়েই জীবনের লক্ষ্য অন্য কিছু লেখা না পাওয়াই অনেক রাগের পরেও- পরীক্ষায় জীবনের লক্ষ ডাক্তার লিখেই ২০ মধ্যে ১৮ পেয়েছিলেন।
তিনি যখন আর একটু বড় হলেন, মানে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে উঠলেন, তখন বুঝলেন বইয়ের ঐ কল্পনার ডাক্তারের ইচ্ছাগুলো, অর্থাৎ- ডাক্তার হবো, গ্রামে যাবো, প্রায় ফ্রি চিকিৎসা করব, ছোট্ট ঔষধের দোকান দেব, ঔষধেত লাভ করবই না, পারলে মাগনা দেব। এগুলোর সবই কথার কথা।
শুধু ডাক্তার হবো ছাড়া, আসল সত্যটার পুরোটাই ঠিক এর উল্টো। মানে, ছোট শহরে থাকলে আরো বড় শহরে যাব, পারলে বিদেশ যাবো, ভালো মানের ভিজিট ফি নেব। কেননা- ভাল ডাক্তার হয়েও রোগীদের অল্প ভিজিটে চিকিৎসা করলে ভাল ডাক্তারের নেমপ্লেট পাওয়া যায় না। রোগীরাও ভাবে ৫০০ টাকার জিনিসের সাথে কি আর ৫০ টাকার জিনিসের তুলনা হয়। কাজেই তারা কমদামী ডাক্তার বাদ দিয়ে বেশী দামি ডাক্তারের কাছেই লাইন ধরে। বড় ক্লিনিক বানাবো। এরপর বিলের কথা! থাকনা, কি হবে এসব বলে ? কাজেই ইনসানের ডাক্তার হবার ইচ্ছাটা শূণ্য থেকে ধনাত্বক দিকেত গেলোই না, বরঞ্চ আর একটু ঋনাত্বক দিকে চলে গেল।
নবম শ্রেণীতে উঠে ভাবলেন জীব বিজ্ঞান সাবজেক্টটাই নেবেন না, কিন্তু মায়ের কথায় তিনি তা করতে পারলেন না। উচ্চ মাধ্যমিকেও একই অবস্থা। বেশ ভালভাবেই তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সঠিক রেজাল্টটা না জানলেও উভয় পরীক্ষাতেই যে তিনি জীববিজ্ঞান সহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়েছিলেন তা আমি জানি।
এরপর মায়ের ইচ্ছানুসারে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বাড়েই ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলেন। ছোট বেলা থেকেই কোন দিনই তিনি মায়ের অবাদ্ধ হননি, এবারও হলেন না, মাকে তিনি বড়ই ভালবাসেন, তাই মেডিকেলেই পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ও প্যাচাল পারতে পারতে মূল ধারার বাইরে চলে এসেছি, এবার আবার আজকের বিষয়টাতে ফিরে আসি। ডাক্তারী পড়তে এসে আজকে প্রথম দিনেই তিনি একজনকে মারা যেতে দেখলেন। তিনি শুনলেন শুধুমাত্র একটি, একটি ইনজেকশন দিলেই হয়ত মানুষটিকে বাচানো যেত, কিন্তু ইনজেকশনটির দাম ৯২০ টাকা, যা রোগীটির গরীব আত্বীয়-স্বজনদের পক্ষে যোগার করা সম্ভব হয়নি। ঔষধটির উপাদানের নামগুলোর সাথে আগে থেকেই ইনছান পরিচিত। ২০ গ্রামের ঐ ঔষধটিতে উপাদান খরচ যে ২০০ টাকাও পড়বে না তা তিনি ভালভাবেই জানেন। আবার, প্যাকেট, সিরিঞ্জ, পানি দিয়ে যে ঔষধটির দাম ৩০০ টাকাও পরবে না, তাও তিনি বোঝেন। আর শতকরা ১০০ ভাগ লাভ রেখেও যদি- আমাদের স্বদেশী ঔষধ কোম্পানীটি ঔষধটির দাম ৬০০ টাকা করত তবুও হইত রোগীর আত্বীয়রা টাকাটা যোগার করতে পারতো। কিন্তু, এই ৬০০ টাকার সাথে আরো ২০০ টাকা যোগ হয় ঔষধটির প্রচারে, অর্থাৎ ডাক্তার এবং অন্যান্যদের জন্য অন্য রকম ঘুষ, মানে ঔষধ কোম্পনীর কলম, প্যাড, ক্যালেন্ডার, ডায়রি সহ অনান্য উপহার সামগ্রীর খরচ বাবদ। আচ্ছা এই ৮০০ টাকাও না হয় কোনমতে রোগীর আত্বীয়রা যোগার করতে পারল। তবুও এর উপর আছে মরার পরে খাড়ার ঘা, মানে ট্যাক্স। নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া নাকি আমাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু, অসুন্থ মানুষ কিভাবে অধিকার আদায়ের জন্য দেশপ্রেমিক বিরোধীদলগুলোর মতন হরতালের তাল তুলবে। সেতো ঔষধ সরকারের কাছ থেকে পাবেই না, বরঞ্চ তাকে আরো ট্যাক্স দিয়ে ইনজেকশনটাকে ৯২০ টাকা দিয়ে কিনতে হবে। আচ্ছা এই ৯২০ টাকাও না হয় রোগীর আত্বীয়রা কোন মতে যোগার করল। (ও সরি, আগের লাইনটা বাদ যাবে, এই ৯২০ টাকা যোগার করার আগেইত রোগীটা মারা গেছে। আবার লাইনচূত, ইনছানের ভাবনাই ফিরে আসি)
ইনছান ভাবলেন, ঔষধেও ভ্যাট। আচ্ছা এই ১২০ টাকা নিয়ে দেশের কতটাইবা লাভ হলো। স্পষ্ট বোঝা যায়, মৃত ব্যাক্তিটি ছিল তার পরিবারের এক মাত্র উপার্জমক্ষম ব্যাক্তি। আচ্ছা তার এই মৃত্যুর পর ঐ অসহায় পরিবারটির জন্য দেশের ১২০ টাকার কত গুন বেশি ক্ষতি হবে, তা কি আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকরা একবারও ভেবে দেখেন না, নাকি তারা শুধু দূনীতি করার ভাবনাতেই বেশি ব্যস্ত।
মৃত ব্যাক্তিটির অসহায় স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে যাদের বয়স আনুমানিক ৯ ও ৫ বছর হবে, তারা সবাই তখন আশে-পাশের সবার প্রচন্ড বিরক্তির কারণ, কেননা তারা তখনও প্রচন্ড চিৎকার করে কাঁদছিল। ৫ বছরের এই ছোট ছেলেটিই হইত একদিন দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত অবস্থায়- কোন বাংলা সিনেমা দেখে অনুপ্রানিত হয়ে কালা জাহাঙ্গীরের মতন প্রতিষ্ঠিত নায়ক হবে। ইনছানের চোখে পানি এসে গেল। নোনতা পানি তার চোয়াল গড়িয়ে মুখে ডুকে গেল। তিনি আর সেখানে থাকতে পারলেন না।
এই ভাবেই ইনছানের মেডিকেলে অধ্যায়নরত দিনগুলো কাটতে থাকল। মেডিকেল থেকে পাশ করে বের হবার আগ পর্যন্ত আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেল, কিন্তু লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে বলে আমি তা আর জানাতে পারলাম না।
ইনছান এখন ডাক্তার। ডাক্তার খেতাব পাবার আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- সে হবে একজন আদর্শ ডাক্তার। প্রায় ছোট বেলার কিতাবে পড়া ডাক্তারের মতন। তিনি অবশ্য গ্রামে গেলেন না, থাকলেন তার ন্যাংটাকালের পরিচিত ঢাকা শহরেই। আগেই লিখেছি, ছোট বেলা থেকেই তিনি ছাত্র ভালো, কাজেই নিজ যোগ্যতায় সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার হলেন। সত্যি তিনি আদর্শ ডাক্তার। নমুনা স্বরুপ শুধুমাত্র একটি ঘটনা বলব।
হাসপাতালে যোগদানের তৃতীয় দিন রাত সারে ৮টার দিকে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত অবস্থায় একটি ১৮/২০ বছরের ছেলে এলো হাসপাতালে। জরুরী রক্তের প্রয়োজন, রক্তের গ্রপ বি নেগেটিভ। ছেলেটির সাথে তার অসহায় বন্ধুরা, কিন্তু কোন বন্ধুর সাথেই গ্রপ মেলে না। হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক আছে, কিন্তু অনান্য গ্রপের মতই বি নেগেটিভ এর একাউন্ট ও শূণ্য। জরুরী বিভাগের ডাক্তার ডঃ ইসছানের তখনই মনে পরল তার রক্তের গ্রপ বি নেগেটিভ এবং তিনি দিলেন রক্ত। আমি জানি, এই ফ্রি রক্ত দেবার মাধ্যমে ইনছান যে আনন্দ পেয়েছিলেন ১২ বছর পর একটি সামান্য অপারেশনের জন্য ৫৩ হাজার টাকা ফি নিয়েও তিনি এত আনন্দ পাননি।
আবার আগের কথায় ফিরে আসি, চাকরি পাবার ৪ বছর পর ডঃ ইনছান শুভ বিবাহ সম্পন্ন করলেন। বিয়ের পর এখনও ইনছান সাহেব প্রায় মাহাথীয় মোহাম্মদের মতই আদর্শ ডাক্তার এবং তার মাতৃভক্তি তখনও উল্লেখ করবার মতন। যদিও- শাশুরী ছেলের বউয়ের মধ্যকার যেই গন্ডগোলটা আমরা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত দেখতে অভ্যস্ত, তা কিন্তু ডঃ ইনছান সাহেবদের পরিবারের মতন পরিবার গুলোতে প্রায় অনুপস্থিত। এর পরেও যদি অন্য কোন কারনে ইনছান সাহেবকে অ্যাম্পায়ের ভূমিকা নিতে হত তবে তিনি বউকে বাদ দিয়ে মাকেই স্বাগতিক দেশের অবস্থানে রাখতেন। তবুও এটাত তার মাতৃভক্তির ছোট্ট একটা নমুনা মাত্র।
তিনি যেখানে যত জরুরী কাজেই ব্যস্ত থাকেন না কেন, মায়ের ডাকে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের মত চলে আসতেন। (এই প্লেনটাকে আবার বাংলাদেশ বিমানের কোন প্লেন ভেবেন না আবার, তাহলেত আজকে ডাকলে ৭দিন পরেও কোন খবর নেই।)
আসল সমস্যাটা শুরু হল এরও ৪ বছর পর। ডঃ ইনছানের স্ত্রী সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করেন, এই ছোট্ট তিন রুমের বাসায় নাকি তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই ইনছান সাহেবকে একটা বড় দেখে ফ্লাট কিনতেই হবে। কিন্তু, ডঃ ইনছান এত টাকা কোথায় পাবেন ? সরকারী হাসপাতালে তিনি যা বেতন পান, তার চার ভাগের একভাগত চলে যায় জনসেবাতেই। কাজেই তিনি একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পার টাইম প্যাকটিস করতে লাগলেন, টাকা কামানোর। খুব দরদ দিয়ে রোগী দেখতেন আগে থেকেই, কাজেই কয়দিনের ভেতরেই বাংলা ভায়ের নামের মতই দ্রুত তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরল।
আরে টাকা কত। ডঃ ইনছান ফ্লাট কিনলেন, মাকে দিয়ে উদ্ভোদনও করালেন। গাড়ী কিনলেন(আরো কি কি যেন দামি জিনিস কিনলেন)। এরপর- একদিন ইনছান সাহেবের নজর কারলো মাত্র ৭৫লাখ টাকা দামের একটি BMW এর গাড়ি। তো আবার সংকট। ইনছান সাহেবদের ক্লিনিকে এমন কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, যা সরকারী হাসপাতালত দূরের কথা বাংলাদেশেই মাত্র দুই-তিনটি যায়গায় আছে। এমনই এক চিকিৎসা নিতে তাদের হাসপাতালে এলেন একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগী। ইনছান সাহেরদের ক্লিনিকে সাধারণত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর রোগীরাই বেশি আসেন, কাজেই তিনি বেশ মনক্ষন্ন হলেন। অপারেশনটা করতে মোট খরচ হরে ৩ লাখ টাকা, এর মধ্যে ইনছান সাহেরে সন্মানী ২৫ হাজার। অন্য দিন হলে তিনি রোগীর আত্বীয়দের অনুরোধে তার সম্পূর্ণ সম্মানীই বিয়োগ করে ফ্রি অপারেশনও করেন। কিন্তু সেদিন তার মগজে BMW এর ছবি। রোগির আত্মীয়রা ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা যোগার করতে পেরেছে। আজ ইনছান নরম হলেন না BMW এর চিন্তা করতে করতে তিনি বললেন, “ফুল প্রেমেন্ট না করলে আমি অপারেশন করতে পারব না।”
মাত্র কয়েক ঘন্টার ভেতরেই রোগীর আত্বীয়রা ১৫ হাজার টাকা ম্যানেজ করে নিয়ে এল। ডঃ ইনছান ভাবলেন- রোগীরাতো বরই বদ। একটু চেষ্টা করলেই টাকা দিতে পারে, অথচ টালটি-বালটি করে। এরপর তিনি তার নতুন থিওরি খাটানোর সাথে সাথে বিল বাড়াতে লাগলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তার বাড়ীতে চলে এল ব্রান্ড নিউ গাড়ি। গাড়ীর ইঞ্জিনের শব্দ শুনেই এখন ইনছানের পরান জুড়ায়ে যায়। তাই মানুষের পরানের স্পন্দন শুনতে তিনি এখন আর বেশি সময় নষ্ট করেন না। প্রতিদিনই রোগী দেখায় সেঞ্চুরি পুজিয়ে ফেলেন। একদিন ডাবল সেঞ্চুরিও করেছিলেন। মানে বিল বাড়াতেই তিনি দেখলেন তার নাম চারিদিকে বুশে নামের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
যাইহোক, সময় কম দিলেও সরকারী হাসপাতলের চাকরিটা কিন্তু তিনি ছাড়েন নাই।এখন- মানুষ হাসপাতাল থেকে পাতালে চলে গেলেও তার কিছুই মনে হয় না। তার নিজের গাফিলতিতেই কত লোক মরল। তবুও তার দোষ দেবে কে? তিনি এখন সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার।একদিন তিনি কিছু সময়ের জন্য হাসপাতালে এলেন ডিউটি করতে। একজন গুরুতর অসুস্থ মহিলাকে আনা হয়েছে, যার পোষাক-আশাক আর গায়ের রং এতটাই ময়লা যে ইনছানের গায়ে হাত দিয়ে চিকিৎসা করতে যেতেও অসস্তি লাগছে। মহিলাটির সাথের যুবক কয়টি কিন্তু বেশ সুন্দর। তাদের মধ্যকার একটু বয়স্ক লোকটি বলল, “আমার আপন চাচী না হলেও ইনি আমার মায়ের মতোন। ডাক্তার সাহেব আপনি আমার মাকে বাঁচান। আমার মাকে বাঁচাতে প্রয়োজনে আমি আমার বাড়ীঘর সবকিছু বিক্রি করতে রাজি।” এতদিনের অভিজ্ঞ ডাক্তার ইনসান। ১৯ বছর আগের সেই মেডিকেলের প্রথম দিনের মৃত রোগীটির কথা আর তার মনে নেই, কিন্তু এতদিনে এই রকম অনেক রোগী এসেছে। ডঃ ইনছান বুঝলেন সেই ৯২০ টাকা দাম ছিলো যেই ইনজেকশনটার সেটা দিলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ৫০ ভাগেরও বেশি। তার পরেও প্রথমেই তিনি কিছু পরিক্ষা নিরিক্ষা করার ব্যবস্থাপত্র দিলেন। এবং হাসপাতালের অধিকাংশ পরিক্ষা নিরিক্ষার যন্ত্র-পাতিই নষ্ট থাকায়- নির্দিষ্ট একটি ডাক্তারদের নামে ধন্য বেসরকারী ডায়গনস্টিক সেন্টারে পরিক্ষাগুলো করাতে বললেন।
এমন সময়ই ডঃ ইনসানের কাছে খবর এল, তার মা হাসপাতালে এসেছেন। রোগী ফেলে মায়ের কাছে চলে গেলেন তিনি। যাবার আগে বৃদ্ধ মহিলাটির সাথে আসা ছেলে গুলোর অনেক অনুরোধের সত্বেও তিনি এক মিনিটের সময় চেয়ে নিয়ে চলে গেলেন মায়ে কাছে। মায়ের ডাক তিনি কিভাবে দেরী করবেন।
তিনি তার রুমে গিয়ে মাকে দেখতে পেলেন। মা বললো তাদের এক দূর সম্পর্কের আত্বীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে, তাকে দেখতেই তিনি এসেছেন। ইনসান মায়ের সাথে সেই আত্বীয়কে দেখতে গেলেন। কিছুক্ষন পরে মায়ের সাথেই তিনি জরুরী বিভাগে আসলেন। সেই বৃদ্ধ মহিলাটি এখন আর যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন না। ছেলেকে চিনতে না পারলেও দেখেই সকল যন্ত্রনা ভুলে গেছেন তিনি। কিন্তু, মুখটা সাদা কাপরে ঢাকা থাকায় তিনি এখন আর ছেলেকে দেখতে পারছেন না। ঐ সেই ছেলেটা যে বলেছিল “আমার আপন চাচী না হলেও ইনি আমার মায়ের মতোন। ডাক্তার সাহেব আপনি আমার মাকে বাঁচান।” সে আবেক ধরে রাখতে পারল না। ডাক্তারকে কোন শাস্তি দেবার মতন ক্ষমতা তার নেই। এক মাথা কষ্ট নিয়ে যে বলল,আপনি ১মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে গেলেন,আর আর ১ মিনিট আগে আমার মা মারা গেল। কথা কয়টি বলতে বলতে কিভাবে যেন ছেলেটির হাতে লেগে মহিলাটির মুখের কাপর সরে গেল।
ডঃ ইনছানের মা চমকে উঠলেন, তিনি ভাবলেন কি ভুলটাই না করেছি আমি, কেন আমি ইনছানকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তার হতে বলেছি ?
কিন্তু !!! আমিত ওকে ডাক্তার হতে বলেছিলাম অসহায় মানুষকে বাঁচাবার জন্যই, তারই অবহেলায় তার আপন মা মারা যাবে এ জন্যত না।
ডঃ ইনছানের বর্তমানের নকল মা একেবারে নিশ্চিত ভাবে চিনতে পারলেন, এই তো সেই মহিলা- যে নিজের ছেলেকে বিক্রি করেনি আমার কাছে। এমনকি পরবর্তীতে কোন সুবিধা পাবার আশায় যোগাযোগও রাখেনি, ছেলেকে দু মুঠো ভাত দিতে না পারার লজ্জায়। ও ছিলো অভাবের তাড়নায়, আর আমি ছিলাম সন্তানের।
ইনছানের মা স্পষ্টই দেখলেন, মহিলাটির মুখে শুধুমাত্র বয়সের ছাপ পরেছে তাছাড়া চেহারা সেই আগেকার মতোই, শুধু মাত্র ইনছানকে কোলে তুলে দেবার সময় তার মুখে যে বিষন্নতা ছিল, আজ তা নেই। হইত প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে না চিনেও দেখতে পেয়েই তার এই প্রশান্তি। ডঃ ইনসানের মা নিজেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইনছানকে এই চরম সত্যটা জানালেন।
সেই ১৯ বছর আগের মতই ডঃ ইনছানের চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এল, এবারও পানি চোয়াল গড়িয়ে মুখে এসে পড়লো, কিন্তু ঊনিশ বছরের আগের পানির চেয়ে এই পানি অনেক বেশি নোনতা।
ডঃ ইনছানের কানে কথাগুলো আরো একবার বেজে উঠলো। “আমার আপন চাচী না হলেও ইনি আমার মায়ের মতোন। ডাক্তার সাহেব আপনি আমার মাকে বাঁচান।”
ডঃ ইনছান ভাবলেন ইনছান নাম নিয়েও তিনি মানুষ হতে পারেন নি।
বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তিনি আকাশের দিকে তাকালেন।
সেই ভাবে, যেই ভাবে- আকাশের দিকে তাকিয়ে সুমন গেয়েছিল।
একলা হতে চাইছে আকাশ,
মেঘগুলোকে সড়িয়ে দিয়ে।
ভাবনা আমার একলা হতে,
চাইছে একা আকাশ নিয়ে।
(ধ্যাত, এইডা কোন লেখা হইলো। প্রথম যেদিন লেখা শুরু করি সেদিন ভাবছিলাম, আমাদের বর্তমান সমাজের খুব সহজলভ্য অসংগতিগুলো নিয়ে রম্য রচনা লিখব। কিন্তু, এ আমি কি করিলাম, নায়কের নকল মা হলেও না হয় কোন মতে মেনে নেওয়া যেত, আসল মাকে নিয়ে পরে সুখে-শান্তিতে থাকত, কিন্তু আসল মাই মরে গেল। বাংলা সিনেমার জন্যত এই কাহিনী সুপার ফ্লপ।)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


