কিছুদিন আগে একটা প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছিলাম একটা কাজে। হেডমিস্ট্রেসের রুমের পাশে সিঁড়ি দোতলায় যাওয়ার জন্য আর তার পাশেই ক্লাসরুম। শিক্ষক না থাকায় ছেলে মেয়েরা চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড় করছিল। ভুরু কুঁচকে তাকানোর কেউ নেই।
আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম, আর দেখছিলাম
কিছুক্ষন পরেই অল্পবয়েসী একজন শিক্ষিকা রুমে ঢুকলেন। তাকে দেখেই লম্বামত শুকনো একটা মেয়ে জড়িয়ে ধরে হাসিতে ফেটে পড়ল কোন কারন ছাড়াই। হয়ত ছিল কোন কারন, যা আমি জানি না। দৃশ্যটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কতদিন আগে এভাবে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরেছিলাম মনে নেই। আনন্দ না খুঁজে এখন আনন্দের কারন খুঁজতে হয়। দোষটা হয়ত আমাদের নিজেদেরই।
শিশুকালে আমরা থাকি বাঁধাহীন। আক্ষরিক অর্থেই। আনন্দের চোটে চিৎকার করব? কোন সমস্যা নেই। উলটো শিশু যখন গম্ভীর হয়ে থাকে তখনই বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে পেট ব্যাথা করছে কিনা ভেবে। নতুন কাউকে দেখলে আড়ালে দাঁড়িয়ে খেয়াল করা শিশুদের স্বভাব। মুচকি হেসে কাছে টেনে নেয় সেই নতুন মানুষটাই। আর কিছুক্ষন পরেই সে হয়ে যেত নতুন বন্ধু।
বাল্যকাল পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে নিজের জগতটা ছোট হতে থাকে। নিজেকে মনে হতে থাকে ‘নট গুড এনাফ ফর দ্যা সোসাইটি’ এমন হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা ছেলেমেয়ে গুলোর দিকে নজর দেয়ার খুব কম মানুষই থাকে। ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ার মত ধীরে ধীরে তাদের চারপাশে দেয়াল তুলে ফেলে নিজের অজান্তেই। আর সে দেয়াল টপকে আসল মানুষটাকে কেউ দেখবে, এমন আশাতেই বসে থাকে বোকা গুলো। কিন্তু এটা বোঝে না যে কেউ নিজের প্রয়োজন ছাড়া দেয়াল টপকানোর কষ্টটা করতে যাবে না। আর তখনই হয় স্বপ্ন ভঙ্গ।
বাবা-মার সাথে দূরত্বের দেয়ালটা উঁচু হওয়ার সাথে সাথে উঁচু হয় সমাজের সাথের দেয়ালটাও।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, স্কুল-কলেজ পাশ করার পর ভার্সিটি লাইফ। যেখানে সবাই সিজিপিএ নামক ইউনিকর্নের পেছনে ছোটে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে একটু উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ঊঠানোর গরজ খুব কম ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থাকে।
বাসায় ফেরার পর বাবা-মাকে একটু না দেখে নিজের রুমে গিয়ে টাচস্ক্রীন ফোনে চোখ রাখাটাই জরুরী হয়ে পড়ে। মার কথার উত্তর দেয়ার চাইতে অপর প্রান্তের টেক্সটের রিপ্লাইটাই বেশি জরুরী তখন।
নিজেদের জগতটা ফেলে আরেকজনের জগতটা দেখার চাইতে গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকাটাই তখন অনেক আরামের মনে হয়। 'মানুষ সামাজিক জীব' তখন এই উপদেশ বাক্যটা মনে থাকে না। মনে থাকলে সে হয়ে যায় 'খ্যাত' আর দেখতে গেলে হয় 'গায়ে পড়া স্বভাবের'
এই ভয়েই নিজের চেনা জায়গাতেই ঘোরাফেরা করাটা নিরাপদ।
দেয়ালটা উঁচু হতে হতে এত বেশি হয়ে যায় যে নিজের আকাশটাই ঢাকা পড়ে যায় অনেকের। আর হতাশাটা তখনই ঘিরে ধরে অক্টোপাসের মত। সাকশন কাপ দিয়ে শুষে নেয় ভেতরের সেই ছোট্টবেলার আনন্দগুলো।