somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্য গল্পঃ এলিভেটর

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
রিজভির কলেজ ছুটি হয় বিকেল তিনটার দিকে, আজ শেষের ক্লাসটা না হওয়ায় ঘণ্টাখানেক আগেই ছুটি হয়ে গেল। তেমন বন্ধু-বান্ধব নেই রিজভির। সে খুব পড়ুয়া, ঘরকুনো এবং লাজুক স্বভাবের ছেলে। ক্লাসে অনেকের সঙ্গে সখ্যতা আছে বটে, কিন্তু অন্তরঙ্গতা নেই কারো সঙ্গে।
ওদের কলেজের পেছনে একটা ছোটখাটো গ্যারাজ-মতো জায়গা আছে, ওর মতো দুয়েকজন যারা সাইকেলে চেপে কলেজে আসে, তারা ব্যবহার করে জায়গাটা। প্রতিদিনের মতো আজও কলেজ শেষে কারো সঙ্গে তেমন কথা না বলে নিজের সাইকেলটা নিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলো রিজভি। আস্তে আস্তে সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে গেটের দিকে এগোতে লাগল।
কলেজ ছুটির পর সাধারণত ছেলেমেয়েদের হৈ-হুল্লোর, ছোটাছুটি থাকে। তবে আজ মোটামুটি শান্ত বলা চলে ক্যাম্পাসটাকে। শীতকালিন ছুটি শুরু হয়েছে কলেজে। সামনে বোর্ড পরীক্ষা বলে রিজভিদের বিশেষ ক্লাস নেয়া হচ্ছে। তাই শুধু তাদের ব্যাচের ছেলেমেয়েরাই কলেজে এসেছে।
কলেজ মাঠের মধ্য দিয়ে সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে গেটের দিকে এগুতে লাগল রিজভি। সে চাইলেই প্যাডল চেপে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কলেজ কম্পাউন্ডের ভেতর সাইকেল চালানো নিষেধ বলে সে তা করছে না। অবশ্য এই শীতকালিন ছুটির মধ্যে অল্প কিছু ছেলেমেয়ের জন্য কলেজের বিধি-নিষেধ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, তবুও নিয়ম ভঙ্গ করল না সে।
গেটের বাইরে দাড়াতেই সে রেবাকে দেখতে পেল। তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল রেবা। জিজ্ঞেস করল-
“প্রতিদিনই তুমি সাইকেলে করে আসা যাওয়া করো?”
রিজভি লজ্জিত ভঙ্গীতে হেসে বলল-“হ্যা। আমার বাড়ি তেমন দূরে না তো এখান থেকে, তাই।”
“ও আচ্ছা।”
রিজভি রেবার সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা বিব্রতবোধ করে। এমন নয় যে মেয়েদের সাথে কথা বলার সময় কিশোর সুলভ আড়ষ্টতা তাকে চেপে ধরে, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ক্লাসের সবাই সবাইকে তুই করে ডাকে, শুধু রেবা রিজভিকে তুমি করে কথা বলে, তাই বাধ্য হয়ে তাকেও তুমি করে বলতে হয়। সেটাও একমাত্র সমস্যা নয়, সমস্যা হলো মেয়েটা রিজভির সঙ্গে শুধু তখনই কথা বলে যখন আশেপাশে তেমন কেউ থাকে না। রিজভির বয়স কম হলেও সে বোকা নয়, সে ভালোভাবেই জানে রেবা তার প্রেমে পড়েনি। রেবার বয়ফ্রেন্ড আছে। এত অল্পবয়সী, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড থাকাটা মোটেও ভালো নয় এটা রিজভি বোঝে, কিন্তু সত্য কথা হলো, কলেজের বেশিরভাগ মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড আছে। কাজেই রেবা যে ঠিক কি চায়, সেটা রিজভি বুঝতে পারে না। হতে পারে নির্জলা বন্ধুত্ব চায় মেয়েটা, যদিও তার হাবভাবে সেটা মনে হয় না।
একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে, রেবার তেমন ছেলে বন্ধু নেই। রেবার বয়ফ্রেন্ডের ভয়ে কোন ছেলে তার সাথে বন্ধুত্ব তো দূরে থাক, কথাও বলতে চায় না সহজে।
রেবার বয়ফ্রেন্ডের নাম সৌরভ, তার বাবা একজন সংসদ সদস্য। বাবার ক্ষমতার দাপটে ছেলেও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। প্রায়ই কলেজে এর সঙ্গে-ওর সঙ্গে মারপিট বাধে সৌরভের। গায়ে গতরেও সে বেশ শক্তিশালী, এক বছর ফেল না করলে এতদিনে ইউনিভার্সিটির ছাত্র হতো।
অবশ্য রিজভি সৌরভকে ভয় পায় না। তার নিজের বাবাও খুব প্রভাবশালী একজন মানুষ, যদিও কলেজে সেটা কাউকে জানায়নি। কাজেই বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে বখে যাওয়া একটা ছেলেকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখে না সে।
রিজভি রেবাকে জিজ্ঞেস করল-“আজ তোমাকে নিতে গাড়ি আসেনি?”
রেবা ঠোট বাঁকিয়ে উত্তর দিল- “নাহ, আসেনি। মা একটা অনুষ্ঠানে গেছে গাড়ি নিয়ে। আমাকে বলেছে রিকশায় চলে আসতে।”
“ও আচ্ছা।” বলে সাইকেল উঠে বসল রিজভি। রেবার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল-“কাল দেখা হবে কলেজে।”
রেবা উত্তর দিল না। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা চিন্তা করছে সে। একটু চুপ থেকে রিজভিকে জিজ্ঞেস করল-“আচ্ছা, আমায় বাসায় পৌঁছে দিতে পারো তুমি? তোমার সাইকেলের পেছনে বসিয়ে?”
রিজভি বেশ অবাক হলো। এমন প্রস্তাব সে মোটেও আশা করেনি! বিস্ময় নিয়ে বলল-“আমার সাইকেলে!”
“হ্যা, আমি অনেক দিন সাইকেলে চড়ি না। নিজে তো আর চালাতে পারি না! আজ সাইকেলে চড়তে ইচ্ছে করছে।”
রিজভি একটু চিন্তায় পড়ে গেল। রেবার বয়ফ্রেন্ড সৌরভ এই ঘটনা শুনলে ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করবে। সে সৌরভকে ভয় পায় না ঠিক, তাই বলে যেঁচে পড়ে তার সঙ্গে ঝামেলাও তৈরি করতে চায় না। একটু ইতস্তত করে সে রেবাকে বলল-“তুমি আমার সাইকেলে চড়ে বাসায় যাবে? কোন সমস্যা হবে না তো?”
রেবা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল-“কি সমস্যা হবে রিজভি? অবশ্য তুমি যদি অতিরিক্ত একজনকে নিয়ে সাইকেল চালাতে না পারো...”
অতিরিক্ত একজনকে নিয়ে সাইকেল চালানোটা রিজভির সমস্যা না। রেবার শরীরে কিশোরীর চেয়ে তরুণী ভাবটা প্রবল হলেও এমন আহামরি ভারী নয় সে যে তাকে নিয়ে সাইকেল চালাতে পারবে না, সমস্যাটা হলো রিজভির সঙ্গে সাইকেলে চড়ার ঘটনাটা সৌরভ কিভাবে নেবে সেটা।
তবে ভদ্রতাবশত রেবাকে না করতে পারল না রিজভি। তাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে প্যাডলে চাপ দিল সে, সাই সাই করে দ্রুত এগোতে লাগল।
শীতের বিকেলের বাতাসটা বেশ মিষ্টি। রেবার শরীর থেকেও সে এক রকমের হালকা সুবাস পেতে লাগল। বেশ ভালো লাগতে শুরু করল তার। শত হলেও এই বয়সের তীব্র আবেগ উপেক্ষা করার নয়!


দুই
রিজভির ধারণা সঠিক প্রমাণ হলো। পরদিন সকালে কলেজে যাবার পথে সৌরভ দু’জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ওর পথরোধ করে দাড়াল।
জায়গাটা নির্জন। পাশেই কবর স্থান। বড় বড় ঘাস জন্মেছে রাস্তার দু’পাশে। কবরস্থানের উল্টো দিকে একটা পুরনো জলা, কচুরিপানা ছেয়ে আছে পুরো জলা জুড়ে।
রিজভি সৌরভকে দেখে কিছু না বলে সাইকেল থেকে নামল। বলিষ্ঠ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল- “বল, কি ব্যাপার?”
সৌরভ রিজভির চেয়ে দু’ইঞ্চি লম্বা। বুকের ছাতিও চওড়া। রিজভির প্রশ্ন শুনে সে কিছুই বলল না, শুধু তার চোখ দু’টোতো তীব্র ক্রোধ ধিক ধিক করে জ্বলতে লাগল। রিজভি কিছু বোঝার আগেই সে গায়ের জোর দিয়ে কষে একটা চড় মারল ওর গালে। মারামারি হতে পারে, এমনটা রিজভি আঁচ করেছিল, কিন্তু এতই ক্ষিপ্র গতিতে চড়টা মারল সৌরভ যে বুঝতে পেরেও রিজভি সরে যেতে পারল না।
অসুরের শক্তি সৌরভের গায়ে। এক চড়েই ছিটকে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। উঠে বসার আগেই সৌরভের দু’জন সাঙ্গপাঙ্গ একযোগে লাথি মারতে শুরু করল। দু’তিন মিনিট ধরে পাগলের মতো রিজভির বুকে, পেটে, পিঠে তারা লাথি মারতে থাকল। রিজভি দুর্বল ভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না কোন, বরং মারের প্রকোপ আরও বেড়ে গেল। কয়েক মিনিট সময়কে অনন্তকাল মনে হলো রিজভির কাছে।
কিছুক্ষণ পর মারের প্রকোপ থেমে যেতেই সৌরভ ওর কলার চেপে ধরল। হিসহিসিয়ে বলল-“সামলে চলিস বাছা, রেবার আশেপাশে আরেকবার দেখলে তোর চোখ দু’টো আমি ঘুটে তুলে নেব! আর মনে করিস না তোর বড়লোক বাপের ভয়ে কুঁকরে যাব আমি। আর কেউ না জানলেও আমি জানি তোর বাপ কে। মনে রাখিস, সৌরভ নিজের বাপের জোর বাসায় রেখে বাইরে বেরোয়। গিয়ারে জোর থাকলে একলা আসিস আমার সাথে, ম্যান টু ম্যান!”
ওকে এভাবে ফেলে রেখেই দলবল নিয়ে চলে গেল সৌরভ। কিছুক্ষণ ওভাবে পরে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে বসল রিজভি। তার ঠোঁট কেটে গেছে বিচ্ছিরিভাবে, শার্ট ছিড়ে গেছে, সারা শরীরে ব্যাথা করছে, পেটে লাথি খাওয়ায় কষ্ট হচ্ছে দম নিতেও। তবে এই প্রচন্ড মার খেয়েও মনোবল হারাল না সে। ঠিক করল বাসায় কিছু জানাবে না। নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করবে। যদিও বাবা মায়ের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তবুও আজকের ঘটনাটা সে বাসায় জানাবে না, অন্তত এখনই! সৌরভের শেষ কথাগুলোয় তার আঁতে ঘা লেগেছে। সৌরভকে এর ফল ভুগতে হবে।
সে জানে গায়ের জোরে সৌরভের সঙ্গে পারবে না, কিন্তু মনের জোরের সামনে গায়ের জোর তুচ্ছ। কি ভাবে কি করবে পরিকল্পনা করে ফেলল।
সবার আগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে তাকে, এই শার্টটা ধুয়ে ফেলতে হবে, ঠোঁটটার পরিচর্যা করতে হবে। কেঁটে গেলেও ঠোঁটের বাইরের দিকে ঠিক আছে, কেঁটেছে ভেতরের দিকে। একটু যত্ন নিলেই আর তেমন বোঝা যাবে না। ফোলা ভাবটাও কমে যাবে কয়েক ঘন্টার মধ্যে। শার্টটা ছিড়ে গেছে বাজে ভাবে, এটা বদলাতে হবে। আজ আর কলেজে যাবে না। একদিন কলেজে না গেলে বাসায় জানাজানি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।
সমস্যা হলো জামা বদলানো নিয়ে। কলেজের বাইরে তার তেমন কোন বন্ধু নেই যার কাছ থেকে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় একটা শার্ট ধার নিতে পারে। কলেজে গেলে কয়েক জন বন্ধুকে বলা যায়, কিন্তু সেটা করা যাবে না। তাহলে প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনাটা মাটি হয়ে যাবে।
একটু ভাবতেই একটা চমৎকার বুদ্ধি মাথায় আসল। হ্যা, এই বুদ্ধিটা কাজে লাগালে পরিকল্পনাও মাটি হবে না, সেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে। নিজের ঠান্ডা মাথা নিয়ে গর্ববোধ করল রিজভি। এই মাথা ঠান্ডা রেখে পরিকল্পনা করার অভ্যাসটা সে বাবার কাছ থেকে পেয়েছে।
স্মিত হেসে সাইকেলে চেপে বসল সে।


তিন
সকাল সকাল এই এলাকায় রিকশা পাওয়া দুষ্কর। রেবাকে প্রতিদিন বাসার সামনে রিকশার জন্য পাঁচ-দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকতে হয়। সকাল বেলা রিকশায় করে কলেজে যায় সে। বিকেলে গাড়িতে ফেরে। তার মা কর্মজীবী মহিলা। রেবা ঘুম থেকে ওঠার আগেই গাড়িতে করে অফিসে চলে যায় সে। বিকেলে অবশ্য রেবার আগেই ঘরে ফেরে, তখন গাড়িটা পাঠিয়ে দেয় রেবাকে নিতে।
রেবা আর রেবার মা একাই থাকে। রেবার বাবার সঙ্গে মায়ের ডিভোর্স হয়েছে তিন বছর আগে।
কিছুক্ষণ পরেই একটা রিকশা দেখতে পেল রেবা। হাত তুলে ডাকল। রিকশায় চেপে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে লাগল সে।
সকালটা সুন্দর। শহরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এবং একটু অভিজাত এলাকা বলে জায়গাটা বেশ নির্জন। শীতের সকালের নরম রোদে রিকশা ভ্রমণ বেশ ভালো লাগে তার। চোখ বন্ধ করে গানটা শোনার চেষ্টা করল সে।
কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারবে না, হঠাৎ একটা বাঁজখাই গলা শুনে চমকে উঠল।
“এই রিকশা দাড়া!”
সৌরভ তার দুই সঙ্গী অভিজিৎ আর রুবেলকে নিয়ে পথরোধ করে দাড়িয়েছে। রিকশাওয়ালা যাবার পথ না পেয়ে বাধ্য হয়ে থামাল। রিকশা থামতেই সৌরভ রক্তচক্ষু মেলে রেবাকে বলল-“নামো।”
রেবা প্রথমে বুঝতে পারল না কি হয়েছে, তবে সৌরভের চেহারা দেখে বুঝল আবারো কোন একটা ঝামেলা পাকিয়েছে সে। রিকশা থেকে নেমে বিরক্ত গলায় সে সৌরভকে জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে?”
সৌরভ জবাব না দিয়ে একটা বিশ টাকার নোট হাতে নিয়ে রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বলল-“এই ভাড়া রাখ, আর যা এখান থেকে!”
সৌরভের হাবভাবে ঘাবড়ে গিয়ে সে রেবার দিকে তাকাল। রেবা মাথা নেড়ে সায় দিতেই রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল। সৌরভের দিকে ফিরে রেবা জিজ্ঞেস করল-“আবার কি ঝামেলা বাঁধিয়েছ?”
হুংকার দিয়ে সৌরভ বলল, “আমি বাঁধিয়েছি না তুমি বাঁধিয়েছ? রিজভির সঙ্গে এত ভাব কেন তোমার?”
“ভাব? ভাবের কি দেখলে?”
“কাল ওর সাথে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াওনি?”
“মোটেও ঘুরে বেড়াইনি, কাল আমার জন্য গাড়ি আসেনি তাই ওর সাইকেলে করে বাসায় ফিরেছি।”
“কেন রিকশা ছিল না?”
“নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু হঠাৎ সাইকেল চড়তে ইচ্ছে হলো তাই ওর সাথে গেলাম। সমস্যাটা কোথায়?”
“সমস্যা কোথায়! তুমি জানো যে কোন ছেলে তোমার সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করুক সেটা আমি সহ্য করতে পারি না!”
“ঘেঁষাঘেঁষির কি দেখলে তুমি! কারো সঙ্গে কথা বলা, সময় কাটানো খুব সহজ স্বাভাবিক বিষয়। এর নাম সামাজিকতা, প্রেম নয়। ম্যাচিউর হতে শেখো সৌরভ! তোমার তো আরও রিজভির প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে সে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে!”
“আমাকে শিখিও না কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা স্বাভাবিক নয়! আর যেন রিজভির সঙ্গে তোমাকে না দেখি রেবা!”
“আচ্ছা, তোমার কথামতো আমাকে চলতে হবে এখন?”
“হ্যা! চলতে হবে!”
“ওকে, লেট’স ব্রেক আপ! এই পজেজিভ রিলেশনের কোন দরকার নেই আমার। আজ থেকে তোমার রাস্তা আমার রাস্তা আলাদা সৌরভ!”
সৌরভ পাগলের মতো হেসে উঠল! হাসতে হাসতেই বলল-“কেন বার বার এই হাস্যকর কথাগুলো বলো রেবা? তুমি ভালো করেই জানো আমাকে ছেড়ে দিলে তোমার কি অবস্থা হবে!”
রেবা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ব্ল্যাকমেইল করছ আমাকে?”
“হ্যা করছি!”
দু’জন দু’জনের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর সৌরভ বলল-“আজ বাসায় চলে যাও তুমি। রিজভির বাবা প্রভাবশালী একজন মানুষ, কলেজে ঝামেলা হতে পারে।”
রেবার চোখের আগুন নিভে গিয়ে হঠাৎ উৎকণ্ঠা তৈরি হলো। জিজ্ঞেস করল-“কি করেছ তুমি রিজভির সাথে?”
সৌরভের সঙ্গী রুবেল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে জবাব দিল-“বস মেরে হাগিয়ে দিয়েছে শালাকে!”
“কি!”
রেবার গালে টোকা দিয়ে সৌরভ বলল, “চলি রেবা। কলেজে যেও না, বাসায় চলে যাও।”
রেবাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে সৌরভ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে চলে গেল।
একটু ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে হাটতে লাগল রেবা। সে ধারণাও করতে পারেনি এত তুচ্ছ কারণে সৌরভ রিজভির গায়ে হাত তুলবে।
অন্যমনস্ক ভাবে দশ মিনিট হাটার পর, রেবার মনে হলো, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে তাকিয়ে চমকে গেল সে!
সাইকেল ঠেলে ঠেলে রিজভি তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার শার্ট এখানে ওখানে ছেঁড়া, ঠোঁট গড়িয়ে রক্ত পড়ছে, ধূলোবালি লেগে আছে সারা গায়ে। রেবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে সে বলল-“হ্যালো রেবা! কেমন আছ?”

চার
ছয়তলায় রেবাদের ফ্ল্যাট বাড়িটা বেশ বড় আর ছিমছাম। দেয়ালে কিছু দামী ছবি ঝুলছে। আসবাবপত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় রেবার মা বেশ সৌখিন মহিলা।
রেবার বাসা এই কয়েক ঘণ্টা ফাঁকা থাকে। তার মা অফিসে এখন, তারও কলেজে থাকার কথা। তবে এই মুহূর্তে সে রিজভির পরিচর্যা করছে। কাঁটা ঠোঁটটা পরিষ্কার করেছে। ওর কনুইয়ের কাছে সামান্য ছড়ে গেছে, সেখানে ঔষধ লাগাচ্ছে।
তুলো দিয়ে ক্ষতটা মুছতে মুছতে রেবা জিজ্ঞেস করল-
“তোমাকে কি পরতে দেব বুঝতে পারছি না। গেস্টদের জন্য কিছু জামা কাপড় রাখি আমরা, জিন্স-টি শার্ট হলে চলবে?”
“চলবে, বাসায় বলব যে কলেজে স্পোর্টস ছিল।”
রেবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল- “তোমার সাহস আছে বলতে হবে রিজভি। এতকিছুর পরেও আমার কাছে এসেছ পরিচর্যার জন্য।”
রিজভি হাসল। “এই মুহূর্তে একমাত্র তুমিই আছো যার কাছে আসলে আজকের মারামারির ঘটনাটা বাসায় জানাজানি হবার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া সৌরভ স্বপ্নেও কল্পনা করবে না আমি পরিচর্যার জন্য তোমার বাসায় আসতে পারি।”
রেবা হাসল না, তার মুখ থমথমে। বলল, “একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, তুমি বাসায় জানাতে চাচ্ছ না কেন? তোমার বাবা শুনলাম বেশ ক্ষমতাবান মানুষ!”
“ঠিক শুনেছ, কিন্তু সৌরভের মতো সামান্য বখাটে মাস্তানকে শায়েস্তা করার জন্য আমার বাবার ক্ষমতা ব্যবহার করার দরকার নেই।”
রেবা বেশ অবাক হলো এবার! “মানে? তুমি সৌরভের সাথে ঝামেলা করার প্ল্যান করছ?”
“ঝামেলা তো সৌরভ শুরু করেছে, আমি সেটা শেষ করতে চাইছি মাত্র!”
“শোনো রিজভি, সৌরভের সাথে লাগতে যাওয়ার কোন দরকার নেই। সে খুব বিপজ্জনক ছেলে, খুবই বিপজ্জনক। অনেক বড় বড় অপরাধীর সাথেও ওর ওঠাবসা আছে। তুমি ভদ্র ছেলে, ওর সঙ্গে লাগতে গিয়ে নিজের সুনাম আর ক্যারিয়ার নষ্ট করো না!”
“কে বলল আমি ক্যারিয়ার নষ্ট করছি! আমি যা করতে যাচ্ছি তাতে আমার জন্য কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, এমন একটা বখাটে ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক হলো কি করে!”
রেবা চমকে উঠল। এই ছেলেটা আজ তাকে বারবার চমকে দিচ্ছে। ক্লাসে শান্ত-শিষ্ট ছেলেটা এতটা বুদ্ধিমান, সাহসী আর অকপট সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
“তোমার কি আমাকে ভালো মেয়ে মনে হচ্ছে রিজভি? আমি ভালো মেয়ে নই। খারাপ ছেলেদের সঙ্গে খারাপ মেয়েদেরই সম্পর্ক থাকে।”
রিজভি মিষ্টি করে হেসে বলল-“জানো রেবা, আমার বাবার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি অল্প সময় কোন মানুষের সঙ্গে কাটিয়েও তার স্বভাব-চরিত্র অনুমান করে নিতে পারি। তোমার পরিবার সম্পর্কে আমি জানি। তোমার বাবা-মা সেপারেট হয়ে গেছে তিন বছর আগে, তোমার মায়ের খুবই বড় একটা চাকরি আছে, কিন্তু আমার মনে হয় না তুমি বড়লোকের বখে যাওয়া কোন মেয়ে।”
“কি মনে হয় তাহলে?”
“মনে হয় যে কোথাও একটা সমস্যা আছে। তোমার কোন দুর্বলতা আছে, যার জন্য তুমি বাঁধা পড়ে গেছ সৌরভের কাছে।”
রেবা প্রচন্ড বিস্মিত হলো। এত অল্পবয়সী একটা ছেলে এত বুদ্ধি রাখে, কল্পনাও করা যায় না। রেবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল-“তুমি জানতে চাও কেন আমি সৌরভের কাছে বাঁধা পড়ে গেছি?”
“হ্যা রেবা, আমি জানতে চাই। জানি না তোমাকে এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারব কি না, তবুও জানতে চাই।”
“ঠিক আছে।”
রেবা রিজভির কাছ থেকে দু’হাত দূরে গিয়ে দাড়াল। তারপর অবলীলায় ফুল হাতার কলেজ শার্টের বোতামগুলো খুলতে লাগল। রিজভি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকল রেবার দিকে। রেবা কি করতে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না।
শার্টের বোতামগুলো খুলে গা গলিয়ে শার্টটা ফেলে দিল রেবা। ভেতরে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে সে। এবার রিজভি বুঝতে পারল।
রেবার নগ্ন দু’বাহুর উপরের দিকে অসংখ্য ছোট ছোট দাগ। এরকম দাগ রিজভি টিভিতে দেখেছে। এগুলো সুঁচের দাগ। রিজভি অস্ফুট স্বরে বলল উঠল- “রেবা, তুমি ড্রাগ এডিক্টেড?”
রেবা মাথা দোলাল। শার্টটা তুলে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বলল-“বাবা মায়ের ডিভোর্স হবার আমাদের পরিবারটা একরকম ধ্বংস হয়ে যায়। আমিও ভেতরে ভেতরে খুব একা এবং ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়ি। প্রায় ছ’মাস ধরে আমি ড্রাগ এডিক্টেড। আমার ড্রাগসের জোগান দেয় সৌরভ, তাও নিজের খরচে। কাজেই বুঝতেই পারছ, আমি চাইলেই সৌরভকে চট করে ছেড়ে দিতে পারি না।”
রিজভি ভালোরকম বিস্মিত হলো। রেবা ড্রাগ এডিক্টেড, এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সে।


পাঁচ

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত।
পরদিন বিকেল। সৌরভ তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই পেছন থেকে তার কলার চেপে ধরে হিরহির করে তাকে টেনে ১০ হাত দূরে নিয়ে গেল রিজভি। তার সাহস দেখে সৌরভের বন্ধুরা প্রথমে অবাক হলো, তারপর রেগেমেগে তেড়ে এলো।
সৌরভের দু’জন সাঙ্গপাঙ্গ এবং সৌরভ নিজে ভয়ানক মার খেল রিজভির হাতে। রিজভির গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছিল তখন। দু’জন সাঙ্গপাঙ্গের একজনের হাত ভেঙে গেল। সৌরভ খুব বেশি মার না খেলেও তার নাকমুখ ভিজে গেল রক্তে। এমন ভাবে তাকে মারল রিজভি, যাতে সৌরভের কোন ইঞ্জ্যুরি না হোক, কিন্তু সবাই জানুক সে ভয়াবহ মার খেয়েছে।
ঘটনা জানাজানি হলে সৌরভের সংসদ সদস্য বাবা ছুটে এলো কলেজে। রেগে অগ্নিশর্মা হয়েছে সে। সঙ্গে পুলিশ নিয়ে এরেস্ট করতে এলো সে রিজভিকে।
কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ঘটনা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। বলল-“আপনি ঠিক জানেন আপনার ছেলেকে রিজভিই মেরেছে, অন্য কেউ নয়?”
“অবশ্যই, চায়ের দোকানের দু’জন কাস্টোমার আর দোকানদার নিজে দেখেছে রিজভিকে সেখানে।”
“নিশ্চয়ই তাদের কোথাও ভুল হয়েছে। কারণ রিজভি আজ সারাদিন কলেজেই ছিল। আমি নিজে তার ক্লাস নিয়েছি। ক্লাসের বাকী সবাইও দেখেছে ওকে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সত্যিই কলেজের অনেকে রিজভিকে দেখছে আজ, কথা বলেছে ওর সাথে। কাজেই পুলিশ রিজভিকে এরেস্ট করল না। সৌরভের বাবাও দ্বন্দ্বে পড়ে গেলে। নিজের ছেলের চরিত্র সম্পর্কে ভালো জানে সে। মারামারি করা সৌরভের জন্য নতুন কিছু নয়। কাজেই ছেলেকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
শুধু সৌরভের চোখ দু’টো জ্বলতে লাগল রাগে। সে জানে, এটা রিজভির কাজ। কিভাবে কি করেছে রিজভি তা সে জানে না, কিন্তু তাকে যে মেরেছে আজ, সে রিজভি ছাড়া আর কেউ নয়।

ছয়
২০ বছর আগের কথা।
এগারতলা একটা ভবন। বেশ আধুনিক! কমার্শিয়াল বিল্ডিং আসলে এটি। বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস। দিনের বেলা বেশ সরগরম হলেও এখন, রাতে পুরোপুরি নির্জন। এমনিতেও ঈদের ছুটি চলছে। যে নাইটগার্ডটা ছিল, তাকেও ছুটি দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য ভবনটি।
ভবনের দোতলায় তিনজন তরুন-তরুণী দাড়িয়ে রয়েছে। শিহাব, অহনা এবং সুমন। সবাই কিছুটা ভীত, কিছুটা কৌতূহলী। শিহাব একটু ভীত গলায় বলল- “কি বলিস তোরা? শুরু করা যায়?”
সুমনের ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছিল। সেটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষে সে বেপরোয়া গলায় বলল-“করাই যায়। এত চুপসে গেলি কেন? আইডিয়াটা তো তোরই ছিল।”
অপ্রস্তুত হয়ে গাল চুলকাল শিহাব। “তা ঠিক, আমারই আইডিয়া ছিল। থিওরিটিক্যালি একটা আইডিয়া তৈরি করা আর বাস্তবে সেটার প্রয়োগ করার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক, বিষয়টা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
সুমন হাসল। “এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। অহনা, ভয় পাচ্ছিস তুই?”
অহনা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, কিছুটা অন্যমনস্কও। বলল, “কিছুটা পাচ্ছি। তবে বেশি হচ্ছে কৌতূহল।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। অসুবিধা নেই। শুরু করা যাক। শিহাব, নিয়মগুলো বলে দে আরেকবার।”
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল শিহাব, তারপর বলল-“এই বিল্ডিংটা এগারতলা, আমরা আছি বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায়, মানে ফার্স্ট ফ্লোরে। মোট তিনটে লিফট আছে বিল্ডিংয়ে। আমরা তিনজন তিনটে লিফটে যাব। লিফটে ওঠার আগে যার যার সেলফোন বন্ধ করে নেব। লিফটে ঢুকে প্রথমে ফোর্থ ফ্লোরের বাটন প্রেস করব। ফোর্থ ফ্লোরে যাবার পর প্রেস করব সেকেন্ড ফ্লোরে যাবার বাটন। সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে সিক্সথ ফ্লোরে যাবার বাটন প্রেস করতে হবে। একইভাবে আমরা সিক্সথ ফ্লোর থেকে আবার সেকেন্ড ফ্লোরে যাব, সেকেন্ড ফ্লোর থেকে যাব টেনথ ফ্লোরে এবং টেনথ ফ্লোর থেকে ফিফথ ফ্লোরে এসে থামব। ফিফথ ফ্লোরে গিয়ে আমরা লিফট থেকে নামব না, অপেক্ষা করব। যে মিথ প্রচলিত আছে, সেটা সত্য হলে লিফটে একটি মহিলা প্রবেশ করবে। এই মহিলাটির দিকে তাকানো যাবে না, তার সাথে কথা বলা যাবে না। মহিলাটি পৃথিবীর মানুষ নয়, অন্য জগতের মানুষ। মহিলাটি লিফটে ঢুকলে আবার টেনথ ফ্লোরের বাটনে প্রেস করতে হবে। যদি লিফট ফার্স্ট ফ্লোরের দিকে যায়, তাহলে ফার্স্ট ফ্লোরে আসা মাত্র নেমে যেতে হবে, মহিলাটির দিকে না তাকিয়ে। আর যদি টেনথ ফ্লোরের দিকে যায় লিফট, তাহলে আমরা অপেক্ষা করব। টেনথ ফ্লোরে যাবার পর মহিলাটি জিজ্ঞেস করবে, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?” তার দিকে তাকানো যাবে না, কথা বলা যাবে না। মহিলাটি লিফট থেকে বেরিয়ে যাবে। লিফটের বাইরে তাকালে আমরা অন্য একটি জগত দেখতে পাব। লিফট থেকে বাইরে পা বাড়ালে কখনো আমরা ফিরে আসতে পারব না সে জগৎ থেকে। তাই আমাদেরকে লিফট থেকে না বেরিয়ে ফিরে আসতে হবে ফার্স্ট ফ্লোরে। ব্যস খেলা শেষ। মনে রাখতে হবে, এই খেলাটিকে পৃথিবীর ভয়ংকরতম খেলা বলা হয়। কেউ যদি যেতে না চাস, এখনি ফিরে যেতে পারিস। গত বছর এলিসা ল্যাম এই খেলাটি খেলতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। কাজেই...”
এলিসা ল্যামের মৃত্যু; সেখান থেকেই শিহাবের মাথায় আইডিয়াটি আসে। ২০১৩ সালে এলিসা ল্যামের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল লস এঞ্জেলসের সিসিল হোটেলের পানির ট্যাংকে, সে হোটেলে কিছুদিন থাকার জন্য উঠেছিল ল্যাম। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে সে লিফটে উঠেছিল, লিফটের সিকিউরিটি ক্যামেরায় সে ছবি উঠেছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ল্যাম একটার পর একটা লিফটের বাটন পাগলের মতো প্রেস করছে। লিফটের বাইরে উঁকি দিয়ে ভয়ংকর কিছু দেখে আবার লিফটে এসে লুকোচ্ছে। অদৃশ্য কারো সঙ্গে কথা বলছে। ধারণা করা হয়, এলিসা সেই ভয়ংকর খেলা- এলিভেটর গেম খেলার চেষ্টা করেছিল।
এলিসা ল্যামের সেই এলিভেটরের ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়লে তার মৃত্যু নিয়ে অনেক গবেষণা, জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এ রহস্যের সমাধান হয়নি। সেই ভিডিও দেখে শিহাবের মাথায় আসে নিজে নিজে লিফটে গেম খেলার পরিকল্পনা। নিজের প্রিয় দু’জন বন্ধুকে বলে নিজের পরিকল্পনা। শিহাবের বাবা বড় ব্যবসায়ী। এই এগারতলা ভবনটা ওদেরই। কাজেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না ওদের। তারপর, আজ রাতে তারা এসেছে পৃথিবীর ভয়ংকরতম খেলাটি কতটুকু সত্য, তা পরীক্ষা করতে।
সুমন বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে, শুরু করা যাক। আমি উত্তর দিকের লিফটে উঠছি, তুই দক্ষিণ দিকে যা, আর অহনা এই দিকের লিফটে উঠে পড়। এলিসা ল্যামের মৃত্যু রহস্য আজ সলভ করা হবে!”

সাত
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই ফোর্থ ফ্লোরের বাটন প্রেস করে, বুকে হাত বেঁধে আরাম করে দাড়াল সুমন। সে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না। এই খেলাটি তার কাছে সামান্য রোমাঞ্চ ছাড়া কিছুই নয়। নিয়ম অনুযায়ী ফোর্থ থেকে সেকেন্ড, সেকেন্ড থেকে সিক্সথ, সিক্স থেকে সেকেন্ড, সেখান থেকে টেনথ এবং শেষে ফিফথ ফ্লোরের বাটন প্রেস করল। ফিফথ ফ্লোরে এসে অপেক্ষা করল সে। লিফটের দরজা খুলে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল কোন অশরীরী নারী আসছে কি না।
কয়েক মিনিট পার হলো। নাহ, আসছে না। মৃদু হেসে ফার্স্ট ফ্লোরের বাটন প্রেস করল সে।

*** *** ***
ফিফথ ফ্লোরে আসতে আসতে শিহাব রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে লাগল। কিছুই ঘটেনি, কিন্তু কি ঘটতে পারে সেটা ভেবেই সে ভয়ে আধমরা হয়ে যাচ্ছে।
ফিফথ ফ্লোরে এসে লিফট খুলল, কিছুক্ষণ কেটে গেল, কেউ আসল না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শিহাব। তার মানে এই খেলাটা পুরো ভুয়া, ভাবল সে।
ঠিক তারপরেই হঠাৎ করে দেখতে পেল তাকে। একটা ধূসর আলখেল্লা পড়া লম্বা একটা মহিলা। চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে তার। অনেক দীর্ঘ লম্বা চুল। পায়ের পাতা উল্টো দিকে। আস্তে আস্তে করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামাল নিচে। এর দিকে তাকানো যাবে না, কথা বলা যাবে না।
টের পেল মহিলাটি লিফটে ঢুকেছে। পঁচা একটা গন্ধ এসে ঝাঁপটা মারল নাকে। কাঁপা হাতে লিফটের টেনথ ফ্লোরের বাটন প্রেস করল শিহাব এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে লিফট উপরে না উঠে নিচের দিকে নামছে। তার মানে তাকে নেমে যেতে হবে। দোতলায় লিফট আসতে প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এলো শিহাব। খেলার নিয়ম অমান্য করে শেষবারের মতো তার দিকে তাকাল। জ্বলজ্বলে চোখগুলো যেন শিহাবের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে।
ছুটে সামনে যেতেই সুমনকে দেখতে পেল সে। সুমন তার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল-“তুই ঠিক আছিস শিহাব? সব ঠিক আছে?”
“আ...আমি দেখেছি তাকে।”
“কাকে দেখেছিস?”
“সেই অশরীরী মহিলাকে। যেমন খেলার নিয়ম, তেমনই হয়েছে। লিফটটাও টেনথ ফ্লোরে যাবার বদলে সেকেন্ড ফ্লোরে চলে এলো!”
“শান্ত হ’ শিহাব। কেমন দেখতে ছিল মহিলাটি?”
“ভয়ংকর, লম্বা চুল, পায়ের পাতা উল্টো দিকে, গায়ে পঁচা গন্ধ...”
শুনে জোরে হেসে উঠল সুমন। বলল-“তাহলে তো ঠিকই আছে। তুই যেমন কল্পনা করেছিস, যেমনটা দেখতে চেয়েছিস, তেমন ঘটনাই ঘটেছে, তেমনটাই দেখেছিস। আমি ভূতে বিশ্বাস করি না, তাই কিছু দেখিওনি।”
“আমি কল্পনা করিনি সুমন। যদি কল্পনা করতাম, তাহলে লিফট উপরে না গিয়ে নিচের দিকে নামল কেন? লিফট কি আমার কল্পনায় চলে?”
“নিশ্চয়ই চলে, তুই কি পারতি এই মহিলাটির সাথে দশতলা পর্যন্ত যেতে? তোর নার্ভ সহ্য করতে পারত?”
একটু চিন্তা করল শিহাব। বলল-“না, পারত না।”
“তোর নার্ভ যেটা পারত না, তোর মস্তিষ্ক সেটা করতে চায়নি। তোর কি স্পষ্ট মনে আছে, তুই শেষ মুহূর্তে টেনথ ফ্লোরের বাটন প্রেস করেছিলি? সেকেন্ড ফ্লোরের নয়?”
আশ্চর্য হয়ে শিহাব লক্ষ্য করল, সে মনে করতে পারছে না। তাহলে কি পুরোটা তার ভ্রম ছিল?
“কিন্তু অহনা কই? অহনা এখনো আসছে না কেন?”
শিহাবের প্রশ্নে সুমন চিন্তা করল, তাই তো! অহনা আসছে না কেন! এতক্ষণে চলে আসার কথা। বলল, “এখনি হয়তো চলে আসবে। দেখি অপেক্ষা...”
হঠাৎ করে থেমে গেল সুমন। চোয়াল ঝুলে পড়ল বিস্ময়ে। চোখগুলো বুঝি কোটর ছেড়ে বের হয়ে আসবে। শিহাব তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তৃতীয় লিফটের দিকে তাকাল। অহনা বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। কেমন উদভ্রান্তের মতো পা ফেলছে।
অহনার ঠিক পেছনে, লিফটের ভেতর একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। পরনে সাদা আলখেল্লা। কালো দীর্ঘ চুল। তার চেহারা অবিকল অহনার মতো। যেন অহনার পেছনে দাড়িয়ে আছে আরেক অহনা।
ধীরে ধীরে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এলোমেলো ভাবে দু’পা হেটে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরে অহনা।
বিস্ময়ের ধাক্কায় শিহাব এবং সুমন তখনও স্তম্ভিত!

*** *** ***
এরপর অনেক দিন কেটে যায়। লিফটে অহনার সাথে কি হয়েছিল, সেটা সে কখনোই কাউকে জানায়নি। তবে এরপর থেকে খুব রহস্যময় একটা ঘটনা ঘটত। অহনা একই সঙ্গে দু’জায়গায় থাকতে পারত। একই সঙ্গে দু’জায়গায়, দু’কাজ করত সে প্রায়ই।
যারা টের পেত যে অহনাকে একই সময় আলাদা আলাদা দু’জায়গায় দেখা গেছে, তারা অনেকেই ব্যাপারটা বুঝত না, চোখের ভুল ভাবত, ভ্রম মনে করত কেউ কেউ। শুধু শিহাব এবং সুমন জানতে পারে যে ঘটনাটা চোখের ভুল নয়। অহনা একসঙ্গে দু’জায়গায় থাকতে পারে।
একসময় অহনা এবং শিহাবের বিয়ে হয়। তাদের নিজেদের পছন্দেই। শিহাবের হয়তো কিছুটা অপরাধবোধ ছিল অহনার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে তার জন্য, সেটা ভেবে। সে কারণেই অহনার সঙ্গে সারা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, কে জানে!
অহনা-শিহাবের একটি ছেলে হয়। খুব বুদ্ধিমান এবং মেধাবী একটি ছেলে। অহনা তার নাম রাখে-রিজভি।

আট
শিহাবের ডায়েরি থেকে।
এ বিষয়টা কিভাবে ব্যাখা করব বুঝতে পারছি না। আজ আমার ছেলেকে দু’টো আলাদা জায়গায় দেখা গেছে। এক জায়গায় সে মারামারি করছিল, আরেক জায়গায় ক্লাসে বসে পড়াশোনা করছিল। এই অদ্ভুত ক্ষমটা আমি অহনার মধ্যে দেখেছি একসময়। বহুদিন হয়ে গেল অহনা এই অশরীরী কাজটা করছে না। আমি অহনাকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি এ ব্যাপারে, কখনো জিজ্ঞেস করিনি সেদিন লিফটে আসলে কি ঘটেছিল তার সাথে, অহনাও এসব কথা আমাকে কখনো বলেনি।
তবে আমি নিজে এই অতিপ্রাকৃত ঘটনার অনেক ব্যাখ্যা খুঁজেছি। পাইনি।
শুধু একটা খটকা পেয়েছি।
অহনার একটা জমজ বোন ছিল। সেই বোনটি ছোটবেলায় পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। অপঘাতে মৃত্যু বলেই কি না কে জানে, পাড়া-প্রতিবেশীরা গল্প রচেছিল যে সেই মৃত বোনকে তারা দেখতে পায় মাঝে মধ্যেই। যে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, সেই পুকুরের পারে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে অহনার বয়সী, অহনার মতো দেখতে একটা মেয়ে, কিন্তু অহনা নয়।
এই গল্পটা আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম, যদি না শুনতাম যে অহনার বয়স যখন বারো-তের বছর, তখন মেয়েটাকে একদিন একই ভঙ্গিতে পুকুরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। মেয়েটার বয়সও তখন বারো-তের বছর ছিল। কখনো শুনিনি ভূতের বয়স বাড়ে। সেখানেই খটকাটা রয়ে গেছে আমার। এমন কি হতে পারে যে সেই বোন বেঁচে আছে এখনো? সেই বোনই অহনার প্রতিকৃতি সেজে ঘুরে বেড়ায় মাঝে মধ্যে?
যদি তাই হবে, তাহলে রিজভিও কি করে একই সঙ্গে দু’ জায়গায় থাকে? অহনার জমজ বোনের কি তবে একটা ছেলেও আছে, যার চেহারা রিজভির মতো? সেটা খুব বেশি কাকতালীয় হয়ে যায়। সত্যিকারের ঘটনাটা আসলে কি? আমি কি কখনো জানতে পারব?
আমার মনে আরও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। বিশ বছর আগে যে এলিসা স্যাম মারা গিয়েছিল, তার মৃত্যু রহস্য কি?
ডেথ সার্টিফিকেটে দেখা গেছে, এলিসা স্যামের মৃত্যুর কারণ ছিলো পানিতে ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। অহনার যমজ বোনেরও মৃত্যুর কারণ একই ছিল। একি নেহায়েতই কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি অন্য কোন রহস্য আছে এর ভেতর।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩০
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×