ঢাকা ক্লাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা এখন টক অফ দা টাউন। বিশেষ করে ক্লাব প্রেসিডেন্ট পস সেলিমের বক্তব্য যেন আগুনে ঘৃতাহুতির মত। এই নিয়ে যে বাদ প্রতিবাদ তার ঢেউ ব্লগেও এসে লেগেছে।
১৮৭০ সালে এই সেই ঢাকা ক্লাব
পশ্চিমা রীতিতে সামাজিক মেলামেশার কাজটি সাধারণত ক্লাবেই সারা হয়ে থাকে। ঢেকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে তেমনি বৃটিশরাও তাদের ঔপনেবেশিক শাসনামলে, অবিভক্ত ভারতের প্রচুর ক্লাব তৈরি করে করেছিল। সাধারণত বৃটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মকত অফিসারদের বিনোদনকেন্দ্র হিসেবেই এই সব ক্লাব তৈরি হয়। তবে সেখানে বৃটিশরাজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারি সবাই উপস্থিত হতেন। প্রথম দিকে সেখানে নেটিভ অর্থাৎ ভারতের স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতি নিষিদ্ধ হলেও, পরে, তৎকালিন সমাজের উচ্চবিত্ত নেটিভরাও বিশেষ আমন্ত্রনে উপস্থিত হতে পারতেন।
চট্রগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব। যেখানে হানা দিয়েছিলেন সুর্যসেন।
এই ক্লাবগুলিতে শুধু বিশ্রাম নয় অনেক কিছুই চলতো, যা সর্বভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থি। বৃটিশদের উচ্ছিস্টভোগি কিছু কর্মচারি এবং রাজা মহারাজা উপাধিপ্রাপ্তরাও সেখানে যেতেন। উদ্দেশ্যে ধন সম্পদ বা কৃষ্ণকেশি স্থানীয় সুন্দরি ললনাদের ঘুষ দিয়ে নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরো পাকা করা।
কলকাতা ক্লাব
এই ক্লাবে বসেই ভারতের জনগণকে আরো কি কি উপায়ে বাঁশ দেয়া যায়, সে সব পরিকল্পনাও করতো বৃটিশরা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের সুতিকাগারও ছিল বৃটিশ এই ক্লাবগুলি।
বৃটিশরা যখন নেটিভদের জন্য আধুনিক শিক্ষাব্যাবস্থার প্রচলন করলো, তখন কট্টর ঔপনিবেশিক বৃটিশরা এর বিরোধিতা করেছিল। উওরে এই শিক্ষাব্যাবস্থা প্রচলনের পক্ষ্যে বলা হয়েছিল, আমরা এমন একটি শ্রেণি সৃস্টি করে যাবো, যারা চেহারায় ভারতীয় হবে বটে, কিন্ত মন মানসিকতা চলনে বলনে খাটি বৃটিশ হবে। আমাদের স্বার্থোদ্ধারে, এরাই অগ্রদুতের ভুমিকা পালন করবে।
সারা বিশ্বে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিভেদ হিংসা দ্বেষের বীজ বপনকারিদের একমাত্র হলো বৃটিশরা। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও সারা বিশ্বে অনৈক্য এবং বিভেদ বজায় আছে। যেমন আমেরিকায় সাদা কালো, ভারতে হিন্দু মুসলিম কাশ্মির পাঞ্জাব, ইরাক-কুয়েত, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল, আফ্রিকায় বিভিন্ন উপজাতীয়, বাংলাদেশে পস - নন পস ইত্যাদি। ক্লাবগুলি ছিল এধরণের বিভেদ রচনার গোপন সুতিকাগার।
জৌলুস আর ভোগবিলাসের অন্যতম তীর্থ লাস ভেগাসের জনপ্রিয় শ্লোগান হচ্ছে, Whatever happens in Vegas stays in Vegas
বৃটিশরা এই নিয়ম অনেক আগে থেকেই অনুসরণ করতো। ফলে ক্লাবে বসে আনন্দ ফুর্তিই বলুন কিংবা ষড়যন্ত্রের কাহিনী, সেটা প্রকাশ পেতে অনেক অনেক দিন পার হয়ে গিয়েছে। নব্য সাহেবরাও বৃটিশ আচারের সাথে সাথে এই গোপনীয় রক্ষার কাজটি খুব যত্ন করে অনুসরণ করে থাকেন।
বৃটিশদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য অনুসরণ করে, তাদের শুন্য ক্লাবগুলি প্রতিস্থাপিত হয়েছে দেশীয় প্রভাবশালিদের। সারা ভারত বর্ষেই এধরণে অসংখ্য ক্লাব আছে। যার অনেক গুলিই অবশ্য সাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভারতে।
আমাদের ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। ঢাকা ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব তো ছিলো, সেগুলির পিছু পিছু অভিজাতদের জন্য ক্রমেই বনানি ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, আরো কত ক্লাব গড়ে উঠেছে। এখানেও যা কিছু চর্চা হয়, সেটা আমাদের বৃত্ততর সংস্কৃতির চরম পরিপন্থি বটে।
ফিরে আসছি ঢাকা ক্লাবের কথায়। ঐ যে বল্লাম, বৃটিশরা চলে গেলেও রেখে গেছে মন মানসিকতার কিছু স্থানীয়দের। যারা ক্ষমতার নেপথ্যের কারিগর হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ভুমিকা রেখে থাকেন। ঢাকা ক্লাবের সদস্যপদ নেবার জন্য এতো বিশাল অংকের চাঁদা দিতে হয় যে, সেটা বহন করা সাধারণ তো দুরের কথা অনে বিত্তবানেরও ইচ্ছা জাগে না। শুধু চাদা দেবার সামর্থ্য থাকলেই চলবে না, সমাজের প্রবল প্রভাবশালি কারো রেফারেন্স ছাড়া সেখানে সদস্যপদ লাভ করা অসম্ভব।
এমন ঢাকগুরগুর অবস্থা সেখানে কেন, সেটা ঢাকা ক্লাবের মহারথিরা কেউ মুখে না বললেও, ইতিহাস বিচার করে সেটা আন্দাজ করা মোটেও কস্টকর কিছু নয়।