somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আব্দুল কাদের যেখানে, জ্বিনের উৎপাত সেখানে! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-৬ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)

৩০ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধ্যার পর পরই বাড়ীতে পৌঁছলাম। দেখি আবদুল কাদের কোন কথা না বলে, হন হন করে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলেন। আজকে তার আচরণটা একটু ব্যতিক্রম মনে হল! ওদিকে আমার পেটের মধ্যে দম ফাটানো জ্বিনের তথ্য! কাউকে বলতে না পারা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা! অবশেষে বাড়ীর বাৎসরিক কাজের রাখাল ও মধ্যবয়সী চাকরানীকে সব বলে ফেললাম। তারা শুনলেন কিছুই বললেন না। আমি শান্তি পেলাম কেননা কাউকে তো ঘটনাটি শুনাতে পেরেছি।

ঠিক এমন সময় আতঙ্কিত এক খবর শুনলাম। জেঠাত ভাইয়ের বউ, সম্পর্কে বড় ভাবী, পাগল হয়ে গিয়েছে! সন্ধ্যায় তিনি নামাজ পড়েছেন, চা নাস্তা খেয়েছেন। কথা বার্তার এক পর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং সামনে যা পাচ্ছেন তা ভেঙ্গে একাকার করে ফেলছেন! কেউ বাধা দিতে গেলেই তাকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। ধান চাউলের বস্তাগুলো একাকী আলগিয়ে আছড়ে ফেলছেন! যেটা একজন শক্ত সামর্থ্য পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়! আমিও দৌড়ে গেলাম। উত্তেজিত ভাবী কাউকে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন, আমি যেন তার কেনা চাকর, এমন ভঙ্গিতে আদেশ করলেন! এই সব বস্তাগুলো ধর এবং আমার বাপের বাড়ীতে পৌছিয়ে দাও!

মুরুব্বীরা কানাকানি করতে লাগল বউকে জ্বিনে ধরেছে! আর যায় কোথায়? চাকর চাকরানী বলে বসল, এই জ্বিন চেয়ারম্যানের বউকে আক্রমণ করা জ্বিন। আজ সন্ধ্যায় আমার সাথেই জ্বিন আমাদের বাড়ি চিনেছে। সে জন্য বাহক হিসেবে সকল দোষ আমার! সবার সামনে মা প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার সত্য কিনা? হ্যাঁ বোধক উত্তর মিলল। আমার কথা কেউ বিস্তারিত আর শুনতেই চাইল না। সব দোষ আমার, এজন্য আমিই দায়ী। কেননা আমার সাথের জ্বিনই আমাকে কু-প্ররোচনা দিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি চিনিয়েছে। আবার চেয়ারম্যানের বউয়ের সেই জ্বিনকে আমি আমাদের বাড়ি চিনিয়েছি! বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল।

আমি কিভাবে বুঝাই আমি জ্বিনে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি নই। তাছাড়া আমিতো এদের মত পাগলামি করি না। যাই হোক, সে রাত্রে রুহুল আমিন বৈদ্যকে আনা হল, তিনি এক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় জ্বিন তাড়ালেন। তবে বৈদ্য একটি মহৎ কাজ করে গেলেন। জ্বিনকে প্রশ্ন করেছেন, সে কখন এবং কেন এই মহিলার উপর ভর করেছে? জ্বিন বলেছে, আজ বিকেলেই সে ভর করেছে, যখন মহিলাটি লাল শাড়ী পড়ে কবরের পাশে ঘুরঘুর করছিল। এতে আমার উপর বদনামীর বোঝা আপাত সমাধান হল। তবে সন্ধ্যা বেলায় সকলের খোঁটা তখনও আমার গায়ে হুল ফুটচ্ছিল। লাভের মধ্যে হল, একদিনে জ্বিন তাড়ানোর দুটি দৃশ্য অবলোকন করলাম। দুজন বৈদ্য সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে জ্বিনকে শাস্তি দেবার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা পেলাম।

আশা করি আবদুল কাদেরের কথা ভুলে যান নাই? তিনি মাঝ বয়সী সুঠাম দেহের এক ব্যক্তি। বাড়ী ভারতের আসামে। ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতের অরুণাচল, হিমাচল, ত্রিপুরা, গৌহাটি তন্ন তন্ন করে ঘুরেছেন। বহু পেশা অবলম্বন করে দেখেছেন, কোন পেশাতেই তিনি ভাল করতে পারেন নাই। অবশেষে একজন চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন। আমার বাবা চা বাগানের ম্যানেজার থাকাকালে তার চাকুরী স্থায়ী করেন এবং কুলি সর্দার হিসেবে নিয়োগ পান। নামে আবদুল কাদের হলেও খাসিয়ত, চিন্তাধারা, ভাবনা সবকিছুই কুলিদের মত।

উল্লেখ্য কুলিরাও মানুষ, কবি নজরুল কুলিদের পক্ষে কবিতা লিখে অমর হয়ে আছেন এবং বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। এখানে কুলি কথাটি ঘৃণার জন্য বলা হয়নি। বন্দরের শ্রমিক কুলি আর চা বাগানের কুলি এক নয়, তাদের মাঝে আছে বিস্তর তফাৎ। চা বাগানের কুলিরা এক বেলা কাজ করে মাত্র। তারপর মদ, গাঁজা গিলে বাকি পুরো দিন পুরো রাত ঘুমিয়ে কাটায়। তাদের হাতে টাকা গেলেই মুসিবত! তারা নগদ টাকার সবটাই দিয়ে মদ কিনে ফেলে। তাই বাগান কর্তৃপক্ষ এসব মানুষকে সপ্তাহান্তে রেশনের মাধ্যমে খাবার দেয়। এদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন ও কর্ম নিয়ন্ত্রণে একজন দক্ষ সর্দারের দরকার পড়ে! নতুবা দায় দেনা বাড়িয়ে কর্জের চাপে একদিন গোপনে স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এতে বাগানের শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।

আমার বাবা চা বাগানের চাকুরী ছেড়ে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি বিরাটকায় ফলের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। নানাবিধ ফলে বাগান ভরপুর থাকলেও; পাহাড়ী ফল মূল ও বিচিত্র গাছের প্রতি আমার আকর্ষন ছিল। আবদুল কাদের সেই বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সে তার পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের খামার বাড়ীতে থাকত। সপ্তাহ শেষে তাকে আমাদের বাড়ীতে আসতে হত। তার আগমনে আমি খুবই উৎফুল্ল হতাম। পাহাড়ি ফল মূলের প্রতি আমার দূর্বার আকর্ষণের কথা সে জানত। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা গুলো আমি শুনতে উদগ্রীব থাকতাম। তার ঘটনাগুলো কিছুটা অদ্ভুত, চিত্তাকর্ষক যা শুনতে মন চাইত। যার কারণে সে আমাদের বাড়ী আসার তারিখ, সময়, বার, দিন হুবহু আমার মনে থাকত।

আমার মেঝ ভাই, মাদ্রাসায় পড়েন, খুবই ভদ্র ও অমায়িক। বয়সে আমার চেয়ে আট বছরের বড়। তাঁর কঠোর নজরদারীতে আমার লেখাপড়া, শিষ্টাচার অর্জন, চরিত্র গঠনের মত কঠিন পাঠ চলছিল। তাঁর হাতের লেখা বেজায় অসুন্দর হলেও, আমার হাতের লিখা কেন সুন্দর হয়নি! সেই অপরাধে জীবনে কতবার কান মলা ও কান ধরে উঠবস করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই!

সর্বদা খেলাধুলা নিয়ে পারিবারিক কাজে গড় হাজিরা দিতাম। পক্ষান্তরে তিনি অক্ষরে অক্ষরে মায়ের আদেশ পালন করতেন। এমন কি, তিনি কান খাড়া করে বসে থাকতেন, মা কোন জিনিষটার জন্য কখন কাকে ডাকছেন। নিজের স্বাদ আহ্লাদ, খেলাধুলাকে কে বিসর্জন দিয়ে মায়ের কাজ করার জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকার মত মানুষ, তাঁর মত আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি! এই ধরনের সন্তান অবশ্যই মায়ের প্রিয়ভাজন হবে সন্দেহ নাই। তাঁর চরিত্রের মানদণ্ড বিচারে ভাই হিসেবে আমি তাঁর ধারে কাছেও নই! তাঁর দৃষ্টিতে আমার চলা ফেরায় শুধু দোষ আর ত্রুটি!

আবার আমাকে খুব ভালবাসতেন, বুঝাতেন কারো সাথে যেন ঝগড়া না করি। কাউকে যেন গালি না দেই, মা-বাবাকে গালি না শোনাই, খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করি ইত্যাদি। মানুষের চিন্তা চেতনায় খারাপ বন্ধু বাছাইয়ের মানদণ্ড ভিন্ন হবেই। আমি যাকে ভাল বন্ধু মনে করে গল্প করলাম, মেজভাই তাকেই খারাপ বন্ধু মনে করে ভিতরে ভিতরে তেতে থাকতেন! অতঃপর মা’কে বুঝাতেন আমি আবার খারাপ বন্ধুদের সাথে চলাফেরা শুরু করেছি! ক্যারাম বোর্ড, মার্বেলের মত সাধারণ গ্রাম্য খেলাগুলো পর্যন্ত আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল! এই দোষে চড়া শাস্তি হিসেবে কান ধরে উঠ বসের খেসারত চলত! ওয়াদা করতে হত। শাস্তির পরে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন, বুঝাতেন মাথায় হাত বুলাতেন। যাতে গোস্বা করে তাকে ভুল না বুঝি, তিনি এসব শাস্তি আমার কল্যাণের জন্যই দিতে বাধ্য হয়েছেন!

যে ভাইটি, তার ছোট ভাইকে শিষ্টাচার শিখানোর জন্য, অহর্নিশি এত ব্যস্ত। সেই মেঝ ভাইটি এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করে তার ওস্তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী ধরে গালাগালি শুরু করে দিলেন! সে কি গালা গালিরে বাবা! এত বিশ্রী ভাষায় অশ্রাব্য গালাগালি আমি আমার জনমেও শুনিনি! মা ঘর থেকে বের হলেন, তিনি তাঁকেও পরোয়া করলেন না! আমার পিতাকে শ্রদ্ধা ও ভয় দুটোই করতেন। আজ তিনি এসে যখন প্রশ্ন করলেন কি হয়েছে তোমার? সাথে সাথে আমার বাবার দাদাকে ধরে গালাগালি শুরু করলেন! সে কি নোংরা, কদর্য ভাষায় গালাগালি! গালির ভাষা লিখা তো সম্ভব নয়ই, ভদ্র মানুষের পক্ষে রেকর্ড করাও অসম্ভব হবে! আমি নিজের কান দু’টোকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, মাদ্রাসার পড়ুয়া একজন সেরা ভদ্র ছাত্র, কদাচিৎ মসজিদের ঈমাম, গ্রাম জোড়া যার যার সুনাম আর সুখ্যাতি! সেই ব্যক্তিটি কিনা গালির ব্যোম দিয়ে মৃত-জীবিত সবার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ছেন! সেরা গালা গালির জন্য যদি রাষ্ট্রে পুরষ্কারের ব্যবস্থা থাকত, নির্ঘাত তিনিই সেই পুরষ্কার পেয়ে যেতেন!

আগের পর্ব: জ্বিন তাড়ানোর কৌশল দেখা! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-৫ পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:২৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×