[কিছুদিন আগে ভারতীয় চলচিত্র আমদানি নিয়ে ব্লগ কাপানো এক ঝাক লেখা এসেছিল। যেহেতু আমি ভারতীয় চলচিত্র দেখি না, তাই দৃঢ়ভাবে পক্ষ বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটা কঠিন ছিল। তবে এই লেখাটাটাকে শক্ত অবস্থানে দাড়া করানোর জন্য গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটা ভারতীয় ছবি দেখলাম। যার মধ্যে পুরানো নতুন মিলে, হিন্দি বাংলা এবং তামিল ছবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাথে আলাদা করে বাংলাদেশের চলচিত্রের সাথে সংযুক্ত আছেন বা ছিলেন এমন গুটি কয়েক মানুষের সাথেও আলাপ করলাম। আর তার উপর ভিত্তি করেই এ লেখার অবতারণা।]
বাংলাদেশে সবাক/নির্বাক/স্বল্প/পুর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচিত্রের মধ্যে সর্বপ্রথম নির্মিত হয় সেই ১৯২৭-২৮ সালেই। ঢাকার নবাব পরিবারের তরুণদের প্রযোজনায় "সুকুমারি" হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রথম নির্বাক চলচিত্র। পরিচালনা করেছিলেন, জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। যিনি সে সময় নাট্টকার হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিলেন। নায়কের ভুমিকায় ছিলেন নবাব নাসিরুল্লাহ। এবং যেহেতু সেসময়কার সমাজ ছিল বেশ রক্ষণশীল, তাই নায়িকার ভুমিকায় একজন পুরুষকে নেয়া হয়েছিল। এই নায়িকার ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আব্দুস সোবহান। ক্যামেরার দ্বায়িত্বে ছিলেন খাজা আজমল। এবং পুরো সুটিংটা করা হয়েছিল দিলখুশা গার্ডেনে। তবে এটি দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত হয়নি। এবং কালের আবর্তে সেই প্রিন্টটিও হারিয়ে গিয়েছে। ছবি দেখুন।

পুর্ণ দৈর্ঘ্যের প্রথম নির্বাক চলচিত্রটির নাম "দা লাস্ট কিস"। এই ছবিটিও প্রযোজনায় ছিলেন ঢাকার নবাব বাড়ির সেই উৎসাহি তরুণদল, আর পরিচালকও একই। তবে এই ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন টোনা বাবু (শৈলেন রায়)। আর নায়কের ভুমিকায় বেশ কয়েকজন অভিনয় করেছিলেন। যেমন খাজা নাসিরুল্লাহ, আর খাজা জালালুদ্দিন।

তবে এইবার আর পুরুষ দিয়ে নায়িকার ভুমিকায় অভিনয় করানো হয়নি। ঢাকার পতিতালয় থেকে ললিতা ওরফে বুড়ি, চারুবালা, দেবিবালা এবং হরিমতি বাঈজি নারী ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

দিলখুশা, মতিঝিল আজিমপুর ইত্যাদি অঞ্চলে সুটিং করা হয়েছিল। পরিচালক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত পরিচালনার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি সাবটাইটেল করেছিলেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দালিব সাদানি উর্দু সাবটাইটেল তৈরির দ্বায়িত্বে ছিলেন। কোলকাতা থেকে প্রিন্ট করিয়ে আনা হয়। তৎকালিন ১২,০০০ টাকা ব্যায়ে, ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া ছবিটি শেষ হয় ১৯৩১ সালে। মুক্তি দেয়া হয় ঢাকার মুকুল সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে। যা আমরা আজাদ সিনেমা হল নামে চিনি। এবং বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে বেশ কয়েক সপ্তাহ চলেও ছবিটি। এই সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, আরো বৃহত্তর পরিসরে পরিবেশনার জন্য ছবিটি কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে ছবিটি "অরোরা ফিল্ম কোম্পানির" তত্ত্বাবধানে থাকার সময় ছবিটির প্রিন্ট হারিয়ে যায়। আর এভাবেই একটি ইতিহাস, কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছে চিরদিনের জন্য।
১৯৩১ থেকে ২০১০। ৭৯ বছর। আর এত বছর পর আমাদের ভাবতে হচ্ছে আমাদের চলচিত্র উন্নয়নের। কিন্তু কেন? এ নিয়েই সম্পুর্ন আমার নিজস্ব ভাবনাগুলি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
সুবেদার ইসলাম খাঁ এর হাতে গড়া ঢাকা শহরের জন্মই হয়েছিল সেনানিবাস হিসেবে। এর পর কালের আবর্তে ক্ষনিকের জন্য রাজধানি হিসেবে এর জনসংখ্যা বাড়লেও এখানে মুলত আগমন ঘটেছিল ভাগ্যের অন্বেষনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা মানুষদের। জাতিতে যারা ছিলেন অবাঙ্গালি। ফলে এ দেশের শেকর যে গ্রাম বাংলা, তার সাথে এদের নাড়ির সম্পর্ক বলে কিছু ছিল না। বিত্তের পরিমানে এরা উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের কাতারে অবস্থান করলেও, বাংলার সংস্কৃতি ভাষা ও ঐতিহ্যের জন্য যে দায়বদ্ধতা, তার ছিটেফোটাও এদের মধ্যে ছিল না।
তাই শিক্ষা, বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উৎকর্ষতার জন্য যে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন ছিল, সেটি কখনো হয়ে ওঠেনি।
আর বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষই ছিলেন কৃষিজীবি। সারাদিন হাড়খাটা খাটুনির পর বিনোদন বলতে ছিল জারি সারি গান, কবির লড়াই এবং সর্বোচ্চ বিলাসিতায় যাত্রা কিংবা পালা গানের আসর। আর শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রগুলি একদিকে যেমন খুবই সীমিত ছিল, তেমনি শিক্ষার চেয়ে কৃষিকাজে পারদর্শিতার প্রতিই আমাদের আকর্ষন ছিল বেশি। তাই নাটক থিয়েটার ইত্যাদি "শিক্ষিত বড়লোকি বাবুয়ানার" প্রতি কোন আকর্ষনই ছিল না তাদের।
বৃটিশদের রাজত্বে খোদ ঢাকা শহর চরম অবহেলায় রুগ্ন থেক রুগ্নতর অবস্থায় পতিত হয়েছিল। বেশ ক বছর আগে সাপ্তাহিক ২০০০ এ, বৃটিশ বাংলার বিভিন্ন জেলায় ভ্রমন করা একজন ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেটের ডায়রির সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। যা থেকে তৎকালিন ঢাকার সমাজের একটি স্বচ্ছ চিত্র ফুটে উঠেছিল। রেস খেলা, জুয়া খেলা, গ্রাম থেকে আসা মানুষদের প্রতারণা করে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়া, মদ খাওয়া, বাইজি বাড়িতে পড়ে থাকা, এসবই ছিল তৎকালিন মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন চালচিত্র।
এক দিকে গ্রামের মানুষদের মধ্যে শিক্ষায় চরম পিছিয়ে থাকা, অন্যদিকে শহুরে অবাঙ্গালিদের মধ্যে অনৈতিক কর্মকান্ডের মাৎসন্যায়, এই দুইয়ে মিলিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিধি হয়ে পড়েছিল খুবই সংক্ষিপ্ত।
আগেই উল্লেখ করেছি যে বৃটিশদের পতনের আগে আগে বাংলাদেশে চলচিত্র নিমার্নের ইতিহাস থাকলেও, তার ধারাবাহিকতা আর থাকেনি। এ জন্য এক দিকে যেমন কোলকাতাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়ে ঢাকাকে রুগ্ন করে রাখা যেমন দায়ি, তেমনি তৎকালিন চরম রক্ষণশীল সমাজকেও দোষি করা যায়। যাদের চোখে সংস্কৃতি চর্চা ছিল ধর্ম ও নৈতিকতা পরিপন্থি কাজ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে আগে জহির রায়হান, এহতেশাম প্রমুখ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে বাংলা ছবির উজ্জল ভবিষ্যত ছিল। জহির রায়হানের রহস্যজনক অন্তর্ধ্যান এবং এহতেশামের ধীরে চল নীতির কারনে বাংলাদেশের চলচিত্র দুই দিকপালের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। পাশাপাশি রাজাকার আল বদরদের হাতে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের মাথারা খুন হবার কারণেও বুদ্ধিবৃত্তিক শুন্যতা সৃস্টি হয়েছিল। যা কোনদিনও পুর্ণ হবার নয়।
যুদ্ধবিধবস্ত একটি দেশে যেখানে মানবিক সংকট মোকাবেলাটাই জরুরি ছিল, সেখানে সিনেমার মত বিনোদন খাতে সরকারের পক্ষ্য থেকে শক্ত বিনিয়োগ ছিল অবাস্তব। কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতার পরেও বঙ্গবন্ধু এফ ডি সি নির্মান করে দিয়েছিলেন। আদ্যিকালে ক্যামেরা লাইট আর ল্যাব দিয়েও তাই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সফল বেশ কিছু চলচিত্র নির্মান সম্ভব হয়েছিল।
৭২ থেকে ৮১ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে বাংলাদেশের চলচিত্রাঙ্গনেও এসেছিল স্থবিরতা। যার দরুণ সাংস্কৃতিক বোদ্ধা প্রযোজক এবং পরিচালকেরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। আর সেই শুন্যস্থান পুরণ করে মেধাহীন পরিচালক আর আলু পেয়াজের ব্যাবসায়ি প্রযোজকরা। ফলে ফোক ফ্যান্টাসি কিংবা মারদাঙ্গা ছবির নামে মানহীন একের পর এক অদ্ভুতুড়ে চলচিত্র নির্মানের হিড়িক পড়ে গেলো। এর মধ্যেও নারায়ন ঘোষ মিতা কিংবা কামাল আহমেদরা বছরে একটা দুটো করে সামাজিক ছবি দর্শকদের উপহার দিতেন। কিন্ত মধ্যবিত্তের বিনোদনের খোরাক হিসেবে সে সবই ছিল অপ্রতুল।
এর মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত কুখ্যাত মোনায়েম খানের কুখ্যাত মেয়ে জামাই জাহাঙ্গির মোঃ আদেলের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ভিসি আরে হিন্দি ছবিতে ঢাকা শহর সয়লাভ হয়ে যাওয়াতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঘরে বসেই বিনোদনের সহজ মাধ্যম হাতে পেয়ে যায়। ফলে বাংলা চলচিত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কাজটা সম্পন্ন হয়।
(আগামি পর্বে সমাপ্য)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






